পত্রাবলী (পূর্বানুবৃত্তি) (পত্র সংখ্যাঃ ৪৫১-৫৪০)-স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা

স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
অষ্টম খণ্ড

পত্রাবলী (পূর্বানুবৃত্তি) (পত্র সংখ্যাঃ ৪৫১-৫৪০)

*******************

পত্র সংখ্যা (৪৫১-৪৬০)

পত্র সংখ্যা (৪৫১-৪৬০)

পত্র সংখ্যা - ৪৫১

সান ফ্রান্সিস্কো
৪ মার্চ, ১৯০০
কল্যাণীয়া নিবেদিতা,
আমি আর কাজ করতে চাই না—এখন বিশ্রাম ও শান্তি চাই। স্থান ও কালের তত্ত্ব আমার জানা আছে, কিন্তু আমার বিধিলিপি বা কর্মফল আমায় নিয়ে চলেছে—শুধু কাজ, কাজ! আমরা যেন গরুর পালের মত কসাইখানার দিকে চালিত হচ্ছে; কসাইখানা অভিমুখে তাড়িত গরু যেমন পথের ধারের ঘাস এক এক খাবলা খেয়ে নেয়, আমাদের অবস্থাও ঠিক সেই রকম। আর এই হচ্ছে আমাদের কর্ম বা আমাদের ভয়—ভয়ই হচ্ছে দুঃখ ব্যাধি প্রভৃতির আকর। বিভ্রান্ত ও ভয়চকিত হয়ে আমরা অপরের ক্ষতি করি। আঘাত করতে ভয় পেয়ে আমরা আরও বেশী আঘাত করি। পাপকে এড়িয়ে চলতে একান্ত আগ্রহান্বিত হয়ে আমরা পাপেরই মুখে পড়ি।

আমাদের চারপাশে কত অকেজো আবর্জনা-স্তূপই না আমরা সৃষ্টি করি! এতে আমাদের কোন উপকারই হয় না; পরন্তু যাকে আমরা পরিহার করতে চাই তারই দিকে—সেই দুঃখেরই দিকে আমরা পরিচালিত হই।

আহা! যদি একেবারে নির্ভীক সাহসী ও বেপরোয়া হতে পারা যেত!

তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৫২
১৫০২ জোন্স্ ষ্ট্রীট
সান ফ্রান্সিস্কো
৭ মার্চ, ১৯০০
প্রিয় জো,
মিসেস বুলের পত্রে জানলাম যে, তুমি কেম্ব্রিজে আছ। হেলেনের পত্রে আরও খবর পেলাম যে, তোমায় যে গল্পগুলি পাঠানো হয়েছিল, তা তুমি পাওনি। বড়ই আপসোসের কথা। মার্গর কাছে এর নকল আছে, সে তোমায় দিতে পারে। আমার শরীর একরকম চলে যাচ্ছে। টাকা নেই হাড়ভাঙা পরিশ্রম অথচ ফল শূন্য! লস্ এঞ্জেলেসের চেয়েও খারাপ! কিছু না দিতে হলে তারা দল বেঁধে বক্তৃতা শুনতে আসে—আর কিছু খরচ করতে হলে আসে না; এই তো ব্যাপার!

দিন কয়েক যাবৎ আমার শরীর খারাপ হয়েছে এবং বড় বিশ্রী বোধ হচ্ছে। আমার বোধ হয়, রোজ রাত্রে বক্তৃতা দেবার ফলেই এ-রকম হয়েছে। আমার আশা আছে যে, ওকল্যাণ্ডের কাজের ফলে অন্ততঃ নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত ফিরে যাবার টাকা সংগ্রহ করতে পারব; আর নিউ ইয়র্কে গিয়ে ভারতে ফেরবার টাকার যোগাড় দেখব। লণ্ডনে মাস কয়েক থাকবার মত টাকা এখানে সংগ্রহ করতে পারলে লণ্ডনেও যেতে পারি। তুমি আমায় আমাদের জেনারেল-এর ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিও তো। নামও দেখছি আজকাল মনে থাকে না।

তবে আসি। প্যারিসে তোমার সঙ্গে দেখা হতেও পারে, নাও পারে। ভগবান্‌ তোমায় আশীর্বাদ করুন। আমি যতটা সাহায্যের যোগ্য, তুমি তার চেয়েও বেশী সাহায্য আমায় করেছ। আমার অসীম ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানবে। ইতি

বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৫৩
১৫০২ জোন্স ষ্ট্রীট
সান ফ্রান্সিস্কো
৭ মার্চ, ১৯০০
প্রিয় ধীরামাতা,
… আপনাকে আমি আমার জন্য আর কিছু করতে বলছি না—আমার কোন প্রয়োজন নেই। আপনি যা করেছেন, তাই যথেষ্ট—আমি যতটার উপযুক্ত, তার চেয়েও ঢের বেশী করেছেন। আপনিই আমার একমাত্র বন্ধু, যিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে জীবনের ধ্রুবতারারূপে গ্রহণ করেছেন; আপনাকে আমি যে এত বিশ্বাস করি, তার রহস্য ওইখানেই। অন্যেরা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ভালবাসে। কিন্তু তাদের ধারণাও নেই যে, তারা আমাকে শ্রীরামকৃষ্ণেরই জন্য ভালবাসে। তাঁকে বাদ দিলে আমি শুধু কতকগুলি অর্থহীন ও স্বার্থপূর্ণ ভাবুকতার বোঝা মাত্র। যাই হোক, ভবিষ্যতে কি হবে, এই দুশ্চিন্তা এবং ভবিষ্যতে কি হওয়া উচিত, এই আকাঙ্ক্ষার পীড়া বড়ই ভয়ানক। আমি সে দায়িত্বের অনুপযুক্ত—আমার অযোগ্যতা আজ ধরা পরে গেছে। আমাকে একাজ ছেড়ে দিতে হবে। এ কাজে যদি কোন নিজস্ব জীবনী শক্তি না থাকে তো মরে যাক; আর যদি থাকে, তবে আমার মত অযোগ্য কর্মীর জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হবে না। … আমি সারা জীবন মায়ের কাজ করেছি। এখন তা হয়ে গেছে—আমি এখন তাঁর চরকায় তেল দিতে নারাজ। তিনি অন্য কর্মী বেছে নিন—আমি ইস্তফা দিলাম!

আপনার চিরসন্তান
বিবেকানন্দ

*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৫৪
[স্বামী তুরীয়ানন্দকে লিখিত]
সান ফ্রান্সিস্কো
মার্চ, ১৯০০
হরিভাই,
এই মিসেস বাঁড়ুয্যের কাছ থেকে একটা bill of lading (মাল চালানের বিল) এসেছে। সে মহিলাটি কি দাল-চাল পাঠিয়েছে—এটা তোমায় পাঠাচ্ছি। মিঃ ওয়াল্ডোকে দিও; সে সব আনিয়ে রাখবে—যখন আসবে।

আমি আসছে সপ্তায় এ স্থান ছেড়ে চিকাগোয় যাব। তারপর নিউ ইয়র্কে আসছি।

এক-রকম আছি। … তুমি এখন কোথায় থাক? কি কর? ইত্যাদি। ইতি

বি
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৫৫
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
সান ফ্রান্সিস্কো
১২ মার্চ, ১৯০০
অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার এক পত্র পূর্বে পাই। শরতের এক পত্র কাল পেয়েছি। তাঁর জন্মোৎসবের১৭ নিমন্ত্রণপত্র দেখলাম। শরতের বাতের কথা শুনে ভয় হয়। রাম রাম! খালি রোগ শোক যন্ত্রণা সঙ্গে আছে দু-বছর। শরৎকে বল যে, আমি বেশী খাটছি না আর। তবে পেটের খাওয়ার মত না খাটলে শুকিয়ে মরতে হবে যে! … দুর্গাপ্রসন্ন পাঁচিলের যা হয় অবশ্যই এতদিনে করে দিয়েছে। … পাঁচিল তোলা কিছু হাঙ্গামা তো নয়। … পারি তো সেই জায়গাটায় একটা ছোট বাড়ী বানিয়ে নিয়ে বুড়ো দিদিমা ও মা-র কিছুদিন সেবা করব। দুষ্কর্ম কাউকে ছাড়ে না, মা কাউকেই সাজা দিতে ছাড়েন না। আমার কর্ম ভুগে নিলুম। এখন তোমরা সাধু মহাপুরুষ লোক—মায়ের কাছে একটু বলবে ভাই, যে আর এ হাঙ্গাম আমার ঘাড়ে না থাকে। আমি এখন চাচ্ছি একটু শান্তি; আর কাজকর্মের বোঝা বইবার শক্তি যেন নাই। বিরাম এবং শান্তি—যে কটা দিন বাঁচব, সেই কটা দিন। জয় গুরু, জয় শ্রীগুরু!

লেকচার-ফেকচার কিছুই নয়। শান্তিঃ! মঠ-(এর) ট্রাষ্ট-ডীড শরৎ পাঠিয়ে দিলেই সই করে দিই। তোমরা সব দেখো। আমি সত্য সত্য বিশ্রাম চাই। এ রোগের নাম Neurosthenia—স্নায়ুরোগ। এ একবার হলে বৎসর কতক থাকে। তবে দু-চার বৎসর একদম rest (বিশ্রাম) হলে সেরে যায়। … এ দেশে ঐ রোগের ঘর। এইখান থেকে উনি ঘাড়ে চড়েছেন। তবে উনি মারাত্মক হওয়া দূরে থাকুক, দীর্ঘ জীবন দেন। আমার জন্য ভেবো না। আমি গড়িয়ে গড়িয়ে যাব। গুরুদেবের কাজ এগোচ্ছে না—এই দুঃখে। তাঁর কাজ কিছুই আমার দ্বারা হল না—এই আপসোস! তোমাদের কত গাল দিই, কটু বলি—আমি মহা নরাধম! আজ তাঁর জন্মদিনে তোমাদের পায়ের ধুলো আমার মাথায় দাও—আমার মন স্থির হয়ে যাবে। জয় গুরু, জয় গুরু, জয় গুরু, জয় গুরু,। ত্বমেব শরণং মম, ত্বমেব শরণং মম, (তুমিই আমার শরণ, তুমিই আমার শরণ)। এখন মন স্থির আছে বলে রাখি। এই চিরকালের মনের ভাব। এ ছাড়া যেগুলো আসে, সেগুলো রোগ জানবে। আর আমায় কাজ করতে একদম দিও না। আমি এখন চুপ করে ধ্যান জপ করব কিছুকাল—এই মাত্র। তারপর মা জানেন। জয় জগদম্বে!

বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৫৬
১৭১৯ টার্ক ষ্ট্রীট
সান ফ্রান্সিস্কো
১২ মার্চ, ১৯০০
প্রিয় ধীরামাতা,
কেম্ব্রিজ থেকে লেখা আপনার পত্রখানি কাল এসেছিল। এখন আপনার একটা স্থায়ী ঠিকানা হয়েছে—১৭১৯ টার্ক ষ্ট্রীট, সান ফ্রান্সিস্কো। আশা করি এই পত্রের উত্তরে দু লাইন লেখবার সময় পাবেন।

আপনার প্রেরিত এক পাণ্ডুলিপি আমি পেয়েছি। আপনার ইচ্ছা অনুসারে আমি সেটি ফেরত পাঠিয়েছি। এ ছাড়া আমার কাছে আর কোন হিসাব নেই। সব ঠিকই আছে। লণ্ডন থেকে মিস সুটার আমায় একখানি চমৎকার চিঠি লিখেছেন। তিনি আশা করেছেন যে, মিঃ ট্রাইন তাঁর সঙ্গে নৈশ আহারে যোগ দেবেন।

নিবেদিতার অর্থ-সংগ্রহের সাফল্যের সংবাদে আমি যার-পর-নাই খুশী হয়েছি। আমি তাকে আপনার হাতে সঁপে দিয়েছি এবং নিশ্চিত জানি যে, আপনি তার দেখাশুনা করবেন। আমি এখানে আরও কয়েক সপ্তাহ আছি; তার পরেই পূর্বাঞ্চলে যাব। শুধু গরমকালের অপেক্ষায় আছি।

টাকাকড়ির দিক্‌ দিয়ে এখানে মোটেই সফল হইনি; কিন্তু অভাবও নেই। যা হোক, বরাবরের মত আমার দিনগুলি এক-রকম চলে যাবেই; আর যদি না চলে, তাতেই বা কি? আমি সম্পূর্ণ গা ভাসিয়ে দিয়েছি।

মঠ থেকে একখানি চিঠি পেয়েছি। কাল তাদের উৎসব হয়ে গেল। আমি প্রশান্ত মহাসাগরের পথে যেতে চাই না। কোথায় যাব বা কখন যাব—এ বিষয়ে আমি মোটেই ভাবি না। আমি সম্পূর্ণ গা ভাসিয়ে দিয়েছি—মা-ই সব জানেন। আমার ভেতরে একটা বড় রকম পরিবর্তন আসছে—আমার মন শান্তিতে ভরে যাচ্ছে। আমি জানি, মা-ই সব ভার নেবেন। আমি সন্ন্যাসিরূপেই মৃত্যুবরণ করব। আপনি আমার ও আমার আত্মীয়দের জন্য মায়ের চেযেও বেশী করেছেন। আপনি আমার অসীম ভালবাসা জানবেন আর আপনার চিরমঙ্গল হোক—বিবেকানন্দের এই সতত প্রার্থনা।

দয়া করে মিসেস লেগেটকে বলবেন যে, কয়েক সপ্তাহের জন্য আমার ঠিকানা হবে—-১৭১৯ টার্ক ষ্ট্রীট, সান ফ্রান্সিস্কো।
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৫৭
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

১৭১৯ টার্ক ষ্ট্রীট, সান ফ্রান্সিস্কো
১২ মার্চ, ১৯০০
প্রিয় মেরী,
কেমন আছ? মা কেমন, ভগিনীরা কেমন? চিকাগোর হালচাল কি রকম? আমি ফ্রিস্কোতে১৮ আছি, মাসখানেকের মত এখানে থাকব। এপ্রিলের প্রথম দিকে চিকাগোয় যাব। অবশ্য তার আগে তোমাকে লিখে জানাব। তোমাদের সঙ্গে কয়েকদিন কাটাতে খুবই ইচ্ছা, এত কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যেতে হয়। আমার স্বাস্থ্য একপ্রকার, কিন্তু মন খুব শান্ত, কিছুদিন থেকে তাই আছে। যাবতীয় দুশ্চিন্তার ভার প্রভুর কাছে সমর্পণ করে দিতে চেষ্টা করছি। আমি শুধু কর্মী বৈ তো নয়। আদেশমত কাজ করে যাওয়াই আমার জীবনের উদ্দেশ্য। বাকী তিনিই জানেন।

‘সব কাজ কর্ম কর্তব্যধর্ম ত্যাগ করে আমার শরণাগত হও, আমি তোমাকে সর্ববিধ পাপ থেকে উদ্ধার করব। দুঃখ কর না।’ (গীতা—১৮।৬৬)

সেটা উপলব্ধি করার জন্য আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি। শীঘ্রই যেন তা করতে পারি।

সতত তোমার স্নহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৫৮
[মিসেস লেগেটকে লিখিত]
১৭১৯ টার্ক ষ্ট্রীট, 
সান ফ্রান্সিস্কো
১৭ মার্চ, ১৯০০
মা,
আপনার সুন্দর চিঠিখানা পেয়ে খুবই আনন্দিত হলাম। হ্যাঁ, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, বন্ধুদের সঙ্গে আমি সংযোগ রক্ষা করে যাচ্ছি। তা সত্ত্বেও বিলম্বের ক্ষেত্রে কখনও কখনও বিচলত হই।

ডাঃ হিলার ও মিসেস হিলার (Dr. and Mrs. Hiller) শহরে ফিরে এসেছেন; মিসেস মিল্টনের (Mrs. Milton) চিকিৎসায় তাঁরা উপকৃত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। আমার বেলায় (তাঁরা চিকিৎসায়) বুকে অনেকগুলি বড় বড় লাল লাল দাগ ফুটে উঠেছে। আরোগ্যের ব্যাপারে কতদূর কি হয়, পরে বিস্তারিত আপনাকে জানাব। অবশ্য আমার রোগটা এমনই যে আপনা থেকে পূর্বাবস্থায় ফিরতে অনেক সময় লাগবে।

আপনি এবং মিসেস এডাম‍্স্ যে সহৃদয়তা দেখিয়েছেন, তার জন্য আমি খুবই কৃতজ্ঞ। চিকাগোয় গিয়ে নিশ্চয় তাঁদের সঙ্গে দেখা করে আসব।

আপনার সব ব্যাপার কিরকম চলছে? এখানে আমি চুপচাপ সহ্য করার নীতি অবলম্বন করে যাচ্ছি, এ পর্যন্ত ফল মন্দ হয়নি।

তিন বোনের মেজোটি মিসেস হ্যান‍্স‍্‍বরো (Mrs. Hansborough) এখন এখানে। সে আমাকে সাহায্য করবার জন্য অবিরাম কাজ করে চলেছে। প্রভু তাদের হৃদয় আশীর্বাদে ভরিয়ে দিন। তিনটি বোন যেন তিনটি দেবী! আহা, তাই নয় কি? এখানে ওখানে এ-ধরনের আত্মার সংস্পর্শ পাওয়া যায় বলেই জীবনের সকল অর্থহীনতার ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়।

আপনাদের উপর চির আশীর্বাদের জন্য প্রার্থনা। এও বলি, আপনিও একজন স্বর্গের দেবী। মিস কেটকে (Miss Kate) আমার ভালবাসা।

আপনার চিরসন্তান
বিবেকানন্দ

পুনঃ—‘মায়ের সন্তানটি’ কেমন!

মিস স্পেন্সার কেমন আছেন? তাঁকে সর্ববিধ ভালবাসা। ইতোমধ্যে আপনি বুঝতে পেরেছেন যে, আমি মোটেই ভাল চিঠি-লিখিয়ে নই—কিন্তু হৃদয় ঠিক আছে। মিস স্পেন্সারকে এ কথা জানাবেন।

বি
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৫৯
[মিসেস লেগেটকে লিখিত]
১৭১৯ টার্ক ষ্ট্রীট, 
সান ফ্রান্সিস্কো
১৭ মার্চ, ১৯০০
মা,
জো-র একটি চিঠি পেলাম; সে আমাকে চার-টুকরো কাগজ স্বাক্ষর করে পাঠাতে লিখেছে, যাতে আমার হয়ে মিঃ লেগেট আমার টাকা ব্যাঙ্কে জমা রাখতে পারেন। তার কাছে যথাসময়ে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয় বলে, কাগজগুলি আপনার কাছে পাঠালাম।

আমার স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে, কিছু কিছু টাকাপয়সাও হচ্ছে। বেশ সন্তুষ্ট আছি। আপনার আবেদনে যে আরও বেশী লোক সাড়া দেয়নি, তার জন্য আমি মোটেই দুঃখিত নই। জানতাম, তারা সাড়া দেবে না। কিন্তু আপনার সহৃদয়তার জন্য আমি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব। আমার শুভেচ্ছা চিরকাল আপনাদের ঘিরে থাকুক।

আমার নামে চিঠিপত্র—১২৩১ নং পাইন ষ্ট্রীটে ‘হোম অব্ ট্রুথ’ (Home of Truth)-এর ঠিকানায় পাঠালে ভাল হয়। আমি ঘুড়ে বেড়ালেও সেটি একটি স্থায়ী আস্তানা, এবং সেখানকার লোকেরা আমার প্রতি সদয়।

আপনি এখন এখন খুব ভাল আছেন জেনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। মিসেস ব্লজেট জানিয়েছেন যে, মিসেস মিল্টন লস্ এঞ্জেলেস্ ছেড়ে চলে গিয়েছেন! তিনি নিউ ইয়র্কে গিয়েছেন কি? ডক্টর হিলার ও মিসেস হিলার গত পরশু সান ফ্রান্সিস্কো ফিরে এসেছেন; তাঁরা বলেছেন, মিসেস মিল্টনের চিকিৎসায় তাঁরা খুবই উপকৃত হয়েছেন। মিসেস হিলার অল্পদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভের আশা করছেন।

এখানে এবং ওকল্যাণ্ডে ইতোমধ্যে অনেকগুলি বক্তৃতা দিয়েছি। ওকল্যাণ্ডে বক্তৃতাগুলি ভাল টাকাই পাওয়া গেছে। সান ফ্রান্সিস্কোয় প্রথম সপ্তাহে কিছু পাওয়া যায়নি, এ সপ্তাহে পাওয়া যাচ্ছে। আগামী সপ্তাহেও কিছু আশা আছে। বেদান্ত সোসাইটির জন্য মিঃ লেগেট চমৎকার ব্যবস্থা করেছেন জেনে আমি খুবই আনন্দিত। সত্যি তিনি এত সহৃদয়।

আপনার
বিবেকানন্দ

পুঃ—তুরীয়ানন্দের বিষয় আপনি কিছু জানেন কি? সে কি সম্পূর্ণ নিরাময় হয়েছে?

বি
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৬০
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
১৭১৯ টার্ক ষ্ট্রীট, 
সান ফ্রান্সিস্কো
২২ মার্চ, ১৯০০

প্রিয় মেরী,
তোমার সহৃদয় চিঠির জন্য অশেষ ধন্যবাদ। তুমি ঠিকই বলছ য়ে, ভারতবাসীদের বিষয় ছাড়া আমার আরও অনেক কিছু চিন্তা করবার আছে, কিন্তু গুরুদেবের কাজই আমার জীবনের প্রধান কর্তব্য, তার তুলনায় ঐ-সবই গৌণ!

এই আত্মত্যাগ যদি সুখকর হত! তা হয় না, ফলে স্বভাবতই কখনও কখনও মনে তিক্ততা আসে; কিন্তু জেনো মেরী, আমি এখনও মানুষই আছি এবং নিজের সব কিছু একেবারে ভুলে যেতে পারি না; আশা করি, একদিন তা পারব। আমার জন্য প্রার্থনা কর।

আমার বিষয়ে বা অন্য বিষয়ে মিস ম্যাকলাউড বা মিস নোবল্ বা অন্য কারও মতামতের জন্য আমি অবশ্যই দায়ী হতে পারি না। পারি কি? কেউ সমালোচনা করলে তুমি কখনই আমাকে বেদনা অনুভব করতে দেখনি।

দীর্ঘকালের জন্য তুমি ইওরোপে যাচ্ছ জেনে আনন্দিত হলাম। লম্বা পাড়ি দাও— অনেকদিন তো পোষা পায়রার মত কাটালে।

আর আমার কথা যদি বল, আমি এই অবিরাম ঘোরাঘুরিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, তাই ঘরে ফিরে শান্তিতে কাটাতে চাই। আর কাজ করতে চাই না। জ্ঞানতপস্বীর মত নির্জনে জীবন যাপন করাই আমার স্বভাব। সে অবসর কখনও জুটল না! প্রার্থনা করি, এবার তা যেন পাই। এখন আমি ভগ্নস্বাস্থ্য, কর্মক্লান্ত! হিমালয়ের আশ্রম থেকে যখনই মিসেস সেভিয়ারের কোন চিঠি পাই, তখনই ইচ্ছা হয়—যেন সেখানে উড়ে চলে যাই। প্রতিনিয়ত প্ল্যাটফর্মে বক্তৃতা করে, অবিরত ঘুরে বেড়িয়ে আর নিত্যনূতন মুখ দেখে দেখে আমি একেবারে ক্লান্ত।

চিকাগোতে ক্লাস করার ব্যাপার নিয়ে তোমার মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই। ফ্রিস্কোতে টাকা পাচ্ছি এবং শীঘ্রই দেশে ফেরার টাকা যোগাড় করে উঠতে পারব।

তুমি ও অন্যান্য ভগিনীরা কেমন আছ? এপ্রিলের প্রথম দিকে কোন সময়ে চিকাগোয় যাব—আশা করি।

তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা (৪৬১-৪৭০)

পত্র সংখ্যা (৪৬১-৪৭০)

পত্র সংখ্যা - ৪৬১
সান ফ্রান্সিস্কো
২৫ মার্চ, ১৯০০
কল্যাণীয়া নিবেদিতা,
আমি আগের চেয়ে অনেক ভাল আছি এবং ক্রমশঃ বল পাচ্ছি। এখানে মাঝে মাঝে মনে হয়, খুব শীঘ্রই যেন মুক্তি পাব। গত দু-বছরের যন্ত্রণারাশি আমাকে প্রভূত শিক্ষা দিয়েছে। ব্যাধি ও দুর্ভাগ্য পরিণামে আমাদের কল্যাণই সাধন করে, যদিও তখনকার জন্য মনে হয়, বুঝি আমরা একেবারে ডুবে গেলাম।

আমি যেন ঐ অসীম নীলাকাশ; মাঝে মাঝে সে আকাশে মেঘ পুঞ্জীভূত হলেও আমি সর্বদা সেই অসীম নীল আকাশই রয়েছি।

আমি এখন সেই শাশ্বত শান্তির আস্বাদের জন্য লালায়িত, যা আমার এবং প্রত্যেক জীবের ভিতরে চিরদিন রয়েছে। এই হাড়মাসের খাঁচা এবং সুখদুঃখের মিথ্যা স্বপ্ন—এগুলি আবার কি? আমার স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে। ওঁ তৎ সৎ।

তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৬২

১৭১৯ টার্ক ষ্ট্রীট, সান ফ্রান্সিস্কো
২৮মার্চ, ১৯০০
নিবেদিতা,
আমি তোমার সৌভাগ্যে খুব আনন্দিত হলাম। আমরা যদি লেগে থাকি, তবে অবস্থা ফিরবেই ফিরবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোমার যত টাকার দরকার, তা এখানে বা ইংলণ্ডে পাবে।

আমি খুব খাটছি—আর যত বেশী খাটছি, ততই ভাল বোধ করছি। শরীর খুব অসুস্থ হয়ে আমার একটা বিশেষ উপকার হয়েছে, নিশ্চয়। আমি এখন ঠিক ঠিক বুঝতে পারছি, অনাসক্তি মানে কি; আর আমার আশা—অতি শীঘ্রই আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হব।

আমরা আমাদের সমুদয় শক্তি একদিকে প্রয়োগ করে একটা বিষয়ে আসক্ত হয়ে পড়ি; আর এই ব্যাপারেরই আর যে একটা দিক্‌ আছে, যেটা সমভাবে কঠিন হলেও সেটির দিকে আমরা খুব কমই মনোযোগ দিয়ে থাকি; সেটি হচ্ছে, মুহূর্তের মধ্যে কোন বিষয় থেকে অনাসক্ত হবার—নিজেকে আলগা করে নেবার শক্তি। এই আসক্তি ও অনাসক্তি— দুই-ই যখন পূর্ণভাবে বিকশিত হয়ে ওঠে, তখন মানুষ মহৎ ও সুখী হয়।

আমি মিসেস লেগেটের ১০০০ ডলার দানের সংবাদ পেয়ে বড়ই সুখী হলাম। সবুর কর, তাঁর ভিতর দিয়ে যা কাজ হবার, সেইটা এখন প্রকাশ হচ্ছে। তিনি জানুন আর নাই জানুন, রামকৃষ্ণের কাজে তাঁকে এক মহৎ অংশ গ্রহণ করতে হবে।

তুমি অধ্যাপক গেডিসের যে বিবরণ লিখেছ, তা পড়ে খুব আনন্দ পেলাম। জো-ও একজন অলৌকিকদৃষ্টিসম্পন্ন (clairvoyant) লোকের সম্বন্ধে বড় মজার বিবরণ লিখেছে।

সব বিষয় এখন আমাদের অনুকূল হতে শুরু করেছে। আমি যে অর্থ সংগ্রহ করছি, তা যথেষ্ট না হলেও উপস্থিত কাজের পক্ষে মন্দ নয়।

আমার মনে হয়, এ পত্রখানি তুমি চিকাগোয় পাবে। ইতোমধ্যে জো ও মিসেস বুল নিশ্চয়ই যাত্রা করেছেন।১৯ জো-এর চিঠি ও টেলিগ্রামে তাদের আসার দিন সম্বন্ধে এত গরমিল ছিল যে, তা পড়ে বেশ একটু ফাঁপরে পড়েছিলাম।

মিস সুটার-এর বিশেষ বন্ধু সুইস যুবক ম্যাক্স গেসিক-এর কাছ থেকে একখানি সুন্দর চিঠি পেয়েছি। মিস সুটারও আমায় তাঁর ভালবাসা জানিয়েছেন, আর তাঁরা আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, আমি কবে ইংলণ্ডে যাচ্ছি। তাঁরা লিখেছেন, সেখানে অনেকে ঐ বিষয়ে খবর নিচ্ছে।

সব জিনিষকেই ঘুরে আসতে হবে—বৃক্ষরূপে বিকশিত হতে হলে বীজকে কিছুদিন মাটির নীচে পড়ে পচতে হবে। গত দু-বছর চলছিল যেন এইরূপ মাটির নীচে পচা। মৃত্যুর করালগ্রাসে পড়ে আগেও যখনই আমি ছটফট করেছি, তার পরেই জীবনটা যেন প্রবলভাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। এইরূপে একবার রামকৃষ্ণের কাছে উপনীত হই, আর একবার ঐরূপ হবার পর যুক্তরাষ্ট্রে আসতে হল। শেষটিই হয়েছে অন্য সবগুলির মধ্যে বৃহৎ ব্যাপার। সে-ভাব এখন চলে গেছে—এখন আমি এমন স্থির শান্ত হয়ে গেছি যে আমার সময়ে সময়ে নিজেরই আশ্চর্য বোধ হয়। আমি এখন সকাল সন্ধে খুব খাটি, যখন যা পাই খাই, রাত্রি বারটায় শুতে যাই, আর কি গভীর নিদ্রা! আগে কখনও আমার এমন ঘুমোবার শক্তি ছিল না। তুমি আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি



বিবেকানন্দ

*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৬৩

১৭১৯ টার্ক ষ্ট্রীট,সান ফ্রান্সিস্কো
৩০ মার্চ, ১৯০০

প্রিয় জো,
বইগুলি শীঘ্র পাঠিয়েছ বলে তোমায় অশেষ ধন্যবাদ। আমার বিশ্বাস, এগুলি খুব তাড়াতাড়ি বিক্রী হয়ে যাবে। নিজের পরিকল্পনা বদলানো সম্বন্ধে তুমি দেখছি আমার চেয়েও খারাপ। এখন ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ এল না কেন বুঝতে পাচ্ছি না। আমার আশঙ্কা, আমার ডাকের চিঠিপত্র খুবই ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আমি খুব খাটছি, কিছু টাকা সংগ্রহ করছি, আর স্বাস্থ্যও অপেক্ষাকৃত ভাল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাটুনি; তার পর পেটভরা নৈশভোজনান্তে ১২টায় শয্যাগ্রহণ!—এবং পায়ে হেঁটে সারা শহর বেড়ান! আর সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যের উন্নতি!

মিসেস মিল্টন তাহলে ওখানেই আছেন। তাঁকে আমার ভালবাসা জানাবে। জানাবে তো? তুরীয়ানন্দের পা কি ভাল হয়নি?

মিসেস বুলের ইচ্ছা অনুসারে আমি মার্গর চিঠিগুলি তাঁকে পাঠিয়ে দিয়েছি। মিসেস লেগেটকে কিছু দান করেছেন জেনে বড়ই আনন্দ পেলাম। যেমন করেই হোক সব জিনিষের একটা সুরাহা হতেই হবে—তা হতে বাধ্য, কারণ কোন কিছুই শাশ্বত নয়।

সুবিধা দেখলে এখানে আরও দু-এক সপ্তাহ আছি; তারপর ষ্টকটন নামে একটা কাছাকাছি জায়গায় যাব, তারপর—জানি না। যেমন করেই হোক চলে যাচ্ছে। আমি বেশ শান্তিতে ও নির্ঝঞ্ঝাটে আছি। আর কাজ-কর্ম যেমন চলে থাকে, তেমনই চলে যাচ্ছে। আমার ভালবাসা জানবে। ইতি

বিবেকানন্দ

পুনশ্চঃ—পরিবর্তনাদি সহ ‘কর্মযোগ’ বইখানি সম্পাদনার জন্য মিস ওয়াল্ডোই হচ্ছেন ঠিক লোক।

—বি
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৬৪

১৭১৯ টার্ক ষ্ট্রীট, সান ফ্রান্সিস্কো
এপ্রিল, ১৯০০
প্রিয় জো,
তোমার ফ্রান্স যাত্রার আগে এক ছত্র লিখছি। ইংলণ্ড হযে যাচ্ছ কি? মিসেস সেভিয়ারের কাছ থেকে একখানা সুন্দর চিঠি পেয়েছি।

লস্ এঞ্জেলেস্ থেকে এখানে শারীরিক ভাল নয়, কিন্তু মানসিক অনেক ভাল আছি—সবল ও শান্তিপূর্ণ। আশা করি, এ অবস্থা বজায় থাকবে।

তোমার কাছ থেকে আমার চিঠির উত্তর পাইনি, শীঘ্র পাব আশা করছি। আমার নামে ভারতের একখানা চিঠি ভুল করে মিসেস হুইলারের ঠিকানায় চলে গিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তা আমার কাছে ঠিকমত এসে পৌঁছেছে। সারদানন্দের কাছ থেকে সুন্দর সব বিবরণ পেয়েছি; তারা সেখানে চমৎকার কাজ চালাচ্ছে। ছেলেরা কাজে লেগে গেছে; দেখছ তো, ধমকানির দুটি দিকই আছে, এর ফলে তারা উঠে পড়ে লেগেছে।

আমরা ভারতবাসীরা এত দীর্ঘদিনের জন্য এমনই পরনির্ভরশীল ছিলাম যে, দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, তাদের সক্রিয় করে তুলতে হলে বেশ কিছু কড়া কথার দরকার। এক জন কুঁড়ের শিরোমণি এ বছরের জন্মতিথি উৎসবের ভার নিয়েছিল, এবং সে ভালভাবেই তা সম্পন্ন করেছে। আমার সাহায্য ছাড়াই—তারা নিজেরাই দুর্ভিক্ষে সেবার পরিকল্পনা করেছে এবং সাফল্যের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

তারা নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়েছে। তা দেখে আমি সত্যি খুশী! দেখ জো, মা-ই কাজ করছেন।

মিস থার্সবির (Miss Thursby) চিঠি আমি মিসেস হার্স্টকে (Mrs. Hearst) পাঠিয়ে দিয়েছি। তাঁর গানের আসরে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আমি যেতে পারিনি। বিশ্রী ঠাণ্ডা লেগেছিল। এই হল ব্যাপার।

জানি না, চিকাগো যাবার ভাড়া ফ্রিস্কোতে তুলতে পারব কিনা। ওকল্যাণ্ডের কাজ সফল হয়েছে। ওখান থেকে ১০০ ডলার পাব, ব্যস। যাই হোক, আমি সন্তুষ্ট। আমি যে চেষ্টা করেছি, সেইটাই বড় কথা।

চৌম্বক চিকিৎসা আমার কিছু করতে পারল না। যাই হোক, আমার চলে যাবে। কিভাবে যাবে তা নিয়ে ব্যস্ত নই। … খুব শান্তিতে আছি। লস্ এঞ্জেলেস্ থেকে খবর পেলাম যে, মিসেস লেগেট আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এটা কতটা সত্য, তা জানবার জন্য নিউ ইয়র্কে ‘তার’ করেছি। শীঘ্র উত্তর পাব, আশা করি।

আচ্ছা, যখন লেগেটরা ও-পারে (ইওরোপে) চলে যাবেন, তখন আমার চিঠিপত্রের কি ব্যবস্থা হবে? সেগুলি ঠিকমত আমার কাছে পৌঁছবে, এমন ব্যবস্থা হবে তো?

আর কিছু লেখবার নেই, তোমাদের জন্য ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা, সে তো তুমি জানই। আমি যতটুকুর উপযুক্ত, তার চেয়ে তুমি অনেক বেশী করেছ। প্যারিসে যেতে পারব কিনা জানি না, কিন্তু মে মাসে ইংলণ্ডে অবশ্যই যাব। আর কয়েক সপ্তাহ ইংলণ্ডকে পরখ না করে দেশে ফিরছি না। ভালবাসা জেনো।

সতত প্রভুসমীপে তোমার
বিবেকানন্দ

পুনঃ—মিসেস হ্যান‍্স‍্‍বরো (Hansborough) এবং মিসেস এপেনুল (Mrs. Appenul) ১৭১৯ নং টার্ক ষ্ট্রীটে এ মাসের জন্য একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে আছি এবং কয়েক সপ্তাহ থাকব।

—বি
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৬৫

১৭১৯ টার্ক ষ্ট্রীট
সান ফ্রান্সিস্কো
১ এপ্রিল, ১৯০০

প্রিয় ধীরামাতা,
আপনার স্নেহপূর্ণ চিঠিখানি আজ সকালে পেলাম। নিউ ইয়র্কের সব বন্ধুরা মিসেস মিল্টনের (হাতঘষা) চিকিৎসায় আরোগ্য হচ্ছেন জেনে ভারি আনন্দ হল। লস্ এঞ্জেলেসে তিনি খুবই বিফল হয়েছিলেন বলে মনে হয়; কারণ আমরা যাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম, তারা সবাই আমাকে তাই বলেছে। অনেকে হাত ঘষার আগে যা ছিলেন, তার চেযেও খারাপ বোধ করছেন। মিসেস মিল্টনকে আমার ভালবাসা জানাবেন। তাঁর চিকিৎসায় আমি অন্ততঃ সাময়িক উপকার পেতাম। বেচারা ডাক্তার হিলার! আমরা তাঁকে তড়িঘড়ি লস্ এঞ্জেলেসে পাঠিয়েছিলাম—তাঁর স্ত্রীকে আরাম করার জন্য। সেদিন সকালে তাঁর সঙ্গে আপনার দেখা ও আলাপ হলে বেশ হত। সমস্ত ডলাই-মলাইয়ের পরে মিসেস হিলারের অবস্থা মনে হচ্ছে, আগের চেয়ে বেশী খারাপ হয়ে গেছে—তার হাড় ক-খানি সার হয়েছে, তা ছাড়া ডাক্তার হিলারকে লস্ এঞ্জেলেসে ৫০০ ডলার খরচ করতে হয়েছে, আর তাতে তাঁর মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। আমি অবশ্য জো-কে এত সব লিখতে চাই না। গরীব রোগীদের যে এতখানি সাহায্য করতে পারছে, এই কল্পনায় সে মশগুল। কিন্তু হায়! সে যদি লস্ এঞ্জেলেসের লোকদের ও এই বুড়ো ডাক্তার হিলারের মত শুনতে পেত, তবে সে সেই পুরানো কথার মর্ম বুঝতে পারত যে, কারও জন্য দাওয়াই বাতলাতে নেই। ডাক্তার হিলারকে এখান থেকে লস্ এঞ্জেলেসে পাঠানোর দলে যে আমি ছিলাম না, এই ভেবে আমি খুশী। জো আমাকে লিখেছে যে, তার কাছ থেকে এই রোগ-আরামের খবর পেয়েই ডাক্তার হিলার সাগ্রহে লস্ এঞ্জেলেসে যাবার জন্য তৈরী হয়েছিলেন। সে বুড়ো ভদ্রলোক আমার ঘরে সাগ্রহে যেমন লাফিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, তা দেখাও জো-র উচিত ছিল। ৫০০ ডলার খরচ বুড়োর পক্ষে বড় বেশী হয়ে গেছে। তিনি জার্মান—লাফিয়ে বেড়ান, নিজের পকেট চাপড়ান আর বলেন, এই চিকিৎসার বোকামি না হলে আপনিই তো ৫০০ ডলার পেতে পারতেন? এ ছাড়া গরীব রোগীরা তো সব আছেই—যারা ডলাই-মলাইয়ের জন্য কখনও বা প্রত্যেকে ৩ ডলার খরচ করেছে, আর এখন জো-ও আমাকে বাহবা দিচ্ছে! জো-কে এ কথা বলবেন না। তার ও আপনার যে-কোন লোকের জন্য টাকা খরচ করবার যথেষ্ট সংস্থান রয়েছে। জার্মান ডাক্তারের সম্বন্ধেও তাই বলা চলে। কিন্তু নিরীহ গরীব বেচারাদের পক্ষে এটা বড় কঠিন ব্যাপার। বুড়ো ডাক্তারের এখন বিশ্বাস জন্মেছে যে, সম্প্রতি কতকগুলো ভূত-প্রেত মিলে তাঁর সাংসারিক ব্যাপার সব লণ্ড-ভণ্ড করে দিচ্ছে। তিনি আমাকে অতিথিরূপে রেখে এর একটা প্রতিকারের ও তাঁর স্ত্রীর আরোগ্যের খুব আশা করেছিলেন; কিন্তু তাঁকে দৌড় করতে হল লস্ এঞ্জেলেসে, আর তার ফলে সব ওলট-পালট হয়ে গেল। আর এখন যদিও তিনি আমাকে তাঁর অতিথিরূপে পাবার জন্য খুবই চেষ্টা করছেন, আমি কিন্তু পাশ কাটিয়ে চলেছি—ঠিক তাঁর কাছ থেকে নয়, তাঁর স্ত্রী ও শ্যালিকার কাছ থেকে। তাঁর নিশ্চিত ধারণা যে, এ-সব ভূতুড়ে ব্যাপার! তিনি থিওসফি আলোচনা করে থাকেন। আমি তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, মিস ম্যাকলাউডকে লিখে দিতে—কোথাও থেকে তাঁর জন্য একটি ভূতের ওঝা যোগাড় করতে, যাতে তিনি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে সেখানে ছুটে গিয়ে আবার ৫০০ ডলার খরচ করতে পারেন!

অন্যের মঙ্গল করা সব সময় নির্ঝঞ্ঝাট নয়।

আমার নিজের কথা বলতে গেলে, জো যতক্ষণ খরচ যোগায়, আমি ততক্ষণ মজা পেতে রাজী আছি—হাড়-মটকানো বা ডলাই-মলাইওয়ালা—যাদের কাছেই হোক না কেন! কিন্তু ডলাই-মলাই করবার জন্য এ-সব লোককে যোগাড় করে পালিয়ে যাওয়া এবং সব প্রশংসার বোঝাটা আমার ঘাড়ে তুলে দেওয়া—এ কাজটা জো-র ভাল হয়নি! সে যে বাইরের কাউকে ডলাই-মলাইয়ের জন্য নিয়ে আসছে না—এতে আমি খুশী আছি। তা না হলে জো-কে প্যারিসে চলে যেতে হত, আর মিসেস লেগেটকে সব প্রশংসা কুড়াবার ভার নিতে হত। আমি জো-র ত্রুটি সংশোধনের জন্য ডাক্তার হিলারের কাছে একজন ক্রিশ্চান সায়ান্সপন্থী (অর্থাৎ মনোবলের সাহায্যে) রোগনিরাময়কারীকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম; কিন্তু তাঁর স্ত্রী তাঁকে দেখেই দরজা বন্ধ করে দিলেন—এবং জানিয়ে দিলেন যে, এ সব অদ্ভুত চিকিৎসার সঙ্গে তিনি কোন সম্পর্ক রাখবেন না। যাই হোক, আমি বিশ্বাস করি ও সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করি, এবার মিসেস লেগেট সেরে উঠুন। তাঁর কামড়টা কিসের, তা কি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে?

আমি আশা করি, উইলখানি তাড়াতাড়িই আসবে; ও-বিষয়ে আমি একটু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। আমি আশা করেছিলাম, ভারত থেকে ট্রাষ্টের একখানি খসড়াও এই ডাকেই আসবে। কিন্তু কিছু আসেনি; এমন কি ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ও আসেনি—যদিও তা সান ফ্রান্সিস্কোতে পৌঁছে গেছে, দেখতে পাচ্ছি।

সেদিন কাগজে পড়লাম, কলিকাতায় এক সপ্তাহে ৫০০ লোক প্লেগে মরেছে! মা-ই জানেন কিসে মঙ্গল হবে।

মিঃ লেগেট দেখছি বেদান্ত সমিতিটাকে চালু করে দিয়েছেন। চমৎকার!

ওলিয়া কেমন আছে? নিবেদিতা কোথায়? সেদিন আমি তাকে 21 W. 34 (st), N. Y.—এই ঠিকানায় একখানি পত্র লিখেছি। সে কাজে এগিয়ে চলেছে দেখে আমি খুব খুশী। আমার আন্তরিক ভালবাসা জানবেন।

আপনার চিরসন্তান
বিবেকানন্দ

পুনঃ—আমার পক্ষে যতটা কাজ করা সম্ভব, ততটা বা তার চেয়েও বেশী কাজ পাচ্ছি। যেমন করেই হোক, আমি আমার পথের খরচ যোগাড় করব। ওরা আমায় বেশী দিতে না পারলেও কিছু কিছু দেয়। অবিরাম পরিশ্রম করে কোন রকমে আমি আমার পাথেয় যোগাড় করতে পারব, বাড়তিও কয়েক শত কিছু পাব। সুতরাং আপনি আমার জন্য মোটেই চিন্তিত হবেন না।

—বি
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৬৬

সান ফ্রান্সিস্কো
৬ এপ্রিল, ১৯০০
কল্যাণীয়া নিবেদিতা,
শুনে সুখী হলাম, তুমি ফিরেছ—আরও সুখী হলাম, তুমি প্যারিসে যাচ্ছ শুনে। আমি অবশ্য প্যারিসে যাব, তবে কবে জানি না।

মিসেস লেগেট বলেছেন, আমার এখনই রওনা হওয়া উচিত ও ফরাসী ভাষা শিখতে লেগে যাওয়া উচিত। আমি বলি, যা হবার হবে—সুতরাং তুমি তাই কর।

তোমার বইখানা শেষ করে ফেল ও তারপর আমরা প্যারিসে ফরাসীদের জয় করতে যাচ্ছি। মেরী কেমন আছে? তাকে আমার ভালবাসা জানাবে। আমার এখানকার কাজ শেষ হয়ে গেছে। মেরী ওখানে থাকলে আমি দিন পনরর ভেতরে চিকাগোয় যাচ্ছি; মেরী শীঘ্রই পূর্বাঞ্চলে যাচ্ছে। ইতি

আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ

মন সর্বব্যাপী। যে কোন স্থান থেকে এর স্পন্দন শোনা যেতে পারে এবং অনুভব করা যেতে পারে।

—বি
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৬৭
[জনৈক আমেরিকান বন্ধুকে লিখিত]
সান ফ্রান্সিস্কো
৭ এপ্রিল, ১৯০০
কিন্তু এখন আমি এত স্থির ও প্রশান্ত হয়ে গেছি, আগে কখনও এমনটি ছিলাম না। আমি এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মহানন্দে খুব খাটছি। কর্মেই আমার অধিকার, বাকী মা জানেন।

দেখ, এখানে যতদিন থাকব বলে মনে করেছিলাম, তার চেয়ে বেশী দিন থেকে কাজ করতে হবে দেখছি। সেজন্য বিচলিত হয়ো না; আমার সব সমস্যার সমাধান আমিই করব। আমি এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি, আলোও দেখতে পাচ্ছি। হয়তো সফলতা আমাকে বিপথগামী করত এবং আমি যে সন্ন্যাসী—এই সত্যটাই হয়তো মনে রাখতে পারতাম না। তাই ‘মা’ আমাকে এই অভিজ্ঞতা দিচ্ছেন।

আমার তরী ক্রমশঃ সেই শান্তির বন্দরের নিকটবর্তী হচ্ছে, যেখান থেকে সে আর বিতাড়িত হবে না। জয়, জয় মা! আর আমার নিজের কোন আকাঙ্ক্ষা বা উচ্চাভিলাষ নাই। মায়ের নাম ধন্য হউক। আমি শ্রীরামকৃষ্ণের দাস। আমি যন্ত্র মাত্র—আর কিছু জানি না, জানবার আকাঙ্ক্ষাও নেই। ‘ওয়া গুরুজী কী ফতে।’ জয়, শ্রীগুরুমহারাজজী কী জয়।
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৬৮
[মিসেস লেগেটকে লিখিত]
১৭১৯ টার্ক ষ্ট্রীট, সান ফ্রান্সিস্কো
৭ এপ্রিল, ১৯০০
মা,
ক্ষতের কারণ সম্পূর্ণ দূর হয়েছে, এই খবর পেয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছি। এবার যে আপনি সম্পূর্ণ সেরে উঠবেন, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।

আপনার অত্যন্ত সহৃদয় পত্রখানিতে খুব উৎসাহ পেয়েছি। আমায় সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে এল কিনা এল, তা নিয়ে আমি কিছু মনে করি না। ধীরে ধীরে শান্ত ও উদ্বেগশূন্য হয়ে উঠছি।

মিসেস মিল্টনকে দয়া করে আমার আন্তরিক প্রীতি জানাবেন। শেষ পর্যন্ত আমি নিশ্চয়ই সেরে উঠব। মূলতঃ আমার স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে, যদিও মাঝে মাঝে রোগের পুনরাক্রমণ ঘটে। তবে আক্রমণগুলি স্বল্পকালস্থায়ী—তীব্রতাও কম।

তুরীয়ানন্দকে ও সিরিকে (Siri) চিকিৎসা করানো আপনার পক্ষে উপযুক্তই হয়েছে। আপনার মহৎ হৃদয়ের জন্য ঈশ্বর আপনাকে আশীর্বাদ করেছেন। সর্ববিধ আশীর্বাদ নিরন্তর আপনাকে ঘিরে থাকুক।

ফ্রান্সে গিয়ে ফরাসীদের মধ্যে কাজ করা যে উচিত, তা খুবই সত্যি। জুলাই মাসে বা তার আগেই ফ্রান্সে পৌঁছবার আশা করছি। ‘মা’-ই জানেন। সর্বকল্যাণ আপনি লাভ করুন—আপনার সন্তান বিবেকানন্দের নিরন্তর এই প্রার্থনা।
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৬৯

১৭১৯ টার্ক ষ্ট্রীট, সান ফ্রান্সিস্কো
৮ এপ্রিল, ১৯০০

প্রিয় ধীরামাতা,
এই সঙ্গে অভেদানন্দের একখানি সুদীর্ঘ চিঠি পাঠালাম। … সে আমার আদেশের অপেক্ষা করছে। আমি তাকে বলেছি যে, সে যেন সব বিষয়ে আপনাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে এবং আমি না আসা পর্যন্ত নিউ ইয়র্কে থাকে।

আমার বোধ হয়, নিউ ইয়র্কের বর্তমান পরিস্থিতিতে ওরা আমাকে ওখানে চায়; আপনিও কি তাই মনে করেন? তা হলে শীঘ্রই আসব। আমার পাথেয়ের জন্য যথেষ্ট টাকা সংগ্রহ করছি। পথে চিকাগো ও ডেট্রয়েটে নামব। অবশ্য ততদিনে আপনিও চলে যাবেন।

অভেদানন্দ এ-যাবৎ ভাল কাজ করছে; আর আপনি তো জানেন, আমি আমার কর্মীদের কাজে মোটেই হস্তক্ষেপ করি না। যে কাজের লোক, তার একটা নিজস্ব ধারা থাকে এবং তাতে কেউ হাত দিতে গেলে সে বাধা দেয়। তাই আমি আমার কর্মীদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিই। অবশ্য আপনি কার্যক্ষেত্রেই রয়েছেন এবং সব জানেন। কি করা উচিত, এ বিষয়ে আমায় উপদেশ দেবেন।

কলিকাতায় প্রেরিত টাকা যথাসময়ে পৌঁছেছে।

আমি ক্রমশঃ সুস্থ হচ্ছি, এমন কি পাহাড়-চড়াইও করতে পারি। মাঝে মাঝে স্বাস্থ্য খারাপ হয়, কিন্তু অসুস্থতার স্থিতিকাল ক্রমশই কমে আসছে। মিসেস মিল্টনকে আমার ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

সিরি গ্রানেণ্ডার একখানি ছোট্ট চিঠি লিখেছে। তাকে বিশ্বাস করেছি দেখে বালিকাটি খুব কৃতজ্ঞ—ঠিক যেন মিসেস লেগেটের মত! চমৎকার, ভাল হাতে পড়লে টাকা জিনিষটা তেমন খারাপ নয়। আমি খুবই আশা করি যে, সিরি সম্পূর্ণ সেরে উঠুক—বেচারী!

প্রায় দুই সপ্তাহের মধ্যে এ জায়গা ছাড়ব। প্রথমে ষ্টার ক্লোন্ নামে একটা জায়গায় যাব এবং তার পরে পূর্বাঞ্চচলে যাত্রা করব। হয়তো ডেনভারেও যাব।

জো-কে আন্তরিক ভালবাসা জানাচ্ছি। ইতি

আপনার চিরন্তন
বিবেকানন্দ

পুনঃ—শেষ পর্যন্ত আমি আমি সেরে উঠব, এ বিষয়ে আমার আর সন্দেহ নেই। আমি ষ্টীম ইঞ্জিনের মত কেমন কাজ করে চলেছে—রাঁধছি, যা খুশী খাচ্ছি এবং তা সত্ত্বেও বেশ ঘুমুচ্ছি এবং ভাল আছি—এ আপনার দেখা উচিত ছিল!

আমি কিছু লিখিনি এ-যাবৎ, কারণ সময় নেই। মিসেস লেগেট ভাল হয়েছেন এবং স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করছেন জেনে আনন্দ হল। তিনি শীঘ্র নিরাময় হউন—এই আমার আশা ও প্রার্থনা। ইতি

পুনঃ—মিসেস সেভিয়ারের একখানি সুন্দর পত্রে জানলাম যে তাঁরা বেশ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কলিকাতায় ভয়ানক প্লেগ শুরু হয়েছে; কিন্তু এবার তা নিয়ে কোন হইচই নেই। ইতি

—বি
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৭০

১৭১৯ টার্ক ষ্ট্রীট সান ফ্রান্সিস্কো
১০ এপ্রিল, ১৯০০
প্রিয় জো,
নিউ ইয়র্কে একটা জটলা হচ্ছে দেখছি। অ … আমায় একখানা চিঠিতে জানিয়েছে যে, সে নিউ ইয়র্ক ছেড়ে চলে যাবে। সে ভেবেছে, মিসেস বুল ও তুমি তার বিরুদ্ধে আমাকে অনেক কিছু লিখেছ, উত্তরে আমি তাকে ধৈর্য ধরে থাকতে লিখেছি, আর জানিয়েছি যে, মিসেস বুল ও মিস ম্যাকলাইড আমাকে তার সম্বন্ধে শুধু ভাল কথাই লিখেন।

দেখ জো-জো, এই সব হুজ্জতের বিষয়ে আমার রীতি তো তোমার জানাই আছে—তা হচ্ছে, সমস্ত হুজ্জত এড়িয়ে চলা। ‘মা’-ই এই সবের ব্যবস্থা করেন। আমার কাজ শেষ হয়েছে। জো, আমি ছুটি নিয়েছি। ‘মা’ এখন নিজেই তাঁর কাজ চালাবেন। এই তো বুঝি!

এখন, তুমি যেমন পরামর্শ দিয়ে থাক—আমি এখানে যা কিছু অর্থ সংগ্রহ করেছি, সব পাঠিয়ে দেব। আজই পাঠাতে পারতাম, কিন্তু হাজার পুরাবার অপেক্ষায় আছি। এই সপ্তাহ শেষ হবার আগেই সান ফ্রান্সিস্কোতে এক হাজার পুরো করবার আশা রাখি। আমি নিউ ইয়র্কের নামে একখানি ড্রাফ‍্ট কিনব, কিম্বা ব্যাঙ্ককেই যথাযথ ব্যবস্থা করতে বলব।

মঠ ও হিমালয় থেকে অনেক চিঠি আসছে। আজ সকালে স্বরূপানন্দের এক চিঠি পেলাম; কাল মিসেস সেভিয়ারের একখানি এসেছে।

মিস হ্যান‍্স‍্‍বরোকে ফটোগ্রাফগুলির কথা বলেছি। মিঃ লেগেটকে আমার নাম করে বেদান্ত সোসাইটির ব্যাপারটার যথোচিত সমাধান করতে বল।

এইটুকু শুধু আমি বুঝেছি যে, প্রতি দেশেই সেই দেশের নিজস্ব ধারা আমাদের মেনে চলতে হবে। সুতরাং তোমার কাজ যদি আমায় করতে হত, তাহলে আমি সমস্ত সভ্য ও সমর্থকদের সভা আহ্বান করে জিজ্ঞাসা করতাম তাঁরা কি করতে চান, কোন সংহতি চান কিনা, যদি চান তবে তা কিরূপ হওয়া আবশ্যক, ইত্যাদি। তুমি কিন্তু কাজটি নিজের চেষ্টায় কর। আমি রেহাই চাই। একান্তই যদি মনে কর যে, আমি উপস্থিত থাকলে সাহায্য হবে, তবে আমি দিন পনরর মধ্যে আসতে পারব। আমার ওখানকার কাজ শেষ হয়েছে। তবে সান ফ্রান্সিস্কোর বাইরে স্টকটন একটি ছোট শহর—আমি সেখানে দিন কয়েক কাজ করতে চাই। তারপর পূর্বাঞ্চলে যাব। আমার মনে হয়, এখন আমার বিশ্রাম নেওয়া দরকার—যদিও আমি এই শহরে বরাবরই সপ্তাহে ১০০ ডলার করে পেতে পারি। এবারে আমি নিউ ইযর্কের উপর ‘লাইট ব্রিগেডে’র আক্রমণ (Charge of the Light Brigade)২০ চালাতে চাই। আমার আন্তরিক ভালবাসা জানবে।

তোমার চিরস্নেহশীল
বিবেকানন্দ

পুঃ—কর্মীরা সকলেই যদি সংহতির বিরোধী হয়, তবে কি তুমি মনে কর যে, ওতে কোন ফল হবে? তুমিই জান ভাল! যা ভাল মনে করবে, তাই কর। নিবেদিতা চিকাগো থেকে আমায় একখানি চিঠি লিখেছে। সে গোটাকয়েক প্রশ্ন করেছে—আমি উত্তর দেব।

—বি
*******************

পত্র সংখ্যা (৪৭১-৪৮০)

পত্র সংখ্যা (৪৭১-৪৮০)

পত্র সংখ্যা - ৪৭১
[জনৈক আমেরিকান বন্ধুকে লিখিত]

আলামেডা, ক্যালিফোর্নিয়া
১২ এপ্রিল,১৯০০
… ‘মা’ আবার প্রসন্না হচ্ছেন; অবস্থা অনুকূল হয়ে আসছে—তা হতেই হবে।

কর্ম চিরকালই অশুভকে সঙ্গে নিয়ে আসে। আমি নিজ স্বাস্থ্য হারিয়ে সঞ্চিত অশুভরাশির ফলভোগ করছি। এতে আমি খুশী, এতে আমার মন হালকা হয়ে গেছে—আমার জীবনে এমন একটা স্নিগ্ধ কোমলতা ও প্রশান্তি এসেছে; যা এর আগে কখনও ছিল না। আমি এখন কেমন করে একই কালে আসক্ত ও অনাসক্ত থাকতে হয়, তাই শিখছি এবং ক্রমশঃ নিজের মনের উপর আমার প্রভুত্ব আসছে।

মায়ের কাজ মা-ই করছেন; সেজন্য এখন বেশী মাথা ঘামাই না। আমার মত পতঙ্গ প্রতি মুহূর্তে হাজার হাজার মরছে; কিন্তু মায়ের কাজ সমভাবেই চলছে। জয় মা! … মায়ের ইচ্ছাস্রোতে গা ভাসিয়ে একলা আজীবন চলে এসেছি। যখনই এর ব্যাতিক্রম করেছি, তখনই আঘাত পেয়েছি। মায়ের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।

আমি সুখে আছি, নিজের মনের সব দ্বন্দ্ব কাটিয়ে শান্তিতে আছি; আমার অন্তরের বৈরাগ্য আজ আগের চেয়ে অধিক সমুজ্জ্বল। আত্মীয়স্বজনের প্রতি ভালবাসা দিন দিন কমে যাচ্ছে, আর মায়ের প্রতি আকর্ষণ ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে। দক্ষিণেশ্বরের বটবৃক্ষমূলে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে সেই যে আমরা দীর্ঘ রাত্রি জেগে কাটাতাম, তারই স্মৃতি আবার মনে জাগছে। আর কর্ম? কর্ম আবার কি? কার কর্ম? আর কার জন্যই বা কর্ম করব?

আমি মুক্ত। আমি মায়ের সন্তান। মা-ই সব কর্ম করেন, সবই মায়ের খেলা। আমি কেন মতলব আঁটতে যাব? আর কি মতলবই বা আঁটব? আমার পরিকল্পনার অপেক্ষা না রেখেই মা-র যেমন অভিরুচি, তেমনি ভাবে যা-কিছু আসবার এসেছে ও চলে গেছে। মা-ই তো যন্ত্রী, আমরা তাঁর হাতের যন্ত্র ছাড়া আর কি?
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৭২

১৭ এপ্রিল, ১৯০০
প্রিয় মিঃ লেগেট,
সম্পাদিত ‘উইল’খানা এই সঙ্গে আপনাকে পাঠাচ্ছি। এটা তাঁর২১ ইচ্ছানুসারেই সম্পাদন করা হয়েছে এবং যথারীতি এটার ভার গ্রহণের কষ্ট স্বীকার করতে আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি।

প্রথম থেকে আপনারা আমার প্রতি সমভাবে সদয়। কিন্তু প্রিয় বন্ধু, আপনি তো জানেন, যেখান থেকে আনুকূল্য পাওয়া যায় (আনুকূল্য এখন পাওয়া গিয়েছে), মানুষ সেখান থেকেই আরও বেশী করে পেতে চায়, এই তার স্বভাব।

আপনার সন্তান আমিও মানুষ।

আপনি যখন এ চিঠিখানা পাবেন, তখন আমি সান ফ্রান্সিস্কো ছেড়ে চলে গিয়েছি। আপনি দয়া করে আমার ভারতীয় চিঠিপত্র C/o Mrs. Hal, 10 Aster Street, Chicago (চিকাগো), এই ঠিকানায় মার্গটের কাছে পাঠিয়ে দেবেন কি? মার্গটের বিদ্যালয়ের জন্য আপনার ১০০০ ডলার দানের কথা সে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে লিখেছে।

আমাদের প্রতি আপনাদের অবিচলিত সহৃদয়তার জন্য নিরন্তর এই প্রার্থনা জানাই যে, সকল আশীর্বাদ চিরদিন আপনাদের ঘিরে থাকুক।

আপনার স্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ

পুনঃ—মিসেস লেগেট ইতোমধ্যেই সম্পূর্ণ সেরে উঠেছেন জেনে আমি খুব আনন্দিত।

*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৭৩

আলামেডা, ক্যালিফোর্নিয়া
১৮ এপ্রিল, ১৯০০
প্রিয় জো,
এইমাত্র তোমার ও মিসেস বুলের সাদর আহ্বানপত্র পেলাম। এ চিঠি আমি লণ্ডনের ঠিকানায় লিখছি। মিসেস লেগেট নিঃসন্দেহে আরোগ্যের পথে চলেছেন জেনে আমি খুবই সুখী হয়েছি!

মিঃ লেগেটে সভাপতিপদ ত্যাগ করেছেন শুনে বড়ই দুঃখিত হলাম।

আসল কথা—আরও বেশী গোল পাকাবার ভয়ে আমি চুপ করে আছি। তুমি তো জানই—আমার সব ভয়ানক কড়া ব্যবস্থা; একবার যদি আমার খেয়াল চাপে তো এমন চেঁচাতে শুরু করব যে, অ—র মনের শান্তিভঙ্গ হবে। আমি তাকে শুধু এইটুকু লিখে জানিয়েছি যে, মিসেস বুল সম্বন্ধে তার সব ধারণা একেবারে ভুল।

কর্ম করা সব সময়ই কঠিন। আমার জন্য প্রার্থনা কর জো, যেন চিরদিনের তরে আমার কাজ করা ঘুচে যায়; আর আমার সমুদয় মন-প্রাণ যেন মায়ের সত্তায় মিলে একেবারে তন্ময় হয়ে যায়। তাঁর কাজ তিনিই জানেন।

তুমি আবার লণ্ডনে পুরানো বন্ধুদের মধ্যে গিয়ে খুবই সুখী হয়েছ নিশ্চয়। তাদের সকলকে আমার ভালবাসা জানিও। আমি ভালই আছি—মানসিক খুব ভালই। শরীর চেয়ে মনের শান্তি-স্বচ্ছন্দতাই খুব বেশী বোধ করছি। লড়াইয়ে হার-জিত দুই-ই হল—এখন পুঁটলি-পাঁটলা বেঁধে সেই মহান্ মুক্তিদাতার অপেক্ষায় যাত্রা করে বসে আছি। ‘অব শিব পার করো মেরা নেইয়া’—হে শিব, হে শিব, আমার তরী পারে নিয়ে যাও, প্রভু।

যতই যা হোক, জো, আমি এখন সেই আগেকার বালক বৈ আর কেউ নই, যে দক্ষিণেশ্বরের পঞ্চবটীর তলায় রামকৃষ্ণের অপূর্ব বাণী অবাক হয়ে শুনত আর বিভোর হয়ে যেত। ঐ বালক-ভাবাটাই হচ্ছে আমার আসল প্রকৃতি; আর কাজকর্ম, পরোপকার ইত্যাদি যা-কিছু করা গেছে, তা ঐ প্রকৃতিরই উপরে কিছুকালের জন্য আরোপিত একটা উপাধি মাত্র। আহা, আবার তাঁর সেই মধুর বাণী শুনতে পাচ্ছি—সেই চিরপরিচিত কণ্ঠস্বর!—যাতে আমার প্রাণের ভিতরটা পর্যন্ত কণ্টকিত করে তুলছে! বন্ধন সব খসে যাচ্ছে, মানুষের মায়া উড়ে যাচ্ছে, কাজকর্ম বিস্বাদ বোধ হচ্ছে! জীবনের প্রতি আকর্ষণও কোথায় সরে দাঁড়িয়েছে! রয়েছে কেবল তার স্থলে প্রভুর সেই মধুর গম্ভীর আহ্বান!—যাই, প্রভু, যাই! ঐ তিনি বলছেন, ‘মৃতের সৎকার মৃতেরা করুক’২২ (সংসারের ভাল-মন্দ সংসারীরা দেখুক), ‘তুই (ওসব ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে) আমার পিছু পিছু চলে আয়!’—যাই, প্রভু, যাই!

হ্যাঁ, এইবার আমি ঠিক যাচ্ছি। আমার সামনে অপার নির্বাণ-সমুদ্র দেখতে পাচ্ছি! সময়ে সময়ে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করি, সেই অসীম অনন্ত শান্তির পারাবার—মায়ার এতটুকু বাতাস বা একটা ঢেউ পর্যন্ত যার শান্তিভঙ্গ করছে না!

আমি যে জন্মেছিলুম, তাতে আমি খুশী; এত যে কষ্ট পেয়েছি, তাতেও খুশী; জীবনে যে বড় বড় ভুল করেছি, তাতেও খুশী; আবার এখন যে নির্বাণের শান্তি-সমুদ্রে ডুব দিতে যাচ্ছি, তাতেও খুশী। আমার জন্য সংসারে ফিরতে হবে, এমন বন্ধনে আমি কাউকে ফেলে যাচ্ছি না; অথবা এমন বন্ধন আমিও কারও কাছ থেকে নিয়েও যাচ্ছি না। দেহটা গিয়েই আমার মুক্তি হোক, অথবা দেহ থাকতে থাকতেই মুক্ত হই, সেই পুরানো ‘বিবেকানন্দ’ কিন্তু চলে গেছে, চিরদিনের জন্য চলে গেছে—আর ফিরছে না!

শিক্ষাদাতা, গুরু, নেতা, আচার্য বিবেকানন্দ চলে গেছে—পড়ে আছে কেবল সেই বালক, প্রভুর সেই চিরশিষ্য, চিরপদাশ্রিত দাস!

তুমি বুঝতে পারছ, কেন আমি অভেদানন্দের কাজে হাত দিচ্ছি না।

আমি কে জো, যে কারও কাজে হাত দেব? অনেক দিন হল, নেতৃত্ব আমি ছেড়ে দিয়েছি। কোন বিষয়েই ‘এইটে আমার ইচ্ছা’ বলবার আর অধিকার নেই। এই বৎসরের গোড়া থেকেই আমি ভারতের কাজে কোন আদেশ দেওয়া ছেড়ে দিয়েছি—তা তো তুমি জানই। তুমি ও মিসেস বুল অতীতে আমার জন্য যা করেছ, তার জন্য অজস্র ধন্যবাদ। তোমাদের চির-কল্যাণ—অনন্ত কল্যাণ হোক। তাঁর ইচ্ছাস্রোতে যখন আমি সম্পূর্ণ গা ঢেলে দিয়ে থাকতুম, সেই সময়টাই জীবনের মধ্যে আমার পরম মধুময় মুহূর্ত বলে মনে হয়। এখন আবার সেইরূপে গা ভাসান দিয়েছি। উপরের সূর্য তাঁর নির্মল কিরণ বিস্তার করছেন; পৃথিবী চারিদিকে শস্যসম্পদ-শালিনী হয়ে শোভা পাচ্ছেন, দিনের উত্তাপে সব প্রাণী ও পদার্থ কত নিস্তব্ধ, কত স্থির, শান্ত!—আর আমিও সেই সঙ্গে এখন ধীর-স্থির ভাবে, নিজের ইচ্ছা আর বিন্দুমাত্র না রেখে, প্রভুর ইচ্ছারূপ প্রবাহিণীর সুশীতল বক্ষে ভেসে ভেসে চলেছি! এতটুকু হাত-পা নেড়ে এ প্রবাহের গতি ভাঙতে আমার প্রবৃত্তি বা সাহস হচ্ছে না—পাছে প্রাণের এই অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ও শান্তি আবার ভেঙে যায়! প্রাণের এই শান্তি ও নিস্তব্ধতাই জগৎটাকে মায়া বলে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়! এর আগে আমার কর্মের ভিতর মান-যশের ভাবও উঠত,২৩ আমার ভালবাসার ভিতর ব্যক্তিবিচার আসত, আমার পবিত্রতার পিছনে ফলভোগের আকাঙ্ক্ষা থাকত, আমার নেতৃত্বের ভিতর প্রভুত্বস্পৃহা আসত। এখন সে-সব উড়ে যাচ্ছে; আর আমি সকল বিষয়ে উদাসীন হয়ে তাঁর ইচ্ছায় ঠিক ঠিক গা ভাসান দিয়ে চলেছি। যাই! মা, যাই!—তোমার স্নেহময় বক্ষে ধারণ করে যেখানে তুমি নিয়ে যাচ্ছ, সেই অশব্দ, অস্পর্শ, অজ্ঞাত, অদ্ভুত রাজ্যে—অভিনেতার ভাব সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে কেবলমাত্র দ্রষ্টা বা সাক্ষীর মত ডুবে যেতে আমার দ্বিধা নাই!

আহা, কি স্থির প্রশান্তি! চিন্তাগুলি পর্যন্ত বোধ হচ্ছে যেন হৃদয়ের কোন্ এক দূর, অতি দূর অন্তস্তল থেকে মৃদু বাক্যালাপের মত ধীর অস্পষ্টভাবে আমার কাছে এসে পৌঁছচ্ছে। আর শান্তি—মধুর, মধুর শান্তি—যা-কিছু দেখছি শুনছি, সব কিছু ছেয়ে রয়েছে!—মানুষ ঘুমিয়ে পড়বার আগে কয়েক মুহূর্তের জন্য যেমন বোধ করে—যখন সব জিনিষ দেখা যায়, কিন্তু ছায়ার মত অবাস্তব মনে হয়—ভয় থাকে না, তাদের প্রতি একটা ভালবাসা থাকে না, হৃদয়ে তাদের সম্বন্ধে এতটুকু ভাল-মন্দ ভাব পর্যন্ত জাগে না—আমার মনের এখনকার অবস্থা যেন ঠিক সেইরূপ, কেবল শান্তি শান্তি! চারপাশে কতকগুলি পুতুল আর ছবি সাজানো রয়েছে দেখে লোকের মনে যেমন শান্তিভঙ্গের কারণ উপস্থিত হয় না, এ অবস্থায় জগৎটাকে ঠিক তেমনই দেখাচ্ছে; আমার প্রাণের শান্তিরও বিরাম নেই। ঐ আবার সেই আহ্বান!—যাই প্রভু, যাই।

এ অবস্থায় জগৎটা রয়েছে, কিন্তু সেটাকে সুন্দরও মনে হচ্ছে না, কুৎসিতও মনে হচ্ছে না।—ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয়ানুভূতি হচ্ছে, কিন্তু মনে ‘এটা ত্যাজ্য, ওটা গ্রাহ্য’—এমন ভাবের কিছুমাত্র উদয় হচ্ছে না। আহা, জো, এ যে কি আনন্দের অবস্থা, তা তোমায় কি বলব! যা কিছু দেখছি, শুনছি, সবই সমানভাবে ভাল ও সুন্দর বোধ হচ্ছে; কেননা নিজের শরীর থেকে আরম্ভ করে তাদের ভিতর বড়-ছোট, ভাল-মন্দ, উপাদেয় হেয় বলে যে একটা সম্বন্ধ এতকাল ধরে অনুভব করেছি, সেই উচ্চ-নীচ সম্বন্ধটা এখন যেন কোথায় চলে গেছে! আর, সবচেয়ে উপাদেয় বলে এই শরীরটার প্রতি এর আগে যে বোধটা ছিল, সকলের আগে সেইটাই যেন কোথায় লোপ পেয়েছে! ওঁ তৎ সৎ!

আমি আশা করি, তোমরা সকলে লণ্ডনে ও প্যারিসে বহু নূতন অভিজ্ঞতা লাভ করবে—শরীর ও মনের নূতন আনন্দ, নূতন খোরাক পাবে।

তুমি ও মিসেস বুল আমার চিরন্তন ভালবাসা জানবে। ইতি



তোমারই চিরবিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৭৪

আলামেডা, ক্যালিফোর্নিয়া
২০ এপ্রিল, ১৯০০
প্রিয় জো,
আজ তোমার চিঠি পেলাম। গতকাল তোমাকে চিঠি লিখেছি, কিন্তু তুমি ইংল্যাণ্ডে থাকবে ভেবে চিঠি সেখানের ঠিকানায় পাঠিয়েছি।

মিসেস বেট‍্‍স‍্-কে তোমার বক্তব্য জানিয়েছি। অ—এর সঙ্গে যে ছোটখাট একটা মতান্তর হয়েছে, তার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। তুমি তার যে পত্রখানা পাঠিয়েছ, তাও পেয়েছি। এ পর্যন্ত সে ঠিকই বলেছে, ‘স্বামীজী আমাকে লিখেছেনঃ মিঃ লেগেট বেদান্তে উৎসাহী নন এবং আর সাহায্য করবেন না। তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াও।’ টাকাপয়সার কি করা যাবে, তার এ প্রশ্নের উত্তরে—তোমার ও মিসেস লেগেটের ইচ্ছানুসারে তাকে আমি লস এঞ্জেলেস্ থেকে নিউ ইয়র্কের সংবাদ লিখেছিলাম।

হ্যাঁ, কাজ তার নিজের রূপ নেবেই, কিন্তু মনে হচ্ছে তোমার ও মিসেস বুলের মনে ধারণা যে, এ ব্যাপারে আমার কিছু করা উচিত। কিন্তু প্রথমতঃ অসুবিধা সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না। সেটা যে কি নিয়ে সে কথা তোমরা কেউই আমাকে কিছু লেখনি। অন্যের মনের কথা জেনে নেবার বিদ্যা আমার নেই।

তুমি শুধু সাধারণভাবে লিখেছ যে, অ—নিজের হাতে সব কিছু রাখতে চায়। এ থেকে আমি কি বুঝব? অসুবিধাগুলি কি কি? প্রলয়ের সঠিক তারিখটি সম্বন্ধে আমি যেমন অন্ধকারে, তোমার মতভেদের কারণ সম্বন্ধেও আমি তেমনই অন্ধকারে। অথচ মিসেস বুলের ও তোমার চিঠিগুলিতে যথেষ্ট বিরক্তিভাব। এই সব জিনিষ আমরা না চাইলেও কখনও কখনও জটিল হয়ে পড়ে। এগুলি স্বাভাবিক পরিণতি লাভ করুক।

মিসেস বুলের ইচ্ছানুসারে উইল তৈরী করে মিঃ লেগেটকে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার শরীর একরূপ চলে যাচ্ছে, কখনও ভাল আছি, কখনও মন্দ। মিসেস মিল্টনের চিকিৎসায় আমি কিছুমাত্র উপকৃত হয়েছি, এ-কথা ঠিক বলতে পারি না। তিনি আমায় ভাল করতে চেয়েছেন, এজন্য আমি কৃতজ্ঞ। তাঁকে আমার প্রীতি জানাচ্ছি। আশা করি, তিনি অন্য লোকের উপকার করতে পারবেন।

এই কথাগুলি মিসেস বুলকে লেখার জন্য তাঁর কাছ থেকে চার-পাতার এক চিঠি পেয়েছি; তাতে কিভাবে আমার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত, কিভাবে ধন্যবাদ জানান উচিত, সেই সব সম্বন্ধে লম্বা উপদেশ।

অ—এর ব্যাপার থেকে নিশ্চয়ই এ-সবের উৎপত্তি!

স্টার্ডি ও মিসেস জনসন মার্গটের জন্য বিচলিত হয়ে আমার কঠোর সমালোচনা করেছে। এখন আবার অ—মিসেস বুলকে বিচলিত করেছে এবং তার ধাক্কাও আমাকে সামলাতে হচ্ছে। এই হল জীবন!

তুমি ও মিসেস লেগেট চেয়েছিলে আমি তাকে স্বাধীন ও আত্মনির্ভর হতে লিখি—এ-কথা লিখি যে, মিঃ লেগেট তাকে আর সাহায্য করবেন না। আমি তাই লিখেছি। এখন আমি আর কি করতে পারি?

যদি কেউ (John and Jack) তোমার কথা না শোনে, তা হলে তার জন্য কি আমাকে ফাঁসি যেতে হবে? এই বেদান্ত সোসাইটি সম্বন্ধে আমি কি জানি? আমি কি সেটা আরম্ভ করেছিলাম? তাতে কি আমার কোন হাত ছিল? তদুপরি, ব্যাপারটা যে কি, সে সম্বন্ধে দু-কলম লেখবার মনও কারও হয়নি।

বাস্তবিক, এ দুনিয়া খুব একটা মজা!

মিসেস লেগেট দ্রত আরোগ্যলাভ করছেন জেনে আনন্দিত। তাঁর সম্পূর্ণ রোগমুক্তির জন্য আমি নিরন্তর প্রার্থনা করি। সোমবার চিকাগো যাত্রা করব। এক সহৃদয় মহিলা নিউ ইয়র্কের এমন একখানা পাস (Railway pass) আমাকে দিয়েছেন, যা তিনমাস পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে। ‘মা’-ই আমাকে দেখবেন। সারা জীবন আগলে থাকার পরে তিনি নিশ্চয়ই এখন আমাকে অসহায় অবস্থায় ফেলে দেবেন না। ইতি

তোমাদের চিরকৃতজ্ঞ
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৭৫
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
২৩ এপ্রিল, ১৯০০

প্রিয় মেরী,
আজই আমার যাত্রা করা উচিত ছিল, কিন্তু ঘটনাচক্রে যাত্রার পূর্বে ক্যালিফোর্নিয়ার বিশাল রেড-উড বৃক্ষরাশির নীচে তাঁবুতে বাস করার লোভ আমি সংবরণ করতে পারলাম না। তাই তিন-চার দিনের জন্য যাত্রা স্থগিত রাখলাম। তা ছাড়া অবিরাম কাজের পরে এবং চারদিনের হাড়ভাঙা ভ্রমণে বেরোবার আগে ঈশ্বরের মুক্ত বায়ুতে শ্বাস নেওয়ার প্রয়োজন আমার ছিল।

‘মেরী-পিসী’র সঙ্গে পনর দিনের মধ্যে দেখা করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তা রাখবার জন্য তাগিদ দিয়ে মার্গট চিঠি লিখেছে। কথা আমি রাখব, তবে পনর দিনের জায়গায় বিশ দিন হবে, এই যা। এতে চিকাগোয় এখন যে বিশ্রী তুষার-ঝড় চলছে, তার হাত এড়াতে পারব, অধিকন্তু কিছু শক্তিসঞ্চয় করে নেব।

মার্গট দেখা যাচ্ছে মেরী-পিসীর দারুণ অনুরাগী।

আগামী কাল বনের দিকে যাত্রা করছি। উফ্! চিকাগো যাবার আগে ফুসফুস ওজোন (ozone)-এ ভরে নেব। ইতোমধ্যে চিকাগোয় আমার নামে ডাক এলে রেখে দিও, লক্ষ্মী-মেয়েটির মত সেগুলি যেন আবার এখানে পাঠিয়ে দিও না।

কাজ শেষ করে ফেলেছি। রেলভ্রমণের ধকলের আগে শুধু কয়েকদিনের—তিন কি চার দিনের—বিশ্রামের জন্য বন্ধুরা পীড়াপীড়ি করছেন।

এখান থেকে নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত তিন মাস মেয়াদের একটি ফ্রী পাস (Free pass) পেয়েছি; ঘুমের কামরার খরচা ছাড়া আর কিছু খরচা নেই; অতএব, বুঝতেই পারছ—মুক্ত, মুক্ত (Free, free)!

তোমাদের স্নেহশীল
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৭৬
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
৩০ এপ্রিল, ১৯০০

প্রিয় মেরী,
আকস্মিক অসুস্থতা ও জ্বরের জন্য এখনও চিকাগো যাত্রা করতে পারিনি। দীর্ঘ ভ্রমণের ধকল সহ্য করার মত বল পেলেই রওনা হব। মার্গটের কাছ থেকে সেদিন একখানা চিঠি পেয়েছি। তাকে আমার ভালবাসা দিও। তুমি আমার চিরন্তন ভালবাসা নিও। হ্যারিয়েট কোথায়? এখনও কি চিকাগোতেই? আর ম্যাক‍্‍কিণ্ডলি বোনেরা? সকলকে আমার ভালবাসা।

বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৭৭
[মিসেস ব্লজেটকে লিখিত]
২ মে, ১৯০০
আপনার অত্যন্ত সহৃদয় পত্রখানি পেয়েছি। ছ-মাসের কঠোর পরিশ্রমের জন্য আবার স্নায়ুরোগে ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শয্যাগত আছি। যা হোক, দেখলাম আমার কিডনি ও হার্ট আগের মতই ভাল আছে। কয়েকদিনের জন্য গ্রামাঞ্চলে বিশ্রাম নিতে যাচ্ছি, তারপরই চিকাগো রওনা হব।

মিসেস মিলওয়ার্ড এডাম‍্‍স্‌কে (Mrs. Milward Adams) এইমাত্র চিঠি লিখেছি এবং আমার কন্যা মিস নোবল‍্‍কেও একখানা পরিচয়পত্র দিয়েছি, যাতে সে মিস এডাম‍্‍স‍্-এর সঙ্গে গিয়ে দেখা করে এবং কাজ সম্বন্ধে তাঁকে যাবতীয় জ্ঞাতব্য তথ্য জানায়।

স্নেহময়ী মা আমার, ভগবানের আশীর্বাদ ও শান্তি আপনি লাভ করুন। আমিও একটু শান্তি চাই, খুবই চাই, আমার জন্য প্রার্থনা করুন। কেটকে ভালবাসা।

বিবেকানন্দ

পুঃ—মিস স্পেন্সার প্রভৃতি বন্ধুদের ভালবাসা। ট্রিকসের মাথায় রাশি রাশি আদরের চাপড়।

বি
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৭৮
২ মে, ১৯০০
স্নেহের নিবেদিতা,
আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম—মাসখানেক ধরে কঠোর পরিশ্রমের ফলে আবার রোগের আক্রমণ হয়েছিল। যাই হোক, এতে আমি এইটুকু বুঝতে পেরেছি যে, আমার হার্ট বা কিডনিতে কোন রোগ নাই, শুধু অতিরিক্ত পরিশ্রমে স্নায়ুগুলি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সুতরাং আজ কিছু দিনের জন্য পল্লী অঞ্চলে যাচ্ছি এবং শরীর সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ওখানেই থাকব; আশা করি, শীঘ্রই শরীর সুস্থ হয়ে যাবে।

ইতোমধ্যে প্লেগের খবর ইত্যাদিতে ভরা কোন ভারতীয় চিঠি আমি পড়তে চাই না। আমার সব ডাক (mail) মেরীর কাছে যাচ্ছে। আমি যতক্ষণ ফিরে না আসছি, ততক্ষণ মেরীর অথবা মেরী চলে গেলে তোমারই কাছে ঐসব থাকুক। আমি সব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হতে চাই। জয় মা!

মিসেস হাণ্টিংটন নামে একজন প্রচুর বিত্তশালিনী মহিলা আমায় কিছু সাহায্য করেছিলেন; তিনি তোমার সঙ্গে দেখা করতে ও তোমায় সাহায্য করতে চান। তিনি ১ জুনের মধ্যেই নিউ ইয়র্কে আসবেন। তাঁর সঙ্গে দেখা না করে চলে যেও না যেন। আমি যদি সময়মত উপস্থিত থাকতে না পারি, তাঁর নামে তোমাকে একখানি পরিচয়পত্র পাঠিয়ে দেব।

মেরীকে আমার ভালবাসা জানিও। আমি দিন-কয়েকের মধ্যেই যাচ্ছি। ইতি

সতত শুভানুধ্যায়ী
তোমাদের বিবেকানন্দ

পুঃ—সঙ্গের চিঠিখানি তোমাকে মিসেস এডাম্‌সের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য লিখলাম। তিনি জজ এডাম্‌সের স্ত্রী। তাঁর সঙ্গে অবিলম্বে দেখা করবে। এর ফলে হয়তো অনেক কাজ হবে। তিনি খুব পরিচিতা—তাঁর ঠিকানা খুঁজে বের কর। ইতি

বি
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৭৯
সান ফ্রান্সিস্কো
২৬ মে, ১৯০০
স্নেহের নিবেদিতা,
আমার অনন্ত আশীর্বাদ জেনো এবং কিছুমাত্র নিরাশ হয়ো না। শ্রী ওয়া গুরু, শ্রী ওয়া গুরু। ক্ষত্রিয়-শোণিতে তোমার জন্ম। আমাদের অঙ্গের গৈরিক বাস তো যুদ্ধক্ষেত্রের মৃত্যুসজ্জা! ব্রত-উদ‍্‍যাপনে প্রাণপাত করাই আমাদের আদর্শ, সিদ্ধির জন্য ব্যস্ত হওয়া নয়। শ্রী ওয়া গুরু।

অশুভ অদৃষ্টের আবরণ তো দুর্ভেদ্য কালো। কিন্তু আমিই সর্বময় প্রভু! যে মুহূর্তে আমি ঊর্ধ্বে হাত তুলি—সেই মুহূর্তেই ঐ তমসা অন্তর্হিত হয়ে যায়। এসবই অর্থহীন, এবং ভীতিই এদের জনক। আমি ভয়েরও ভয়, রুদ্রেরও রুদ্র। আমি অভীঃ, অদ্বিতীয়, এক। আমি অদৃষ্টের নিয়ামক, আমি কপালমোচন। শ্রী ওয়া গুরু। দৃঢ় হও, মা! কাঞ্চন কিম্বা অন্য কিছুর দাস হয়ো না, তবেই সিদ্ধি আমাদের সুনিশ্চিত।



বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৮০
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
1921 W 21 Street
লস এঞ্জেলেস্
১৭ জুন, ১৯০০
প্রিয় মেরী,
সত্যি আমি অনেকটা ভাল, কিন্তু সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভ করিনি। যাই হোক না কেন, যারা ব্যারামে ভোগে, তাদের প্রত্যেকেরই মানসিক অবস্থা এরূপ হয়।

কালী-উপাসনা ধর্মের কোন অপরিহার্য সোপান নয়। ধর্মের যাবতীয় তত্ত্বই উপনিষদ্‌ থেকে পাওয়া যায়। কালী-উপাসনা আমার বিশেষ খেয়াল; আমাকে এর প্রচার করতে তুমি কোন দিন শোননি, বা ভারতেও তা প্রচার করেছি বলে পড়নি। সকল মানবের পক্ষে যা কল্যাণকর, আমি তাই প্রচার করি। যদি কোন অদ্ভুত প্রণালী থাকে, যা শুধু আমার পক্ষেই খাটে, তা আমি গোপন রেখে দিই এবং সেখানেই তার ইতি। কালী-উপাসনা কি বস্তু, সে তোমার কাছে কোন মতেই ব্যাখ্যা করব না, কারণ কখনও কারও কাছে তা করিনি।

তুমি যদি মনে করে থাক যে হিন্দুরা ‘বসু’দের২৫ পরিত্যাগ করেছে, তা হলে সম্পূর্ণ ভুল করেছ। ইংরেজ শাসকগণ তাঁকে কোণঠাসা করতে চায়। ভারতীয়দের মধ্যে ঐ ধরনের উন্নতি তারা কোন মতেই চায় না। তারা তাঁর পক্ষে জায়গাটা অসহ্য করে তুলেছে, সে জন্য তিনি অন্যত্র যেতে চাইছেন।

‘অ্যাংগ্লিসাইজ‍্ড’ (anglicised) কথাটার দ্বারা সেই সকল লোকদেরই বোঝায়, যারা তাদের স্বভাব ও আচরণের দ্বারা দেখিয়ে দেয় যে, তারা আমাদের—দরিদ্র ও সেকেলে হিন্দুদের—জন্য লজ্জিত। আমি আমার জন্ম, জাতি বা জাতীয় চরিত্রের জন্য লজ্জিত নই। এ-ধরনের লোককে যে হিন্দুরা পছন্দ করবে না, এতে আমি আশ্চর্য নই।

খাঁটি উপনিষদের তত্ত্ব ও নীতিই আমাদের ধর্ম, তাতে আচার-অনুষ্ঠান, প্রতীক ইত্যাদির কোন স্থান নেই। অনেকে মনে করে, আচার-অনুষ্ঠানাদি তাদের ধর্মানুভূতির সহায়তা করে। তাতে আমার আপত্তি নেই।

শাস্ত্র, আচার্য, প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ অথবা ত্রাণকর্তাদের উপর ধর্ম নির্ভর করে না। এই ধর্ম ইহজীবনে বা অন্য কোন জীবনে অপরের উপর আমাদের নির্ভরশীল করে তোলে না। এই অর্থে উপনিষদের অদ্বৈতবাদই একমাত্র ধর্ম। তবে শাস্ত্র, অনুষ্ঠান, প্রেরিত পুরুষ বা ত্রাণকর্তাদেরও স্থান আছে। সেগুলি অনেককে সাহায্য করতে পারে, যেমন কালী-উপাসনা আমাকে আমার ‘ঐহিক কাজে’ সাহায্য করে। এগুলি স্বাগত।

তবে ‘গুরু’ একটি স্বতন্ত্র ভাব। শক্তির সঞ্চারক ও গ্রহীতার মধ্যে যে সম্বন্ধ, এ হল তাই, এখানে তা আত্মিক শক্তি ও জ্ঞান। শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রত্যেক জাতির একটি নির্দিষ্ট আদর্শ আছে। প্রত্যেক জাতিই অন্য জাতির ভাবধারা প্রতিনিয়ত নিজের ধাঁচের মধ্যে অর্থাৎ তার জাতীয় স্বভাবের মধ্যে গ্রহণ করে তাকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করছে। কোন জাতির নির্দিষ্ট আদর্শ ধ্বংস করার সময় এখনও হয়নি। শিক্ষা যে-কোন সূত্র থেকেই আসুক না কেন, যে-কোন দেশের শিক্ষাদর্শের সঙ্গে তার ভাবসামঞ্জস্য আছে; কেবল তাকে গ্রহণ করবার সময়ে জাতীয় ভাবাপন্ন করে নিতে হবে অর্থাৎ সে শিক্ষা যেন জাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের অনুগামী হয়।

ত্যাগই হল প্রত্যেক জাতির চিরন্তন আদর্শ। অন্য জাতিগুলি কেবল জানে না যে, প্রকৃতি অজান্তে তাদের দ্বারা কি করিয়ে নিচ্ছে। যুগ যুগ ধরে এই একই উদ্দেশ্য নিশ্চিতভাবে কাজ করে চলেছে। এ পৃথিবী ও সূর্যের ধ্বংসের সঙ্গেই এই উদ্দেশ্যেরও শেষ হবে! আর পৃথিবীর নিত্য প্রগতি হচ্ছে বটে, না! আর অসীম জগতের কোথাও কেউই এ যাবৎ উন্নত হয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ বা আদানপ্রদান করছে না! বাজে কথা! তারা জন্মায়, একই বাহ্যরূপ দেখায় এবং একভাবেই মরে! ক্রমবর্ধমান উদ্দেশ্য বটে! শিশুগণ, তোমরা স্বপ্নরাজ্যে বাস কর!

এবার নিজের কথা। হ্যারিয়েট যাতে প্রতি মাসে আমাকে কয়েক ডলার করে দেয়, তুমি নিশ্চয়ই সে বিষয়ে তাকে রাজী করাবে, এবং অন্য কয়েকজন বন্ধুর দ্বারাও তাকে রাজী করাবার চেষ্টা করব, যদি সফল হই, তাহলে ভারতে চলে যাচ্ছি। জীবিকার জন্য এইসব মঞ্চ-বক্তৃতার কাজ করে করে আমি একেবারে ক্লান্ত। এ কাজ আমার আর ভাল লাগছে না। অবসর নিয়ে লেখবার ইচ্ছা, দেখি যদি কিছু গভীর চিন্তার কাজ করতে পারি।

শীঘ্রই চিকাগো যাচ্ছি, কয়েক দিনের মধ্যে সেখানে পৌঁছব, আশা করি।

মেরী, আশাবাদে এমন মেতে উঠছি যে, যদি ডানা থাকত হিমালয়ে উড়ে যেতাম!

মেরী, সারা জীবন আমি জগতের জন্য খেটেছি, কিন্তু সে জগৎ আমার দেহের এক খাবলা মাংস কেটে না নেওয়া পর্যন্ত এক টুকরো রুটিও আমাকে ছুঁড়ে দেয়নি।

দিনে এক টুকরো রুটি জুটলেই আমি পরিপূর্ণ অবসর নিই; কিন্তু তা অসম্ভব—।

সতত প্রভুসমীপে তোমার
বিবেকানন্দ

পুনঃ—বস্তুর অসারতা যদি কারও কাছে ধরা পড়ে থাকে, সে মানুষ এখন আমি। এইতো জগতের চেহারা—একটা কদর্য পশুর মৃতদেহ। যে মনে করে, এ জগতের উপকার করব, সে একটা আহাম্মক। তবে ভাল হোক, মন্দ হোক, কাজ আমাদের করে যেতে হবে—আমাদের বন্ধন ঘোচাবার জন্য। আশা করি, সে কাজ আমি করেছি। এখন প্রভু আমাকে অপর পারে নিয়ে চলুন। তাই হোক, প্রভু তাই হোক। ভারত বা অন্য কোন দেশের জন্য চিন্তা আমি ত্যাগ করেছি। এখন আমি স্বার্থপর, নিজের মুক্তি চাই।

‘যিনি ব্রহ্মাকে প্রথম সৃষ্টি করেছেন, এবং তাঁর কাছে বেদসকল প্রকাশ করেছেন, যিনি সকলের হৃদয়ে বিরাজমান, বন্ধনমুক্তির আশা করে তাঁর কাছে আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি।’২৬
*******************

পত্র সংখ্যা (৪৮১-৪৯০)

পত্র সংখ্যা (৪৮১-৪৯০)

পত্র সংখ্যা - ৪৮১

নিউ ইয়র্ক
২০ জুন, ১৯০০
প্রিয় নিবেদিতা,
… মহামায়া আবার সদয় হয়েছেন বলে বোধ হয়, আর চক্র ধীরে ধীরে উপর দিকে উঠছে।

তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৮২
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
বেদান্ত সোসাইটি
146 E 55th Street, নিউ ইয়র্ক
২৩ জুন, ১৯০০
প্রিয় মেরী,
তোমার সুন্দর চিঠিখানির জন্য ধন্যবাদ। খুব ভাল আছি, সুখী আছি—যেমন থাকি। জোয়ারের আগে ঢেউ আসবেই। আমার বেলায়ও তাই। তুমি যে প্রার্থনা করতে যাচ্ছ, তার জন্য আনন্দিত। মেথডিষ্টদের একটা শিবির-সভা ডাক না কেন? তাতে আরও তাড়াতাড়ি ফল হবে নিশ্চয়।

সব রকম ভাবালুতা ও আবেগ দূর করতে আমি বদ্ধপরিকর, আমাকে আর কখনও আবেগ বিহ্বল হতে দেখলে আমার গলায় দড়ি দিও। আমি হলাম অদ্বৈতবাদী; জ্ঞান আমাদের লক্ষ্য—ভাবাবেগ নয়, ভালবাসা নয়, কিছু নয়—কারণ ঐসব জিনিষ ইন্দ্রিয় বা কুসংস্কার বন্ধনের অন্তর্ভুক্ত। আমি সৎস্বরূপ, চিৎস্বরূপ।

গ্রীনএকারে তুমি নিশ্চই বিশ্রামের সুযোগ পাবে। সেখানে আনন্দে ভরপুর হয়ে থাক—এই চাই। আমার জন্য মুহূর্তের দুশ্চিন্তাও কর না। ‘মা’ আমাকে দেখছেন। ভাবাবেগের নরক থেকে তিনি আমাকে উদ্ধার করে আনছেন, উত্তীর্ণ করে দিচ্ছেন বিশুদ্ধ যুক্তিবিচারের আলোকে। তুমি সুখী হও, এই আমার সতত শুভেচ্ছা।

তোমার ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

পুনঃ—মার্গট ২৬ তারিখে যাত্রা করবে। সপ্তাহখানেক বা সপ্তাহ-দুয়েক পরে আমিও যেতে পারি। আমার উপরে কারও কোন অধিকার নেই, কারণ আমি আত্মস্বরূপ। কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার নেই।

বি

তোমার চিঠিটা হজম করতে পারিনি, কারণ গত কয়েকদিন অজীর্ণতা কিছু বেশী রকম ছিল।

বি

সর্ববসময়ে আমার অনাসক্তি বিদ্যমান ছিলই। এক মুহূর্তেই আবার তা এসে গিয়েছে। শীঘ্রই আমি এমন জায়গায় দাঁড়াচ্ছি, যেখানে কোন ভাবালুতা বা হৃদয়াবেগ আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না।

বি
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৮৩
নিউ ইয়র্ক
২ জুলাই, ১৯০০

প্রিয় নিবেদিতা.
… ‘মা-ই সব জানেন’—এ কথা আমি প্রায়ই বলি। মায়ের নিকট প্রার্থনা কর। নেতা হওয়া বড় কঠিন। সঙ্ঘের পায়ে যথাসর্বস্ব—এমন কি নিজের সত্তা পর্যন্ত নেতাকে বিসর্জন দিতে হয়।


তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৮৪
[মিসেস মেরী হেলকে লিখিত]

102 E 58th St., নিউ ইয়র্ক
১১ জুলাই, ১৯০০

প্রিয় ভগিনী,
তোমার চিঠি পেয়ে ও গ্রীনএকার যাচ্ছ জেনে আনন্দিত হয়েছি। আশা করি, তোমার অনেক উপকার হবে। লম্বা চুল কেটে ফেলার জন্য আমি সকলের কাছে তিরস্কৃত হচ্ছি। দুঃখেরই বিষয়; তুমি জোর করেছিলে বলেই আমি তা করেছিলাম।

ডেট্রয়েট গিয়েছিলাম, গতকাল ফিরে এসেছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফ্রান্সে যেতে চেষ্টা করছি, সেখান থেকে ভারতে। এখানকার খবর প্রায় কিছুই নেই; কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আহার ও নিদ্রা নিয়মিতভাবে চালিয়ে যাচ্ছি—বস্‌, এই পর্যন্ত।

চিরবিশ্বস্ত ও স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

পুনঃ—চিকাগোয় আমার নামে কোন চিঠিপত্র এসে থাকলে মেয়েদের লিখো পাঠিয়ে দিতে।
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৮৫

102 East 58th St., নিউ ইয়র্ক
১৮ জুলাই, ১৯০০

প্রিয় তুরীয়ানন্দ,
তোমার চিঠি ঠিকানা-বদল হয়ে আমার কাছে এসে পৌঁছেছে। ডেট্রয়েটে মাত্র তিন দিন ছিলাম। নিউ ইয়র্কে এখন ভয়ঙ্কর গরম। গত সপ্তাহে তোমার নামে ভারতের কোন ডাক ছিল না। নিবেদিতার কাছ থেকে এখনও কোন চিঠি পাইনি।

আমাদের সব ব্যাপার একই-ভাবে চলছে। উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। অগষ্ট মাসে মিস মূলার আসতে পারবেন না। তাঁর জন্য আমি অপেক্ষা করব না। পরের ট্রেনটি ধরব। সেটা যাওয়া পর্যন্ত যাওয়া অপেক্ষা কর। মিস বুককে (Miss Boocke) ভালবাসা।

প্রভুসমীপে তোমার
বিবেকানন্দ

পুনঃ—প্রায় এক সপ্তাহ পূর্বে কালী পাহাড়ে চলে গেছে। সেপ্টেম্বরের আগে ফিরতে পারবে না। আমি একেবারে একা … আমি তাই ভালবাসি। আমার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেছ কি? তাদের আমার ভালবাসা।

বি
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৮৬

102 East 58th St., নিউ ইয়র্ক
২০ জুলাই, ১৯০০
প্রিয় জো,
এ চিঠি তোমার কাছে পৌঁছবার আগেই—যে-রকম ষ্টীমার মিলবে সেইমত আমি হয়তো ইওরোপে—লণ্ডনে বা প্যারিসে—পৌঁছে যাব।

এখানে আমার কাজটা সহজ করে নিয়েছি। মিঃ হুইটমার্শের পরামর্শে মিস ওয়াল্ডোর হাতে কাজগুলি দেওয়া হয়েছে।

পাথেয় এবং জাহাজ—দুয়েরই ব্যবস্থা করতে হবে। বাকী ‘মা’ জানেন।

আমার ‘অন্তরঙ্গ’ বন্ধু এখনও অবতীর্ণ হননি। তিনি লিখেছেন, অগষ্টের কোন এক সময়ে তিনি আসবেন; একজন হিন্দুকে দেখবার জন্য তাঁর প্রাণ কণ্ঠায় এসে ঠেকেছে এবং ভারতমাতার জন্য তাঁর আত্মা নিরন্তর পুড়ে খাক হচ্ছে।

তাঁকে লিখেছি, লণ্ডনে তাঁর সঙ্গে দেখা হতে পারে। তাও মা জানেন। মিসেস হাণ্টিংটন মার্গটকে ভালবাসা জানিয়েছেন এবং তার কাছ থেকে সংবাদ আশা করেছেন, অবশ্য সে যদি তার বৈজ্ঞানিক প্রদর্শনী নিয়ে খুব ব্যস্ত না থাকে।

ভারতের ‘পবিত্র গাভী’কে, তোমাকে, লেগেটদের, মিস অমুককে (কি যেন তাঁর নাম?), আমেরিকান রবার গাছকে—সকলকে ভালবাসা।

সতত প্রভুসমীপে তোমার
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৮৭

102 East 58th St., নিউ ইয়র্ক
২৪ জুলাই, ১৯০০
প্রিয় জো,
সূর্য=জ্ঞান; তরঙ্গায়িত জল=কর্ম; পদ্ম=প্রেম; সর্প=যোগ; হংস=আত্মা; উক্তিটি=হংস (অর্থাৎ পরমাত্মা) আমাদিগকে উহা প্রেরণ করুন।২৭ এটি হৃৎ-সরোবর। কল্পনাটি তোমার কেমন লাগে?২৮ যা হোক, হংস যেন তোমায় এ সমস্ত দিয়ে পরিপূর্ণ করেন।

আগামী বৃহস্পতিবারের ফরাসী জাহাজ ‘লা শ্যাম্পেন’-এ আমার যাত্রা করার কথা আছে।

Waldo and Whitmarsh কোম্পানীর বইগুলি কাছে আছে এবং ছাপার মত প্রায় প্রস্তুত হয়েছে।

আমি ভাল আছি, ক্রমে স্বাস্থ্যলাভ করছি—আগামী সপ্তাহে তোমার সঙ্গে দেখা হওয়া পর্যন্ত ঠিকই থাকব। ইতি

সতত প্রভুপদাশ্রিত
তোমাদের বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৮৮

102 East 58th St., নিউ ইয়র্ক
২৫ জুলাই, ১৯০০

প্রিয় তুরীয়ানন্দ,
মিসেস হ্যান‍্স‍্‍বার্গের একখানি চিঠিতে জানলাম যে, তুমি তাঁদের ওখানে গিয়েছিলে। তাঁরা তোমাকে খুব পছন্দ করেন এবং আমার বিশ্বাস, তুমিও বুঝতে পেরেছ তাঁদের বন্ধুত্ব কত অকৃত্রিম, পবিত্র ও স্বার্থলেশশূন্য। আমি কাল পারি (Paris) যাত্রা করছি, যোগাযোগ সব ঠিক হয়ে এসেছে। কালী এখানে নেই। আমি চলে যাচ্ছি বলে সে একটু ভাবিত হয়ে পড়েছে—কিন্তু এ ছাড়া উপায় কি?

6 Place Des Etats Unis, Paris, France—মিঃ লেগেটের এই ঠিকানায় অতঃপর আমায় পত্র লিখবে। মিসেস ওয়াইকফ্, হ্যান‍্স‍্‍বার্গ ও হেলেনকে আমার ভালবাসা জানাবে। সমিতিগুলির কাজ আবার একটু শুরু করে দাও এবং মিসেস হ্যান‍্স‍্‍বার্গকে বল, তিনি যেন সময়মত সব চাঁদা আদায় করেন, আর টাকা তুলে ভারতে পাঠিয়ে দেন; কারণ সারদা জানিয়েছে, তাদের বড় টানাটানি চলছে। মিস বুলকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাবে। আমার অসীম ভালবাসা জানবে। ইতি

সতত প্রভুপদাশ্রিত
তোমাদের বিবেকানন্দ

পুনঃ—বলি হাঁস কেমন? ‘তারা পদ্মবনে হংস সনে হংসীরূপে করে রমণ।’২৯
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৮৯
[মায়াবতী ‘অদ্বৈত আশ্রমে’র জনৈক সাধুকে লিখিত]

নিউ ইয়র্ক
অগষ্ট, ১৯০০

কল্যাণবরেষু,
তোমার এক পত্র পাইয়াছিলাম। এতদিন জবাব দিতে পারি নাই। তোমার সুখ্যাতি মিঃ সেভিয়ার তাঁর পত্রে করেছেন। তাতে আমি বিশেষ খুশী হলাম।

তোমরা কে কি কর ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খ লিখে আমায় পত্র লিখবে। তোমার মাকে পত্র লিখ না কেন? ও কি কথা? মাতৃভক্তি সকল কল্যাণের কারণ। তোমার ভাই কলিকাতায় পড়ছে-শুনছে কেমন?

তোদের সব আনন্দ-দের নাম মনেও থাকে না—কোন‍্টাকে কি বলি! সবগুলোকে এক সাঁটে আমার ভালবাসা দিবি। খগেনের শরীর বেশ সেরে গেছে খবর পেয়েছি—বড়ই সুখের কথা। তোদের—সেভিয়াররা যত্ন করে কিনা সব লিখবি। দীনুর শরীরও ভাল আছে—বড় সুখের বিষয়। কালী-ছোকরার একটু মোটা হবার tendency (প্রবণতা) আছে; তার পাহাড় চড়াই-উৎরাইতে সে-সব সেরে যাবে নিশ্চিত। স্বরূপকে বলবি, আমি তার কাগজ চালানোতে বিশেষ খুশী। He is doing splendid work (সে চমৎকার কাজ করছে)।

আর সকলকে আমার আশীর্বাদ ভালবাসা দিবি। আমার শরীর সেরে গেছে—সকলকে বলিস। আমি এখান থেকে ইংলণ্ড হয়ে শীঘ্রই ভারতবর্ষে যাচ্ছি।

সাশীর্বাদং
বিবেকানন্দস্য
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৯০

৬ প্লাস দে-জেতাৎ ইনি
প্যারিস
১৩ অগষ্ট, ১৯০০
হরি ভাই,
তোমার ক্যালিফোর্নিয়া হতে পত্র পেলুম। তিনজনের ভাব হতে লাগল, মন্দ কি? ওতেও অনেক কাজ হয়। শ্রী—মহারাজ জানেন। যা হয় হতে দাও। তাঁর কাজ তিনি জানেন, তুমি আমি চাকর বৈ তো নই!

এ চিঠি সান ফ্রান্সিস্কোতে পাঠাই—মিসেস পানেলের কেয়ারে।

নিউ ইয়র্কের সামান্য সংবাদ পেয়েছি এইমাত্র। তারা আছে ভাল। কালী প্রবাসে। তুমি সান ফ্রান্সিস্কোতে ‘কিমাসীত, প্রভাষেত, ব্রজেত, কিম্’৩০ লিখ। আর মঠে টাকা পাঠাবার কথাটায় গাফিলা হয়ো না। লস্ এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিস্কো হতে যেন অবশ্য অবশ্য টাকা মাসে মাসে যায়।

আমি এক রকম বেশ আছি। শীঘ্রই ইংলণ্ডে যাত্রা। শরতের সংবাদ পাচ্ছি। তার মধ্যে আমাশা হয়েছে। আর সকলে আছে ভাল। ম্যালেরিয়া এবার কাউকে ধরেনি। গঙ্গার উপর বড় ধরেও না। এবার বর্ষা কম হওয়ায় বাঙলাদেশেও আকালের ভয়।

কাজ করে যাও, ভায়া, মায়ের কৃপায়; মা জানেন, তুমি জান—আমি। খালাস! আমি এখন জিরেন নিতে চললুম। ইতি

স্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ

*******************

পত্র সংখ্যা (৪৯১-৫০০)

পত্র সংখ্যা (৪৯১-৫০০)

পত্র সংখ্যা - ৪৯১
[জন ফক্সকে লিখিত]
ব্যুলেভার হ্যান্স সুয়ান্
প্যারিস
১৪ অগষ্ট, ১৯০০
অনুগ্রহপূর্বক মহিমকে লিখে জানাবেন যে, সে যা-ই করুক না কেন, আমার আশীর্বাদ সে সর্বদাই পাবে। বর্তমানে সে যা করছে, তা নিশ্চয়ই ওকালতি ইত্যাদির চেয়ে ঢের ভাল।আমি বীরত্ব ও সাহসিকতা পছন্দ করি, আর আমার জাতির পক্ষে ঐরূপ তেজস্বিতার বিশেষ প্রয়োজন। তবে আমার স্বাস্থ্য ভেঙে যাচ্ছে এবং আমি বেশী দিন বাঁচবার আশা রাখি না; সুতরাং সে যেন মা ও সমস্ত পরিবারের ভার নেবার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। যে কোন মুহূর্তে আমি চোখ বুজতে পারি। আমি তার জন্য এখন খুব গর্ব অনুভব করছি।

ইতি
আপনার স্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৯২

৬ প্লাস দে-জেতাৎ ইনি
প্যারিস
অগষ্ট, ১৯০০
হরিভাই,
এক্ষণে ফ্রান্স দেশের সমুদ্রতটে অবস্থান করছি। Congress of History of Religions (ধর্মেতিহাস সম্বেলন) হয়ে গেছে। সে কিছুই নয়, জন কুড়ি পণ্ডিতে পড়ে শালগ্রামের উৎপত্তি, যিহোবার উৎপত্তি ইত্যাদি বক‍্‍বাদ করেছে। আমিও খানিক বক‍্‍বাদ তায় করেছি।

আমার শরীর-মন ভেঙে গেছে। বিশ্রাম অত্যাবশ্যক। তার উপর একে নির্ভর করবার লোক কেউ নেই, তায় আমি যতক্ষণ থাকব, আমার উপর ভরসা করে সকলে অত্যন্ত স্বার্থপর হয়ে যাবে।

… লোকের সঙ্গে ব্যবহার করতে গেলে দিনরাত মনঃকষ্ট। কাজেই … সব লিখে-পড়ে আলাদা হয়ে গেছি। এখন আমি লিখে দিচ্ছি যে, কারও একাধিপত্য থাকবে না। সমস্ত কাজ majority-র (অধিকাংশের) হুকুমে হবে … সেই মত ট্রাষ্ট ডীড‍্ করিয়ে নিলেই আমি বাঁচি।

এ বৃত্তান্ত ঐ পর্যন্ত। এখন তোমরা যা হয় কর। আমার কাজ আমি করে দিয়েছি বস্‌। গুরুমহারাজের কাছে ঋণী ছিলাম—প্রাণ বার করে আমি শোধ দিয়েছি। সে কথা তোমায় কি বলব? … দলিল করে পাঠিয়েছে সর্বেসর্বা কত্তাত্তির! কত্তাত্তি ছাড়া বাকী সব সই করে দিয়েছি!

গঙ্গাধর, তুমি, কালী, শশী, নূতন ছেলেরা—এদের ঠেলে ঐ রাখাল ও বাবুরামকে কত্তা করে দিচ্ছি। গুরুদেব বড় বলতেন। এ তাঁর কাজ। … প্রাণ ধরে সই করে দিয়েছি। এখন থেকে যা করব, সে আমার কাজ।

আমি এখন আমার কাজ করতে চললুম। গুরুমহারাজের ঋণ৩১ প্রাণ বার করে শুধে দিয়েছি। তাঁর আর দাবী-দাওয়া নেই।

তোমরা যা করছ, ও গুরুমহারাজের কাজ, করে যাও। আমার যা করবার করে দিয়েছি, বস্। ও-সব সম্বন্ধে আমায় আর কিছু লিখো না, বল না, ওতে আমার মতামত একদম নেই। … এখন থেকে অন্য রকম। … ইতি

নরেন্দ্র

পুঃ—সকলকে আমার ভালবাসা।

*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৯৩

৬ প্লাস দে-জেতাৎ ইনি
প্যারিস
২৫ অগষ্ট, ১৯০০
কল্যাণীয়া নিবেদিতা,
এইমাত্র তোমার চিঠি পেলাম; সহৃদয় কথাগুলির জন্য তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ। আমি মিসেস বুলকে মঠ থেকে টাকা তুলে নেবার সুযোগ দিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি ও-বিষয়ে কিছু বললেন না, আর এদিকে ট্রাষ্টের দলিলগুলি দস্তাখতের জন্য পড়েছিল; সুতরাং আমি ব্রিটিশ কনসালের আফিসে গিয়ে সই করে দিয়েছি। কাগজপত্র এখন ভারতের পথে। এখন আমি স্বাধীন, আর কোন বাঁধাবাঁধির ভিতর নেই, কারণ কার্যব্যাপারে আমার আর কোন ক্ষমতা, কর্তৃত্ব বা পদ রাখিনি। রামকৃষ্ণ মিশনের সভাপতির পদও আমি ত্যাগ করেছি।

এখন মঠাদি সব আমি ছাড়া রামকৃষ্ণের অন্যান্য সাক্ষাৎ শিষ্যদের হাতে গেল। ব্রহ্মানন্দ এখন সভাপতি হলেন, তারপর উহা প্রেমানন্দ ইত্যাদির উপর ক্রমে ক্রমে পড়বে।

এখন এই ভেবে আমার আনন্দ হচ্ছে যে, আমার মাথা থেকে এক মস্ত বোঝা নেমে গেল! আমি এখন নিজেকে বিশেষ সুখী বোধ করছি।

কুড়িটি বছর রামকৃষ্ণের সেবা করলাম—তা ভুলের ভিতর দিয়েই হোক বা সাফল্যের ভিতর দিয়েই হোক—এখন আমি কাজ থেকে অবসর নিলাম। বাকী জীবন আপনভাবে কাটাব।

আমি এখন আর কারও প্রতিনিধি নই বা কারও কাছে দায়ী নই। বন্ধুদের কাছে আমার একটা অস্বাভাবিক বাধ্যবাধকতা-বোধ ছিল। এখন আমি বেশ করে ভেবেচিন্তে দেখলাম—আমি কারও কিছু ধার ধারি না। আমি তো দেখছি, প্রাণ পর্যন্ত পণ করে আমার সমুদয় শক্তি প্রয়োগ করেছি, পরিবর্তে পেয়েছি (বন্ধুদের) তর্জন-গর্জন, অনিষ্ট-চেষ্টা ও বিরক্তিকর ঝামেলা।

তোমার চিঠি পড়ে মনে হল, তুমি মনে করেছ, তোমার নূতন বন্ধুদের উপর আমি ঈর্ষান্বিত। আমি কিন্তু তোমাকে চিরদিনের জন্য জানিয়ে রাখছি—আমার অন্য যে-কোন দোষ থাক না কেন, জন্ম থেকেই আমরা ভিতর ঈর্ষা, লোভ বা কর্তৃত্বের আকাঙ্ক্ষা নেই।

আমি আগেও কখনও তোমাকে কোন আদেশ করিনি, এখন তো কাজের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই—এখন আর কি আদেশ দেব? আমি কেবল এই পর্যন্ত জানি যে, যতদিন তুমি সর্বান্তঃকরণে মায়ের সেবা করবে, ততদিন তিনিই তোমাকে ঠিক পথে চালিয়ে নেবেন।

তুমি যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছ, তাদের সম্বন্ধে আমার কখনও কোন ঈর্ষা নেই। কোন কিছুতে মেলামেশা করার জন্য আমি কখনও আমার ভাইদের সমালোচনা করিনি। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস—পাশ্চাত্যদেশীয় লোকদের এই একটা বিশেষত্ব আছে যে, তারা নিজেরা যেটা ভাল মনে করে, সেটা অন্যের উপর জোর করে চাপাবার চেষ্টা করে, তারা ভুলে যায় যে, একজনের পক্ষে যেটা ভাল, অন্যের পক্ষে সেটা ভাল নাও হতে পারে। আমার ভয়, তোমার নূতন বন্ধুদের সঙ্গে মেশার ফলে তোমার মন যেদিকে ঝুঁকবে, তুমি অন্যের উপর জোর করে সেই ভাব দেবার চেষ্টা করবে। কেবল এই কারণেই আমি কখনও কখনও কোন বিশেষ প্রভাব থেকে তোমায় দূরে রাখার চেষ্টা করেছিলাম, এর অন্য কোন কারণ নেই। তুমি তো স্বাধীন, তোমার পছন্দমত নিজের কাজ বেছে নাও।

আমি এইবার সম্পূর্ণ অবসর নিতে ইচ্ছা করেছিলাম, কিন্তু এখন দেখছি মায়ের ইচ্ছা—আমি আমার আত্মীয়দের জন্য কিছু করি। ভাল, বিশ বছর আগে আমি যা ত্যাগ করেছিলাম, আনন্দের সঙ্গে আবার তা ঘাড়ে নিলাম। বন্ধু শত্রু—সকলেই তাঁর হাতের যন্ত্রস্বরূপ হয়ে সুখ বা দুঃখের ভিতর দিয়ে আমাদের কর্মক্ষয় করার সাহায্য করছে। সুতরাং ‘মা’ তাদের সকলকে আশীর্বাদ করুন। আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি

তোমার চিরস্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৯৪

প্যারিস
২৮ অগষ্ট, ১৯০০
কল্যাণীয়া নিবেদিতা,
এই তো জীবন—শুধু কঠোর পরিশ্রম! আর তা ছাড়া কীই বা আমাদের করবার আছে? কঠোর পরিশ্রম কর! একটা কিছু ঘটবে, একটা পথ খুলে যাবে। আর যদি তা না হয়—হয়তো কখনও হবে না,—তাহলে তারপর কী? আমাদের যা কিছু উদ্যম সবই হচ্ছে সাময়িক ভাবে সেই চরম পরিণতি মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা! অহো, মহান্ সর্বদুঃখহর মৃত্যু! তুমি না থাকলে জগতের কী অবস্থাই না হত!

ডেট্রয়েট গিয়েছিলাম, গতকাল ফিরে এসেছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফ্রান্সে যেতে চেষ্টা করছি, সেখান থেকে ভারতে। এখানকার খবর প্রায় কিছুই নেই; কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আহার ও নিদ্রা নিয়মিতভাবে চালিয়ে যাচ্ছি—বস্‌, এই পর্যন্ত।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, বর্তমানে প্রতীয়মান এই জগৎ সত্য নয়, নিত্যও নয়। এর ভবিষ্যৎই বা আরও ভাল হবে কি করে? সেও তো বর্তমানেরই ফলস্বরূপ; সুতরাং আরও খারাপ না হলেও ভবিষ্যৎ বর্তমানেরই অনুরূপ হবে!

স্বপ্ন, অহো! কেবলই স্বপ্ন! স্বপ্ন দেখে চল! স্বপ্ন—ইন্দ্রজালই এ জীবনের হেতু, আবার ওর মধ্যেই এ জীবনের প্রতিবিধানও নিহিত রয়েছে। স্বপ্ন, স্বপ্ন, কেবলই স্বপ্ন! স্বপ্ন দিয়েই স্বপ্ন ভাঙ।

আমি ফরাসী ভাষা শিখতে চেষ্টা করছি এবং এখানে—র সঙ্গে কথা বলছি। অনেকে ইতোমধ্যেই প্রশংসা করছেন। সারা দুনিয়ার সঙ্গে এই অন্তহীন গোলাকধাঁধার কথা, অদৃষ্টের এই সীমাহীন নাটাই-এর (spool) কথা—যার সুতার শেষ কেউ পায় না, অথচ প্রত্যেকে অন্ততঃ তখনকার মত মনে করে যে, সে তা বের করে ফেলেছে আর তাতে অন্ততঃ তার নিজের তৃপ্তি হয় এবং কিছুকালের মত সে নিজেকে ভুলিয়ে রাখে—এই তো ব্যাপার?

ভাল কথা, এখন বড় বড় কাজ করতে হবে। কিন্তু বড় কাজের জন্য মাথা ঘামায় কে? ছোট কাজই বা কিছু করা হবে না কেন? একটার চেয়ে অন্যটা তো হীন নয়। গীতা তো ছোটর মধ্যে বড়কে দেখতে শেখায়। ধন্য সেই প্রাচীন গ্রন্থ!

শরীরের বিষয় চিন্তা করবার খুব বেশী সময় আমার ছিল না। কাজেই শরীর ভাল আছে—ধরে নিতে হবে। এ সংসারে কিছুই চিরদিন ভাল নয়। তবে মাঝে মাঝে আমরা ভুলে যাই—ভাল হচ্ছে শুধু ভাল হওয়া ও ভাল করা।

ভালই হোক আর মন্দই হোক, আমরা সকলেই এ সংসারে নিজ নিজ অংশ অভিনয় করে যাচ্ছি। যখন স্বপ্ন ভেঙে যাবে এবং আমরা রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে যাব, তখন এ সব বিষয়ে আমরা শুধু প্রাণ খুলে হাসব। এই কথাটুকু আমি নিশ্চয় বুঝেছি। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৯৫
[স্বামী তুরীয়ানন্দকে লিখিত]
প্যারিস
১ সেপ্টেম্বর, ১৯০০

প্রেমাস্পদেষু,
তোমার পত্রে সমস্ত সমাচার অবগত হলুম। পূর্বে সান ফ্রান্সিস্কো হতে পুরো বেদান্তী ও ‘হোম্ অব্ ট্রুথ’ (Home of Truth)-দের মধ্যে কিঞ্চিৎ গোলমালের আভাস পেয়েছি, একজন লিখেছিল ও-রকম হয়েই থাকে, বুদ্ধি করে সকলকে সন্তুষ্ট রেখে কাজ চালিয়ে দেওয়াই বিজ্ঞতা।

আমি এখন কিছুদিন অজ্ঞাতবাস করছি। ফরাসীদের সঙ্গে থাকব তাদের ভাষা শিখবার জন্য। এক-রকম নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে, অর্থাৎ ট্রাষ্ট ডীড্-ফিড্ সই করে কলিকাতায় পাঠিয়েছি; আমার আর কোন স্বত্ব বা অধিকার রাখি নাই। তোমরা এখন সকল বিষয়ে মালিক, প্রভুর কৃপায় সকল কাজ করে নেবে।

আমার আর ঘুরে ঘুরে মরতে ইচ্ছা বড় নাই। এখন কোথাও বসে পুঁথিপাটা নিয়ে কালক্ষেপ করাই যেন উদ্দেশ্য। ফরাসী ভাষাটা কতক আয়ত্ত হয়েছে, কিন্তু দু-একমাস তাদের সঙ্গে বসবাস করলে বেশ কথাবার্তা কইতে অধিকার জন্মাবে।

এ ভাষাটা আর জার্মান—এ দুটোয় উত্তম অধিকার জন্মালে এক-রকম ইওরোপী বিদ্যায় যথেষ্ট প্রবেশ লাভ হয়। এ ফরাসীর লোক কেবল মস্তিষ্ক-চর্চা, ইহলোক-বাঞ্ছা; ঈশ্বর বা জীব—কুসংস্কার বলে দৃঢ় ধারণা, ও-সব কথা কইতে চায় না!!! আসল চার্বাকের দেশ! দেখি, প্রভু কি করেন! তবে এদেশ হচ্ছে প্রাশ্চাত্য সভ্যতার শীর্ষ। পারি নগরী পাশ্চাত্য সভ্যতার রাজধানী।

প্রচার-সংক্রান্ত সমস্ত কাজ হতে আমায় বিরাম দাও, ভায়া। আমি ও-সব থেকে এখন তফাত, তোমরা করে-কর্মে নাও। আমার দৃঢ় ধারণা ‘মা’ এখন আমা অপেক্ষা তোমাদের দ্বারা শতগুণ কাজ করাবেন।

কালীর এক পত্র অনেক দিন হল পেয়েছিলাম। সে এতদিন বোধ হয় নিউ ইয়র্কে এসেছে। মিস ওয়াল্ডো মধ্যে মধ্যে খবর নেয়।

আমার শরীর কখনও ভাল, কখনও মন্দ। মধ্যে আবার সেই মিসেস মিল্টনের হাতঘষা চিকিৎসা হচ্ছে। সে বলে তুমি ভাল হয়ে গেছ already (ইতোমধ্যেই)! এই তো দেখছি যে—এখন পেটে বায়ু হাজার হোক—চলতে হাঁটতে চড়াই করতেও কোন কষ্ট হয় না। প্রাতঃকালে খুব ডন-বৈঠক করি। তারপর কালা জলে এক ডুব!!

কাল যার কাছে থাকব, তার বাড়ী দেখে এসেছি। সে গরীব মানুষ—scholar (পণ্ডিত); তার ঘরে একঘর বই, একটা ছ-তলার ফ্ল্যাটে থাকে। তায় এদেশে আমেরিকার মত লিফ‍্‍ট নেই—চড়াই-ওতরাই। ওতে কিন্তু আমার আর কষ্ট হয় না।

সে বাড়ীটির চারিধারে একটি সুন্দর সাধারণ পার্ক আছে। সে লোকটি ইংরেজী কইতে পারে না, সেই জন্য আরও যাচ্ছি। কাজে কাজেই ফরাসী কইতে হবে আমায়। এখন মায়ের ইচ্ছা। বাকী তাঁর কাজ, তিনিই জানেন। ফুটে তো বলেন না, ‘গুম্ হোকে রহতী হ্যায়’, তবে মাঝখান থেকে ধ্যান-জপটা তো খুব হয়ে যাচ্ছে দেখছি।

মিস বুক, মিস বেল, মিসেস এস্পিনেল, মিস বেকহাম, মিঃ জর্জ, ডাক্তার লোগান প্রভৃতি সকল বন্ধুদের আমার ভালবাসা দিও ও তুমি নিজে জেনো।

তথা লস্ এঞ্জেলেসের সকলকে আমার ভালবাসা। ইতি

বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৯৬
প্যারিস
সেপ্টেম্বর, ১৯০০
প্রিয় তুরীয়ানন্দ,
Just now received your letter (এইমাত্র তোমার পত্র পেলাম)। মায়ের ইচ্ছায় সমস্ত কাজ চলে যাবে, ভয় খেও না। আমি শীঘ্রই এখান হতে অন্যত্র যাব। বোধ হয় কনস্তান্তিনোপল্ প্রভৃতি দেশসকল দেখে বেড়াব কিছুদিন। তারপর ‘মা’ জানেন। মিসেস উইলমটের এক পত্র পেলুম। তাতে তো তার খুব উৎসাহ বলেই বোধ হল। নিশ্চিন্ত হয়ে গট হয়ে বস। সব ঠিক হয়ে যাবে। যদি নাদশ্রবণাদি দ্বারা কারও হানি হয় তো ধ্যান ত্যাগ করে দিন কতক মাছ-মাংস খেলেই ও পালিয়ে যাবে। শরীর যদি দুর্বল না হতে থাকে তো কোন ভয়ের কারণ নাই। ধীরে ধীরে অভ্যাস।

তোমার পত্রের জবাব আসবার আগেই আমি এস্থান ত্যাগ করব। অতএব এর জবাব এস্থানে আর পাঠিও না। সারদার৩২ কাগজপত্র সব পেয়েছি, এবং তাকে কয়েক সপ্তাহ হল বহুত লিখে পাঠানো গেছে। আরও পরে পাঠাবার উদ্দেশ্য রইল। আমার যাত্রা এখন কোথা, তার নিশ্চিত নাই। এইমাত্র যে, নিশ্চিন্ত হবার চেষ্টা করছি।

কালীরও এক পত্র আজ পেলাম। তার জবাব কাল লিখব। শরীর এক-রকম গড়মড় করে চলছে। খাটলেই খারাপ, না খাটলেই ভাল, আর কি? মা জানেন । নিবেদিতা ইংলণ্ড গেছে, মিসেস বুল আর তাতে টাকা যোগাড় করছে। কিষেনগড়ের বালিকাগুলিকে নিয়ে সেইখানেই স্কুল করবে তার ইচ্ছা। যা পারে করুক। আমি কোন বিষয়ে আর কিছু বলি না—এই মাত্র। আমার ভালবাসা জানিবে। কিন্তু কার্য সম্বন্ধে কোন বিষয়ে আর আমার কোন উপদেশ নাই। ইতি

দাস
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৯৭
[মিসেস লেগেটকে লিখিত]
প্যারিস
৩ সেপ্টেম্বর, ১৯০০
মা,
এ বাড়িতে আমাদের একটা খেয়ালীদের কংগ্রেস হয়ে গেল। নানা দেশের প্রতিনিধি এসেছিল—দক্ষিণে ভারত থেকে উত্তরে স্কটল্যাণ্ড পর্যন্ত, ইংলণ্ড ও আমেরিকাও তার মধ্যে ছিল।

সভাপতি-নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদের বিশেষ অসুবিধা হয়েছিল, কারণ ডক্টর জেমস্ (Prof. William James) যদিও উপস্থিত ছিলেন, তবু তিনি বিশ্বসমস্যা সমাধানের চেয়ে মিসেস মিল্টন (চৌম্বক আরোগ্যকারী) কর্তৃক তাঁর অঙ্গে উৎপাদিত স্ফোটকগুলি সম্বন্ধে বেশী সচেতন ছিলেন।

আমি জো-র নাম প্রস্তাব করেছিলাম, কিন্তু তিনি তাঁর নূতন গাউন যথাসময়ে এসে না পৌঁছানোর দরুন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং সুবিধাজনক জায়গা থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য এক কোণে প্রস্থান করলেন।

মিসেস বুল তৈরীই ছিলেন, কিন্তু মার্গট প্রতিবাদ করে বললেন, সে ক্ষেত্রে সভাটি তুলনামূলক দর্শনের ক্লাসে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে।

আমরা যখন এ-রকম সঙ্কটাবস্থায় আছি, তখন তড়াক করে এক কোণ থেকে বেঁটেখাট গোলমত একটি মূর্তি লাফিয়ে উঠল এবং বিনা ভূমিকায় ঘোষণা করল—কেবল সভাপতির সমস্যা নয়, জীবনসমস্যা পর্যন্ত সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, যদি আমরা শুধু সূর্যদেবতা ও চন্দ্রদেবতার অর্চনা করি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করেছিলেন, কিন্তু সেটাকে অনুবাদ করতে তাঁর শিষ্যের ঝাড়া পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লেগেছিল। ইতোমধ্যে উক্ত শিষ্যের গুরুদেব আপনাদের বৈঠকখানায় কম্বলাদি টেনে স্তূপাকার করে ফেলেছিলেন এই শুভবাসনায় (যে বাসনার কথা তিনি নিজ মুখেই উচ্চারণ করেছিলেন) যে, তিনি তখনই সেখানে ‘অগ্নিদেবতার’ মহাশক্তির প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিতে চান।

সেই সন্ধিক্ষণে জো বাধা দিলেন এবং একগুঁয়েমির সঙ্গে বললেন, তাঁদের বৈঠকখানায় অগ্নি-যজ্ঞ তাঁর অভিপ্রেত নয়; ফলে উক্ত ভারতীয় ঋষি জো-র দিকে অতি ভয়াবহ চোখে তাকালেন, তাকে তিনি অগ্নি-উপাসনায় সম্পূর্ণ দীক্ষিত বলে সুনিশ্চিত বিশ্বাস করেছিলেন, তার এই এরূপ ব্যবহারে ঋষির বিরক্তির সীমা ছিল না।

তখন ডক্টর জেম‍্‍স‍্ তাঁর স্ফোটকের পরিচর্যা থেকে মাত্র এক মিনিট সময় বাঁচিয়ে সেই অবসরে ঘোষণা করলেন যে, অগ্নিদেবতা এবং তাঁর ভ্রাতৃগণ সম্বন্ধে তাঁর একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় বক্তব্য আছে। তা তিনি উপস্থিত করতেন, যদি স্বদেহে মিল্টনীয় স্ফোটকের ব্যাপারে তাঁকে নিতান্ত কর্মব্যস্ত না থাকতে হত। তদুপরি তাঁর মহান্‌ আচার্য হার্বার্ট স্পেন্সার বিষয়টি সম্বন্ধে তাঁর পূর্বে গবেষণা করেননি বলে ডঃ জেম‍্‍স্ জানালেন, তিনি মহামূল্য নীরবতাকেই দৃঢ়ভাবে আশ্রয় করবেন।

‘চাটনিই সেই বস্তু’—দরজার কাছ থেকে কণ্ঠস্বর শোনা গেল। আমরা সকলে পিছনে তাকালাম। দেখি মার্গট। ‘তা হল চাটনি’—মার্গট বললেন, ‘চাটনি এবং কালীই জীবনের সর্বদুঃখ নিবারণ করবে, তা সকল মন্দকে গিলতে এবং সকল ভালকে চেখে উপভোগ করতে সাহায্য করবে।’ বলতে বলতে তিনি হঠাৎ থেমে গেলেন, সজোরে জানালেন, তিনি আর একটা কথাও মুখ থেকে বার করবেন না, কারণ বক্তৃতাকালে সমবেত শ্রোতাদের মধ্য থেকে জনৈক পুরুষজীবের দ্বারা তিনি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। শ্রোতাদের মধ্যে জনৈক ব্যক্তি জানালার দিকে মাথা ঘুরিয়ে ছিল এবং মহিলার প্রাপ্য মনোযোগ মহিলাকে দিচ্ছিল না, এবং মার্গট যদিও ব্যক্তিগতভাবে স্ত্রী—পুরুষের সমানাধিকারে বিশ্বাসী, তথাপি তিনি ঐ বিরক্তিকর লোকটির নারীজাতির প্রতি যথাবিহিত সৌজন্যের অভাবের কারণ জানতে চান। তখন সকলে জানালেন, তাঁরা মার্গটকে অখণ্ড মনোযোগ দিয়েছেন, সর্বোপরি দিয়েছেন তাঁর প্রাপ্য সমানাধিকার, কিন্তু বৃথা চেষ্টা, এই ভয়াবহ জনতার সঙ্গে মার্গটের আর কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না—মার্গট বসে পড়লেন।

তখন উঠলেন বোষ্টনের মিসেস বুল; তিনি বোঝাতে শুরু করলেন, নরনারীর সত্য সম্পর্ক সম্বন্ধে বোধের অভাব থেকে কিভাবে জগতের সকল সমস্যার উৎপত্তি হয়। তিনি বললেন, ‘সঠিক মানুষের মধ্যে যথার্থ বোঝাপড়া—নরনারীর দাম্পত্য-সম্পর্কের আদর্শকে উন্নত রেখে প্রেমের মধ্যে মুক্তি এবং ঐ মুক্তির মধ্যে মাতৃত্ব ভাতৃত্ব পিতৃত্ব ঈশ্বরত্ব ও স্বাধীনতার সন্ধান—স্বাধীনতার মধ্যে প্রেম এবং প্রেমের মধ্যে স্বাধীনতা দর্শন—এগুলির মধ্যেই আছে সর্বব্যাধির একমাত্র ঔষধ।’

এই কথায় স্কচ প্রতিনিধি প্রবল আপত্তি জানিয়ে বললেন, যেহেতু শিকারী ছাগপালককে তাড়া করেছে, ছাগপালক তাড়া করেছে মেষপালককে, মেষপালক তাড়া করেছে কৃষককে, এবং কৃষক তাড়া করেছে জেলেকে, তাড়া করে তাকে সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে, এখন আমরা গভীর সমুদ্র থেকে জেলেকে উঠিয়ে এনে কৃষকের উপর ফলতে চাই, কৃষককে চাই মেষপালকের উপর ফেলতে ইত্যাদি; এমনি করলেই জীবনের জাল সম্পূর্ণ বোনা হবে এবং আমরা সুখী হব—তাঁকে তাঁর এই তাড়া-করা ব্যাপারে আর বেশীক্ষণ এগোতে দেওয়া হল না। মুহূর্তের মধ্যে সকলে সোজা দাঁড়িয়ে উঠল এবং আমরা কেবলমাত্র কতকগুলি বিমিশ্র বিশৃঙ্খল চীৎকার শুনতে পেলাম—‘সূর্যদেবতা ও চন্দ্রদেবতা’, ‘চাটনি ও কালী’, ‘দাম্পত্য-সম্পর্কে মাতৃত্ব ইত্যাদি সম্বন্ধে সঠিক বোঝাপড়ার স্বাধীনতা’, ‘কখনও নয়, জেলেকে তীরে ফিরে যেতেই হবে’ ইত্যাদি। এই অবস্থায় জো ঘোষণা করলেন, কিছু সময়ের জন্য শিকারী হতে হবে, এবং পাগলামী না থামলে বাড়ীর বাইরে সকলকে তাড়া করে বার করে দিতে তাঁর বড়ই বাসনা হচ্ছে। তখন শান্তি ও নীরবতা ফিরে এল এবং আমি অবিলম্বে আপনাকে লিখতে বসলাম।





আপনার স্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৯৮
প্যারিস, ফ্রান্স
১০ সেপ্টেম্বর, ১৯০০
স্নেহের এলবার্টা,
আজ সন্ধায় নিশ্চয়ই যাচ্ছি; রাজকুমারী৩৩ ও তাঁর ভ্রাতার সঙ্গে দেখা হলে অবশ্যই খুব আনন্দিত হব। যদি বেশী রাত হয়ে যায় এবং এখানে ফিরে আসার অসুবিধা বুঝি, তাহলে তোমাদের বাড়ীতে আমার শোবার একটা জায়গা করে দিতে হবে।



প্রীতি ও আশীর্বাদসহ তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৪৯৯
[মিস এলবার্টা স্টার্জিসকে লিখিত]

Perros Guiree, Bretagne
২২ সেপ্টেম্বর, ১৯০০

মায়ের হৃদয়-বৃত্তি, সংকল্প বীরের,
মধুর পরশখানি কোমল ফুলের,
বেদীতলে লীলাময় পুণ্য হোমানলে
সৌন্দর্যের সাথে শক্তি নিত্য যেথা দোলে;
যে শক্তি চালিত করে, প্রেমে বশ হয়.
সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন—পথ ধৈর্যময়;
আত্মায় বিশ্বাস নিত্য—সকলে তেমন,
ছোট বড় সকলেতে দেবতা দর্শন,
—এই সব আরও যাহা দেখা নাহি যায়,
জগৎ-জননী আজ দিবেন তোমায়।৩৪

সদা প্রীতি ও আশীর্বাদ সহ
তোমার বিবেকানন্দ

প্রিয় এলবার্টা,
তোমার জন্মদিনের উপহার এই ছোট্ট কবিতাটি। লেখাটা ভাল হয়নি, কিন্তু আমার সকল ভালবাসা এতে ঢেলে দিয়েছি। তাই আমি নিশ্চিত যে, তোমার এটা ভাল লাগবে।

দয়া করে প্রত্যেকটি পুস্তিকার এক কপি মাদাম বেসনার্ড (Madame Besnard, Clairoix, Bres Compiegnfs, Oise)-কে পাঠিয়ে আমায় বাধিত করবে কি?

তোমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দস্য
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫০০

6 Place Des Etats Unis, Paris৩৫
অক্টোবর, ১৯০০

প্রিয় মাদমোয়াজেল,
এখানে আমি খুব সুখী ও পরিতৃপ্ত আছি। অনেক বছর পরে ভাল সময় কাটাচ্ছি। মঁ বোয়ার (Bois) সঙ্গে আমার এখনকার জীবনযাত্রা বেশ তৃপ্ত—রাশি রাশি বই, চারিদিকে শান্তি—আমাকে পীড়িত করে এমন জিনিষ এখানে নেই।

কিন্তু জানি না কোন্ নিয়তি আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

আমার (ফরাসী ভাষার) চিঠিটা ভারি মজার, তাই নয় কি? তবে এটা আমার প্রয়াস।

আপনার বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ


*******************

পত্র সংখ্যা (৫০১-৫১০)

পত্র সংখ্যা (৫০১-৫১০)

পত্র সংখ্যা - ৫০১
[সিষ্টার ক্রিষ্টিনিকে লিখিত]
প্যারিস৩৬
১৪ অক্টোবর, ১৯০০
ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রতি পদে তোমার উপর বর্ষিত হোক, প্রিয় ক্রিষ্টিন, এই আমার নিরন্তর প্রার্থনা।

তোমার পরম সুন্দর শান্তিময় চিঠিখানি আমাকে নূতন শক্তি দিয়েছে, যে শক্তি আমি অনেক সময় হারিয়ে ফেলি।

আমি সুখী, হ্যাঁ, সুখী, কিন্তু এখনও মনের মেঘ কাটেনি একেবারে। সে মেঘ দুর্ভাগ্যবশতঃ ফিরে আসে মাঝে মাঝে, কিন্তু পূর্বের মত গ্লানিকর প্রভাব নেই তার।

মঁ জুল বোয়া (M. Jules Bois) নামে একজন বিখ্যাত ফরাসী লেখকের সঙ্গে আছি। আমি তাঁর অতিথি। লেখা থেকে জীবিকা অর্জন করতে হয় তাঁকে, তাই তিনি ধনী নন, কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেক উচ্চ উচ্চ চিন্তার ঐক্য আছে এবং আমরা পরস্পরের সাহচর্যে বেশ আনন্দে আছি।

বছর কয়েক আগে তিনি আমাকে আবিষ্কার করেন, এবং আমার কয়েকটি পুস্তিকা ইতোমধ্যেই ফরাসীতে অনুবাদ করে ফেলেছেন। আমরা দু-জনেই অবশেষে একদিন আমাদের সন্ধানের বস্তুকে পেয়ে যাব, কি বল?

এমনি ভাবেই মাদাম কালভে, মিস ম্যাকলাউড ও মঁ জুল বোয়ার সঙ্গে ঘুরে বেড়াব। খ্যাতনামা গায়িকা মাদাম কালভের অতিথি হব।

কনস্তান্তিনোপল্, নিকট প্রাচ্য, গ্রীস এবং মিশরে যাব আমরা। ফেরার পথে ভেনাস দেখে আসব।

ফিরে আসার পর প্যারিসে কয়েকটি বক্তৃতা দিতে পারি, কিন্তু সেগুলি দেব ইংরেজীতে, সঙ্গে দোভাষী থাকবে।

এ বয়সে একটা নূতন ভাষা শেখার মত সময় বা শক্তি আর নেই। আমি এখন বুড়ো মানুষ, কি বল?

মিসেস ফাঙ্কে (Mrs. Funke) অসুস্থ। তিনি বেজায় খাটেন। আগে থেকেই তাঁর স্নায়ু পীড়া ছিল। আশা করি শীঘ্রই তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।

আমেরিকায় উপার্জিত সব টাকা ভারতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এবার আমি মুক্ত, পূর্বের মত ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসী, মঠের সভাপতির পদও ছেড়ে দিয়েছি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমি মুক্ত! এ ধরনের দায়িত্ব আর আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে না। এমনই স্নায়ুপ্রবণ হয়ে উঠেছি, আর এতই দুর্বল।

‘গাছের শাখায় ঘুমন্ত পাখী রাত পোহালে যেমন জেগে উঠে গান করে’ আর উড়ে যায় গভীর নীলাকাশে, ঠিক তেমনিভাবেই আমার জীবনের শেষ।

জীবনে অনেক কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়েছি, বিরাট সাফল্যও পেয়েছি কখনও কখনও, কিন্তু এই সব বাধা ও বেদনা মূল্যহীন হয়ে গেছে আমার শেষ প্রাপ্তির কাছে—আমি পেয়ে গিয়েছি আমার লক্ষ্যকে; আমি যে মুক্তার সন্ধানে জীবনসমুদ্রে ডুব দিয়েছিলাম, তা তুলে আনতে পেরেছি; আমার পুরস্কার আমি পেয়েছি; আমি আনন্দিত।

তাই মনে হচ্ছে, আমার জীবনের একটা নূতন অধ্যায় খুলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে; ‘মা’ আমাকে সন্তর্পণে সস্নেহে চালিয়ে নিয়ে যাবেন। বিঘ্নসঙ্কুল পথে হাঁটবার চেষ্টা আর নয়, এখন পাখীর পালকের বিছানা। বুঝলে কি? বিশ্বাস কর, তা হবেই; আমি নিশ্চিন্ত।

আমার এ-যাবৎ লব্ধ জীবনের অভিজ্ঞতা আমাকে এই শিক্ষা দিয়েছে যে, ঐকান্তিকভাবে আমি যা চেয়েছি সর্বদা তা পেয়েছি, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। কখনও অনেক দুঃখের পরে তা পেয়েছি, কিন্তু তাতে কি আসে যায়! পুরস্কারের মধুর স্পর্শ সব কিছু ভুলিয়ে দেয়। বন্ধু, তুমিও দুঃখের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছ, তোমার পুরস্কার তুমি পাবে। কিন্তু হায়! এখন তুমি যা পাচ্ছ তা পুরস্কার নয়, অতিরিক্ত দুঃখের বোঝা।

আমার বেলায় দেখছি, মেঘ হালকা হয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে—আমার দুষ্কৃতির মেঘ; আর সুকৃতির জ্যোতির্ময় সূর্য উঠছে। বন্ধু, তোমার বেলায়ও তাই হবে। এই ভাষায় (ফরাসী ভাষায়) ভাবাবেগ প্রকাশ করার মত ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু আবেগকে কোন ভাষাই বা যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারে?

সুতরাং এইখানেই ছেড়ে দিচ্ছি, আমার ভাবনাকে কোমল মধুর উজ্জ্বল হৃদয়ের ভাষায় তুমি মণ্ডিত করবে, এই আশায়। বিদায়।



তোমার বিশ্বস্ত বন্ধু
বিবেকানন্দ

পুনঃ—২৯শে অক্টোবর আমরা ভিয়েনার পথে প্যারিস ছেরে যাব। আগামী সপ্তাহের মধ্যে মিঃ লেগেট যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাচ্ছেন। পোষ্ট অফিসকে আমরা জানিয়ে যাব, তারা যেন আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থলে চিঠিগুলি পাঠিয়ে দেয়।

বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫০২

পোর্ট টাউফিক
২৬ নভেম্বর, ১৯০০
প্রিয় জো,
জাহাজখানির আসতে দেরী হচ্ছে, তাই অপেক্ষা করছি। ভগবানকে ধন্যবাদ যে, আজ জাহাজ পোর্ট সৈয়দে খালের মধ্যে ঢুকেছে। তার মানে, সব ঠিক ঠিক চললে সন্ধ্যায় জাহাজ এখানে (পোর্টে) পৌঁছবে। অবশ্য এ দুদিন যেন নির্জন কারাবাস চলেছে; আর আমি কোনরকমে ধৈর্য ধরে আছি। কিন্তু এরা বলে পরিবর্তনের মূল্য তিনগুণ বেশী। মিঃ গেজের এজেণ্ট আমায় সব ভুল নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রথমতঃ আমায় স্বাগত জানান তো দূরের কথা, কিছু বুঝিয়ে দেবার মত কেউই এখানে ছিল না। দ্বিতীয়তঃ আমায় কেউ বলেনি যে, অন্য জাহাজের জন্য আমাকে এজেণ্টের অফিসে গিয়ে গেজের টিকিটখানি পাল্টে নিতে হবে—আর তা করবার জায়গা সুয়েজ, এখানে নয়। সুতরাং জাহাজখানির দেরী হওয়ায় এক হিসাবে ভালই হয়েছিল। এই সুযোগে আমি জাহাজের এজেণ্যের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম; আর তিনি আমায় নির্দেশ দিলেন, আমি যেন গেজের পাসখানি পাল্টিয়ে যথারীতি টিকিট করে নিই।

আজ রাত্রে কোন এক সময়ে জাহাজে উঠব, আশা করি। আমি ভাল আছি ও সুখে আছি, আর এ মজাটা উপভোগ করছি খুব।

মাদমোয়াজেল কেমন আছেন? বোয়া (Bois) কোথায়? মাদাম কালভেকে আমার চিরকৃতজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা জানাবে। তিনি বড় চমৎকার মহিলা। আশা করি, তোমার ভ্রমণটি উপভোগ্য হবে।

তোমাদের সতত স্নেহশীল
বিবেকানন্দ

*******************

পত্র সংখ্যা - ৫০৩

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
১১ ডিসেম্বর, ১৯০০
প্রিয় জো,
পরশু রাত্রে আমি এখানে পৌঁছেছি। কিন্তু হায়! এত তাড়াহুড়া করে এসেও কোন লাভ হল না। ক্যাপ্টেন সেভিয়ার বেচারা কয়েক দিন পূর্বেই দেহত্যাগ করেছেন। এভাবে দুজন মহাপ্রাণ ইংরেজ আমাদের জন্য—হিন্দুদের জন্য আত্মদান করলেন। শহীদ কোথাও থাকে তো—এঁরাই। মিসেস সেভিয়ারকে এইমাত্র পত্র লিখলাম—তাঁর ভাবী কার্যক্রম জানবার জন্য।

আমি ভাল আছি। এখানকার সবই সবদিক দিয়ে ভালভাবেই চলছে। তাড়াতাড়ি চিঠি লিখলাম—কিছু মনে কর না। শীঘ্র দীর্ঘ পত্র দেব। ইতি

সর্বদা সত্যাশ্রয়ী
তোমাদেরই বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫০৪
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]
মঠ, বেলুড়, হাওড়া
১৫ ডিসেম্বর, ১৯০০

মা,
কয়েক দিন আগে এখানে পৌঁছেছি। আমার আগমন একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল, সকলে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল।

আমার অনুপস্থিতি-কালে আমি যতটা আশা করেছিলাম, কাজ তার চেয়েও ভালভাবে চলেছে; শুধু মিঃ সেভিয়ার দেহত্যাগ করেছেন। এটা সত্যই একটা প্রচণ্ড আঘাত—হিমালয়ে কাজের ভবিষ্যৎ যে কি হবে জানি না। মিসেস সেভিয়ার এখানও সেখানে আছেন এবং আমি রোজই তাঁর কাছ থেকে চিঠি আশা করছি।

সারদানন্দ ও ব্রহ্মানন্দ আগের থেকে ভাল আছে; এ বছর এখানে ম্যালেরিয়া নাই। গঙ্গার ধারের এই ফালি জমিটা সব সময়েই ম্যালেরিয়া-মুক্ত। শুধু প্রচুর বিশুদ্ধ জলের ব্যবস্থা হলেই অবস্থা সর্বাঙ্গসুন্দর হবে। ইতি

বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫০৫

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
১৯ ডিসেম্বর, ১৯০০
কল্যাণীয়া নিবেদিতা,
মহাদেশসমূহের আর একপ্রান্ত থেকে একটি স্বর তোমায় প্রশ্ন করছেঃ ‘কেমন আছ?’ এতে তুমি অবাক হচ্ছ না কি? বস্তুতঃ আমি হচ্ছি ঋতুর সঙ্গে বিচরণকারী একটি বিহঙ্গম।

আনন্দমুখর ও কর্মচঞ্চল প্যারিস, দৃঢ়গঠিত প্রাচীন কনস্তান্তিনোপল্, চাকচিক্যময় ক্ষুদ্র এথেন্স, পিরামিড-শোভিত কায়রো—সবই পেছনে ফেলে এসেছি; আর এখন আমি এখানে, গঙ্গার তীরে মঠে আমার ঘরে বসে লিখছি। চতুর্দিকে কি শান্ত নীরবতা! প্রশস্ত নদী দীপ্ত সূর্যালোকে নাচছে; শুধু ক্বচিৎ দু-একখানা মালবাহী নৌকার দাঁড়ের শব্দে সে স্তব্ধতা ক্ষণিকের জন্য ভেঙে যাচ্ছে।

এখানে এখন শীতকাল চলেছে; কিন্তু প্রতিদিন মধ্যাহ্ন বেশ উষ্ণ ও উজ্জ্বল। এ হচ্ছে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার শীতেরই মত। সর্বত্র সবুজ ও সোনালী রঙের ছড়াছড়ি, আর কচিঘাসগুলি যেন মখমলের মত। অথচ বাতাস শীতল, পরিষ্কার ও আরামপ্রদ। ইতি



তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫০৬
[শ্রীমতী মৃণালিনী বসুকে লিখিত]

দেওঘর, বৈদ্যনাথ
বাবু প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ী
২৩ ডিসেম্বর, ১৯০০
মা,
তোমার পত্র পাইয়া বড়ই আনন্দিত হইলাম; তুমি যা বুঝিয়াছ, তাহা ঠিক। ‘স ঈশ অনির্বচনীয়ঃ প্রেমস্বরূপঃ’—সেই ঈশ্বর অনির্বচনীয় প্রেমস্বরূপ, নারদোক্ত লক্ষণটি যে প্রত্যক্ষ এবং সর্ববাদিসম্মত, আমার জীবনের ইহা স্থিরসিদ্ধান্ত। অনেকগুলি ব্যক্তির একত্র নাম ‘সমষ্টি’, এক-একটির নাম ‘ব্যষ্টি’, তুমি আমি ‘ব্যষ্টি’, সমাজ ‘সমষ্টি’। তুমি আমি পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ বৃক্ষ লতা পৃথিবী গ্রহ নক্ষত্রাদি এক একটি ‘ব্যষ্টি’, আর এই জগৎটি ‘সমষ্টি’—বেদান্তে ইহাকেই বিরাট বা হিরণ্যগর্ভ বা ঈশ্বর বলে। পৌরাণিক ব্রহ্মা, বিষ্ণু, দেবী ইত্যাদি নাম।

ব্যষ্টির ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আছে কিনা এবং কত পরিমাণে হওয়া উচিত, সমষ্টির নিকট ব্যষ্টির একেবারে সম্পূর্ণ আত্মেচ্ছা, আত্মসুখ ত্যাগ করা উচিত কিনা—এই প্রশ্নই সমাজের অনাদি কালের বিচার্য। এই প্রশ্নের সিদ্ধান্ত লইয়াই সকল সমাজ ব্যস্ত; আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজে ইহাই প্রবল তরঙ্গ-রূপ ধারণ করিয়া সমুত্থিত হইয়াছে। যে মতে ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সমাজের প্রভুতার সম্মুখে বলি দিতে চায়, তাহার ইংরেজী নাম সোশ্যালিজম্, ব্যক্তিত্বসমর্থক মতের নাম ইণ্ডিভিজুয়ালিজম্।

সমাজের নিকট ব্যক্তির—নিয়মের ও শিক্ষার শাসন দ্বারা চিরদাসত্বের ও বলপূর্বক আত্মবিসর্জনের কি ফল ও পরিণাম, আমাদের মাতৃভূমিই তাহার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এদেশে লোকে শাস্ত্রোক্ত আইন অনুসারে জন্মায়, ভোজন-পানাদি আজীবন নিয়মানুসারে করে, বিবাহাদিও সেই প্রকার; এমন কি, মরিবার সময়ও সেই সকল শাস্ত্রোক্ত আইন অনুসারে প্রাণত্যাগ করে। এই কঠোর শিক্ষার একটি মহৎ গুণ আছে, আর সকলই দোষ। গুণটি এই যে, দুটি-একটি কার্য পুরুষানুক্রমে প্রত্যহ অভ্যাস করিয়া অতি অল্পায়াসে সুন্দর রকম লোকে করিতে পারে। তিনখানা মাটির ঢিপি ও খানকতক কাষ্ঠ লইয়া এদেশের রাঁধুনী যে সুস্বাদু অন্ন-ব্যঞ্জন প্রস্তুত করে, তাহা আর কোথাও নাই। একটা মান্ধাতার আমলের এক টাকা দামের তাঁত ও একটা গর্তের ভিতরে পা, এই সরঞ্জামে ২০ টাকা গজের কিংখাব কেবল এদেশেই হওয়া সম্ভব। একখানা ছেঁড়া মাদুর, একটা মাটির প্রদীপ, তায় রেড়ির তেল, এই উপাদান-সহায়ে দিগ‍্গজ পণ্ডিত এদেশেই হয়। খেঁদাবোঁচা স্ত্রীর উপর সর্বসহিষ্ণু মহত্ত্ব ও নির্গুণ মহাদুষ্ট পতির উপর আজন্ম ভক্তি এদেশেই হয়! এই তো গেল গুণ।

কিন্তু এই সমস্তগুলিই মনুষ্য প্রাণহীণ যন্ত্রের ন্যায় চালিত হয়ে করে; তাতে মনোবৃত্তির স্ফূর্তি নাই, হৃদয়ের বিকাশ নাই, প্রাণের স্পন্দন নাই, ইচ্ছাশক্তির প্রবল উত্তেজনা নাই, তীব্র সুখানুভূতি নাই, বিকট দুঃখেরও স্পর্শ নাই; উদ্ভাবনা-শক্তির উদ্দীপনা একেবারেই নাই, নূতনত্বের ইচ্ছা নাই, নূতন জিনিষের আদর নাই। এ হৃদয়াকাশের মেঘ কখনও কাটে না, প্রাতঃসূর্যের উজ্জ্বল ছবি কখনও মনকে মুগ্ধ করে না। এ অবস্থার অপেক্ষা কিছু উৎকৃষ্ট আছে কিনা, মনেও আসে না, আসিলেও বিশ্বাস হয় না, বিশ্বাস হলেও উদ্যোগ হয় না, উদ্যোগ হইলেও উৎসাহের অভাবে তাহা মনেই লীন হইয়া যায়।

নিয়মে চলিতে পারিলেই যদি ভাল হয়, পূর্বপুরুষানুক্রমে সমাগত রীতিনীতির অখণ্ড অনুসরণ করাই যদি ধর্ম হয়, বল, বৃক্ষের অপেক্ষা ধার্মিক কে? রেলের গাড়ীর চেয়ে ভক্ত সাধু কে? প্রস্তরখণ্ডকে কে কবে প্রাকৃতিক নিয়মভঙ্গ করিতে দেখিয়াছে? গো-মহিষাদিকে কে কবে পাপ করিতে দেখিয়াছে?

অতি প্রকাণ্ড কলের জাহাজ, মহাবলবান্ রেলের গাড়ীর ইঞ্জিন—তাহারাও জড়; চলে ফেরে, ধাবমান হয়, কিন্তু জড়। আর ঐ যে ক্ষুদ্র কীটাণুটি রেলের গাড়ীর পথ হইতে আত্মরক্ষার জন্য সরিয়া গেল, ওটি চৈতন্যশীল কেন? যন্ত্রে ইচ্ছাশক্তির বিকাশ নাই, যন্ত্র নিয়মকে অতিক্রম করিতে চায় না; কীটটি নিয়মকে বাধা দিতে চায়, পারুক বা নাই পারুক, নিয়মের বিপক্ষে উত্থিত হয়, তাই সে চেতন। এই ইচ্ছাশক্তি যেথায় যত সফল বিকাশ, সেথায় সুখ তত অধিক, সে জীব তত বড়। ঈশ্বরে ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ সফলতা, তাই তিনি সর্বোচ্চ।

বিদ্যাশিক্ষা কাকে বলি? বই পড়া?—না, নানাবিধ জ্ঞানার্জন? তাও নয়। যে শিক্ষা দ্বারা এই ইচ্ছাশক্তি বেগ ও স্ফূর্তি নিজের আয়ত্তাধীন ও সফলকাম হয়, তাহাই শিক্ষা। এখন বোঝ, যে শিক্ষার ফলে এই ইচ্ছাশক্তি ক্রমাগত পুরুষানুক্রমে বলপূর্বক নিরুদ্ধ হইয়া এক্ষণে লুপ্তপ্রায় হইয়াছে, যাহার শাসনে নূতন ভাবের কথা দূরে থাক, পুরাতনগুলিই একে একে অন্তর্হিত হইতেছে, যাহা মনুষ্যকে ধীরে ধীরে যন্ত্রের ন্যায় করিয়া ফেলিতেছে, সে কি শিক্ষা? চালিত যন্ত্রের ন্যায় ভাল হওয়ার চেয়ে স্বাধীন ইচ্ছা—চৈতন্য-শক্তির প্রেরণায় মন্দ হওয়াও আমার মতে কল্যাণকর। আর এই মৃৎপিণ্ডপ্রায়, প্রাণহীন যন্ত্রগুলির মত উপলরাশির ন্যায় স্তূপীকৃত মনুষ্যসমষ্টির দ্বারা যে সমাজ গঠিত হয়, সে কি সমাজ? তাহার কল্যাণ কোথায়? কল্যাণ যদি সম্ভব হইত, তবে সহস্র বৎসরের দাস না হইয়া আমরাই পৃথিবীর সর্বোচ্চ জাতি হইতাম, মহামূর্খতার আকর না হইয়া ভারতভূমিই বিদ্যার চিরপ্রস্রবণ হইত।

তবে কি আত্মত্যাগ ধর্ম নহে? বহুর জন্য একের সুখ—একের কল্যাণ উৎসর্গ করা কি ‍একমাত্র পুণ্য নহে? ঠিক কথা, কিন্তু আমাদের ভাষায় বলে, ‘ঘষে-মেজে রূপ কি হয়?’ ধরে-বেঁধে প্রীত কি হয়?’ চিরভিখারীর ত্যাগে কি মাহাত্ম? ইন্দ্রিয়হীনের ইন্দ্রিয়সংযমে কি পুণ্য? ভাবহীন, হৃদয়হীন, উচ্চ-আশাহীনের, সমাজের অস্তিত্ব-নাস্তিত্ব-জ্ঞানহীনের আবার আত্মোৎসর্গ কি? বলপূর্বক সতীদাহে কি সতীত্বের বিকাশ? কুসংস্কার শিখাইয়া পুণ্য করানোই বা কেন? আমি বলি, বন্ধন খোল, জীবের বন্ধন খোল, যতদূর পার বন্ধন খোল। কাদা দিয়ে কাদা ধোয়া যায়? বন্ধনের দ্বারা কি বন্ধন কাটে? কার কেটেছে? সমাজের জন্য যখন নিজের সুখেচ্ছা বলি দিতে পারবে, তখন তুমিই বুদ্ধ হবে, তুমিই মুক্ত হবে, সে ঢের দূর! আবার তার রাস্তা কি জুলুমের উপর দিয়ে? আহা!! আমাদের বিধবাগুলি কি নিঃস্বার্থ ত্যাগের দৃষ্টান্ত, এমন রীতি কি আর হয়!!! আহা, বাল্য-বিবাহ কি মধুর!! সে স্ত্রী-পুরুষে ভালবাসা না হয়ে কি যায়!!! এই বলে নাকে কান্নার এক ধুয়া উঠেছে। আর পুরুষের বেলা অর্থাৎ যাঁদের হাতে চাবুক, তাঁদের বেলা ত্যাগের কিছুই দরকার নাই। সেবাধর্মের চেয়ে আর কি ধর্ম আছে? কিন্তু সেটা বামুন-ঠাকুরের বেলা নহে, তোমরাই কর। আসল কথা, মা-বাপ আত্মীয়-স্বজন প্রভৃতি এদেশের—নিজের স্বার্থের জন্য, নিজে সামাজিক অবমাননা হইতে বাঁচিবার জন্য পুত্র-কন্যাদি সব নির্মম হইয়া বলিদান করিতে পারেন, এবং পুরুষানুক্রমে শিক্ষা মানসিক জড়ত্ব বিধান করিয়া উহার দ্বারা উন্মুক্ত করিয়াছে। যে বীর, সেই ত্যাগ করিতে পারে; যে কাপুরুষ, সে চাবুকের ভয়ে এক হাতে চোখ মুচছে আর এক হাতে দান করছে, তার দানে কি ফল? জগৎপ্রেম অনেক দূর। চারাগাছটিকে ঘিরে রাখতে হয়, যত্ন করতে হয়। একটিকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতে শিখতে পারলে ক্রমে বিশ্বব্যাপী প্রেমের আশা করা যায়। ইষ্ট-দেবতাবিশেষে ভক্তি হলে ক্রমে বিরাট ব্রহ্মে প্রীতি হতে পারে।

অতএব একজনের জন্য আত্মত্যাগ করতে পারলে তবে সমাজের জন্য ত্যাগের কথা কহা উচিত, তার আগে নয়। সকাম থেকেই নিষ্কাম হয়। কামনা না আগে থাকলে কি কখনও তাহার ত্যাগ হয়? আর তার মানেই বা কি? অন্ধকার না থাকলে কি কখনও আলোকের মানে হয়?

সকাম সপ্রেম পূজাই প্রথম। ছোটর পূজাই প্রথম, তারপর আপনা-আপনি বড় আসবে।

মা, চিন্তিত হয়ো না। বড় গাছেই বড় ঝড় লাগে। কাঠ নেড়ে দিলে বেশী জ্বলে, সাপের মাথায় আঘাত লাগলে তবে সে ফণা ধরে ইত্যাদি।৩৭ যখন হৃদয়ের মধ্যে মহা যাতনা উপস্থিত হয়, চারিদিকে দুঃখের ঝড় উঠে, বোধ হয় যেন এ-যাত্রায় আলো দেখতে পাব না, যখন আশা ভরসা প্রায় ছাড়ে ছাড়ে, তখনই এই মহা আধ্যাত্মিক দুর্যোগের মধ্য হইতে অন্তর্নিহিত ব্রহ্মজ্যোতি স্ফূর্তি পায়। ক্ষীর-ননী খেয়ে, তুলোর উপর শুয়ে, এক ফোঁটা চোখের জল কখনও না ফেলে কে কবে বড় হয়েছে, কার ব্রহ্ম কবে বিকশিত হয়েছে? কাঁদতে ভয় পাও কেন? কাঁদো। কেঁদে কেঁদে তবে চোখের জল সাফ হয়, তবে অন্তর্দৃষ্টি হয়, তবে আস্তে আস্তে মানুষ জন্তু গাছপালা দূর হয়ে তার জায়গায় সর্বত্র ব্রহ্মদর্শন হয়। তখন—

‘সমং পশ্যন্ হি সর্বত্র সমবস্থিতমীশ্বরম্।
ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্॥’

সর্বত্র সমানভাবে বিদ্যমান ঈশ্বরকে জানিয়া নিজে আর নিজেকে হিংসা করেন না (অর্থাৎ সবই তিনি), তখনই পরমা গতি প্রাপ্ত হন।



সদা শুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫০৭
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে নিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
মঠ, বেলুড়
২৬ ডিসেম্বর, ১৯০০

কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্রে সমস্ত অবগত হলুম। শরীর যদি খারাপ হয়, অবশ্য এখানে তোমার আসা উচিত নয়—এবং আমিও কল্য মায়াবতী যাচ্ছি। সেখানে আমার একবার যাওয়া অত্যন্ত আবশ্যক।

আলাসিঙ্গা যদি আসে, আমার প্রত্যাগমন-অপেক্ষা তাকে করতে হবে। কানাই সম্বন্ধে এরা কি করছে—তা জানি না। আমি আলমোড়া হতে শীঘ্র ফিরব, তারপর মান্দ্রাজ যাওয়া হতে পারে। ওয়ানিয়ামবড়ি (Vaniyambadi) হতে এক পত্র পেয়েছি—তাদের আমার আশীর্বাদ ও ভালবাসা জানিয়ে এক পত্র লিখো এবং আমি মান্দ্রাজ আসবার সময় অবশ্য সে-স্থান হয়ে আসব, একথা জানিও। সকলকে আমার ভালবাসা জানাবে। তুমি অতিরিক্ত পরিশ্রম করবে না। আর আর সমস্ত মঙ্গল। ইতি



বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫০৮
মঠ, বেলুড়, হাওড়া
২৬ ডিসেম্বর, ১৯০০
প্রিয় জো,
আজকের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম। সেই সঙ্গে মা এবং এলবার্টার চিঠিও পেলাম। এলবার্টার পণ্ডিত বন্ধুবর রাশিয়া সম্বন্ধে যা বলেছেন, তা প্রায় আমার ধারণারই মত। তাঁর চিন্তার একটা জায়গায় শুধু মুশকিল দেখছি—সমগ্র হিন্দুজাতির পক্ষে এককালে রাশিয়ার ভাবে ভাবিত হওয়া সম্ভব কি?

আমাদের প্রিয় বন্ধু মিঃ সেভিয়ার—আমি পৌঁছবার আগেই দেহত্যাগ করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত আশ্রমের পাশ দিয়ে যে নদীটি প্রবাহিত তারই তীরে হিন্দুরীতিতে তাঁর সৎকার করা হয়েছে। ব্রাহ্মণেরা তাঁর পুষ্পমাল্য-শোভিত দেহ বহন করে নিয়েছিল এবং ব্রহ্মচারীরা বেদধ্বনি করেছিল।

আমাদের আদর্শের জন্য ইতোমধ্যে দু-জন ইংরেজের৩৮ আত্মদান হয়ে গেল। এর ফলে প্রিয় প্রাচীন ইংলণ্ড ও তার বীর সন্তানগণ আমার আরও প্রিয় হয়ে উঠেছে। ইংলণ্ডের শ্রেষ্ঠ শোণিতধারায় ভবিষ্যৎ ভারতের চারাগাছটি মহামায়া যেন বারিসিঞ্চিত করেছেন—মহামায়ারই জয় হউক।

মিসেস সেভিয়ার অবিচলিত আছেন। প্যারিসের ঠিকানায় তিনি আমাকে যে চিঠি লিখেছিলেন, তা এই ডাকে ফিরে এল। আগামী কাল আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পাহাড়ে যাব। ভগবান্‌ তাকে আশীর্বাদ করুন—এই নির্ভয়প্রাণাকে।

আমি নিজে দৃঢ় এবং শান্ত আছি। আজ পর্যন্ত কোন ঘটনা কখনও আমাকে বিচলিত করতে পারেনি; আজও মহামায়া আমাকে অবসন্ন হতে দেবেন না।

শীতাগমের সঙ্গে সঙ্গে এ স্থান বেশ আরামপ্রদ হয়ে উঠেছে। অনাচ্ছাদিত তুষারাবরণে হিমালয় আরও সুন্দর হয়ে উঠবে।

মিঃ জনস্টন নামক যে যুবকটি নিউ ইয়র্ক থেকে রওনা হয়ে এসেছিল, সে ব্রহ্মচর্য-ব্রত গ্রহণ করেছে এবং মায়াবতীতে আছে।

টাকাটা সারদানন্দের নামে মঠে পাঠিয়ে দিও, কারণ আমি পাহাড়ে চলে যাচ্ছি। তারা তাদের সাধ্যমত ভাল কাজই করেছে। আমি খুশী এবং স্নায়বিক বিরক্তির জন্য নিজেকেই বেকুব মনে করছি। তারা বরাবরের মত সৎ ও বিশ্বাসী আছে এবং তাদের শরীরও সুস্থ।

মিসেস বুলকে এ-সকল সংবাদ লিখো এবং বল যে, তিনিই বরাবর ঠিক বলেছেন, আর আমারই ভুল হয়েছে। সে-জন্য আমি সহস্রবার তাঁর নিকট ক্ষমা চাইছি। তাঁকে ও—কে আমার অগাধ ভালবাসা দিও।

সমুখে পিছনে তাকাই যখন
দেখি সবকিছু ঠিকই আছে।
আত্মার জ্যোতি জ্বল জ্বল করে
আমার গভীর দুঃখের মাঝে।৩৯

—কে, মিসেস—কে, প্রিয় জুল বোয়াকে আমার ভালবাসা জানাবে। প্রিয় জো, তুমি আমার প্রণাম জানবে। ইতি

বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫০৯
প্রবুদ্ধ ভারত আপিস
মায়াবতী, হিমালয়
৬ জানুআরী, ১৯০১
প্রিয় ধীরামাতা,
ডাক্তার বসু আপনার মারফত যে ‘নাসদীয় সূক্ত’ পাঠিয়েছিলেন, আমি এখনই তার অনুবাদ পাঠাচ্ছি। আমি অনুবাদটিকে যতটা সম্ভব আক্ষরিক করতে চেষ্টা করেছি। আশা করি, ডাক্তার বসু ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

মিসেস সেভিয়ার খুব দৃঢ়চিত্ত মহিলা এবং খুব শান্ত ও সবলভাবে শোক সহ্য করে নিয়েছেন। তিনি এপ্রিল মাসে ইংলণ্ডে যাচ্ছেন এবং আমিও তাঁর সঙ্গে যাচ্ছি।

এ স্থানটি অতি সুন্দর এবং তারা (আশ্রমবাসীরা) একে খুব মনোরম করে তুলেছে। কয়েক একর পরিমিত বিশাল স্থানটি সযত্নে রাখা হয়েছে। আশা করি মিসেস সেভিয়ার ভবিষ্যতে ইহা রক্ষা করতে পারবেন। অবশ্য তিনি বরাবরই এরূপ আশা করছেন।

জো-র কাছ থেকে শেষ চিঠিতে জানতে পেলাম, সে মাদাম কালভের সঙ্গে … যাচ্ছে।

জেনে সুখী হলাম, মার্গট ভবিষ্যতে কাজে লাগাবার জন্য তার বিদ্যা রেখে দিচ্ছে। তার বইখানা এখানে খুব সমাদর লাভ করেছে, কিন্তু মনে হয় প্রকাশকেরা বিক্রীর জন্য তেমন চেষ্টা করছে না।

কলিকাতার প্রথম দিনের ছোঁয়াচেই আমার হাঁপানি আবার দেখা দিয়েছিল। সেখানে যে দু-সপ্তাহ ছিলাম, প্রতি রাত্রেই রোগের আক্রমণ হত। হিমালয়ে বেশ ভাল আছি। এখানে খুব বরফ পড়ছে, পথে প্রবল হিমঝঞ্ঝার মধ্যে পড়েছিলাম; কিন্তু ঠাণ্ডা তত বেশী নয়। এখানে আসার পথে দুদিন ঠাণ্ডা লাগায় খুব উপকার হয়েছে বলে মনে হয়।

আজ মিসেস সেভিয়ারের জমিগুলি দেখতে দেখতে বরফের উপর দিয়ে মাইলখানেক চড়াই করেছি। সেভিয়ার সব জায়গায় সুন্দর রাস্তা তৈরী করেছেন। প্রচুর বাগান মাঠ ফলগাছ এবং দীর্ঘ বন তাঁর দখলে। থাকবার কুটীরগুলি কি সাদাসিধে পরিচ্ছন্ন সুন্দর, এবং সর্বোপরি কাজের উপযোগী!

আপনি কি শীঘ্র আমেরিকা যাচ্ছেন? যদি না যান, তাহলে তিনমাসের মধ্যে লণ্ডনে আপনার সঙ্গে দেখা হবে, আশা করি।

অনুগ্রহ করে মিস ওলকককে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন। এর পরে যখন মূলারের সঙ্গে আপনার দেখা হবে, তাকে ও স্টার্ডিকে আমার গভীর ভালবাসা জানাবেন। কলিকাতায় আমার মা, ভগ্নী ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেছি।

এখানকার সকলকেই আপনাকে ভালবাসা জানাচ্ছে।



আপনার চিরস্নেহাবদ্ধ সন্তান
বিবেকানন্দ

পুনঃ—কালী দুটি বলি গ্রহণ করেছেন; মহৎ উদ্দেশ্যে দু-জন ইওরোপীয় শহীদ আত্মত্যাগ করেছেন, এখন কাজ অতি সুন্দরভাবে এগিয়ে চলবে।

বি

এলবার্ট ও—কে আমার ভালবাসা জানাচ্ছি।

চারিদিকে ছ-ইঞ্চি গভীর বরফ পড়ে আছে, সূর্য উজ্জ্বল ও মহীয়ান্, আর মধ্যাহ্নে বাহিরে বসে আমরা বই পড়ছি। আমাদের চারধারেই বরফ! বরফ থাকা সত্ত্বেও শীতকাল এখানে বেশ মৃদু। বায়ু শুষ্ক ও স্নিগ্ধকর, এবং জল প্রশংসার অতীত।

বি
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫১০

মায়াবতী, হিমালয়
১৫ জানুআরী, ১৯০১

প্রিয় স্টার্ডি,
সারদানন্দের কাছে খবর পেলাম যে, ইংলণ্ডের কাজের জন্য যে ১,৫২৯।/৫ পাই হাতে ছিল, তা তুমি মঠে পাঠিয়ে দিয়েছ। এ টাকা ভাল কাজেই লাগবে নিশ্চিত।

প্রায় তিন মাস আগে ক্যাপ্টেন সেভিয়ার দেহত্যাগ করেছেন। তাঁরা এই পাহাড়ের উপর একটা সুন্দর আশ্রম স্থাপন করেছেন; আর মিসেস সেভিয়ারের ইচ্ছা যে, তিনি আশ্রমটি সংরক্ষণ করেন । আমি এখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি এবং হয়তো তাঁরই সঙ্গে ইংলণ্ডে যেতে পারি।

আমি প্যারিস থেকে তোমায় একখানি চিঠি লিখেছিলাম, তুমি বোধ হয় তা পাওনি।

মিসেস স্টার্ডির দেহত্যাগের খবরে বড়ই দুঃখিত হলাম। তিনি সাধ্বী স্ত্রী ও স্নেহময়ী মাতা ছিলেন; জীবনে এরূপ মহিলা বড় একটা চোখে পড়ে না। এ জীবন আঘাতপূর্ণ; কিন্তু সে আঘাতের ব্যথা যেমন করেই হোক চলে যায়—এই যা আশা!

আগের চিঠিতে খোলাখুলিভাবে তোমার মনভাব প্রকাশ করেছ বলে যে আমি চিঠি লেখা বন্ধ করেছি—তা নয়। আমি শুধু ঢেউটা চলে যাবার অপেক্ষায় ছিলাম, এই হচ্ছে আমার রীতি। চিঠি লিখলে তিলকে তাল করে তোলা হত।

মিসেস জনসন ও অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে তাদের আমার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানিও। ইতি



চিরসত্যবদ্ধ
বিবেকানন্দ

*******************

পত্র সংখ্যা (৫১১-৫২০)

পত্র সংখ্যা (৫১১-৫২০)

পত্র সংখ্যা - ৫১১
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
২৬ জানুআরী, ১৯০১

মা,
আপনার উৎসাহপূর্ণ কথাগুলির জন্য অশেষ ধন্যবাদ। এখনই আমার ঐরূপ উৎসাহবাক্যের অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। নূতন শতাব্দী এসেছে, কিন্তু অন্ধকার কাটেনি, বরং স্পষ্টই তা ঘন হয়ে উঠছে। মিসেস সেভিয়ারকে দেখতে মায়াবতী গিয়েছিলাম। পথে খেতড়ির রাজার আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ পেলাম। যতদূর বোঝা যাচ্ছে, তিনি নিজব্যয়ে আগ্রায় কোন পুরাতন স্থাপত্যকীর্তির সংস্কার করছিলেন, কাজ পরিদর্শনের জন্য কোন গোম্বুজে উঠেছিলেন, গম্বুজটির অংশবিশেষ ভেঙে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মৃত্যু ঘটে।

জো এখানে আছে, কিন্তু তার সঙ্গে এখনও দেখা হয়নি।

বাঙলাদেশে, বিশেষতঃ মঠে যে মুহূর্তে পদার্পণ করি, তখনই আমার হাঁপানির কষ্টটা ফিরে আসে, এ স্থান ছাড়লেই আবার সুস্থ।

আগামী সপ্তাহে আমার মাকে নিয়ে তীর্থে যাচ্ছি। তীর্থযাত্রা সম্পূর্ণ করতে কয়েক মাস লাগবে। তীর্থদর্শন হল হিন্দু বিধবার প্রাণের সাধ; সারা জীবন আত্মীয়স্বজনদের কেবল দুঃখ দিয়েছি। তাঁদের এই একটি ইচ্ছা অন্তত পূর্ণ করতে চেষ্টা করছি।

মার্গট সম্বন্ধে সব কিছু জেনে আনন্দিত হলাম। এদেশে ফিরে আসছে জেনে সকলে তাকে স্বাগত জানাতে উৎসুক।

আশা করি, ডক্টর বসু ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেছেন।

মিসেস হ্যামল্ডের কাছ থেকেও একখানি সুন্দর চিঠি পেয়েছি। তিনি মহীয়সী নারী।

যা হোক, আমি এখন অত্যন্ত শান্ত ও আত্মস্থ; সব কিছুকে অনেক ভাল দেখছি, যা কখনও দেখবার আশা করিনি।

আপনার স্নেহের চিরসন্তান
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫১২
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
২ ফেব্রুআরী, ১৯০১
মা,
কিছুদিন আগে আপনার একখানা চিঠি ও তার মধ্যে একখানা ১৫০ টাকার চেক পেয়েছিলাম। এটা আমি ছিঁড়ে ফেলব, কারণ আগের তিনটি চেক আমার এক ভগিনীকে (cousin) দিয়ে দিয়েছি।

জো এখানে; দুবার তার দেখা পেয়েছি, সে দেখাসাক্ষাৎ নিয়ে ব্যস্ত। ইংলণ্ডে যাবার পথে মিসেস সেভিয়ারের শীঘ্রই এখানে আসার কথা। তাঁর সঙ্গে ইংলণ্ডে যাবার আশা করেছিলাম, কিন্তু এখন অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে মাকে নিয়ে দীর্ঘ তীর্থযাত্রায় আমাকে যেতেই হচ্ছে।

বাঙলাদেশে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই আমার স্বাস্থ্য ভেঙে যায়; যা হোক, তার জন্য আজকাল বিশেষ ভাবি না, আমি ভালই আছি, আর আমার পারিপার্শ্বিক অবস্থাও ভাল।

মার্গটের সাফল্যের সংবাদ জেনে আনন্দিত, জো কিন্তু বলছে, টাকা পয়সা জুটছে না; ঐখানেই গোলমাল। কেবল মাত্র ধারাবাহিকতা রক্ষা করার মূল্য সামান্যই এবং লণ্ডন থেকে কলিকাতা অনেক দূর। মা-ই জানেন। মার্গটের ‘কালী দি মাদার’ (Kali the Mother) বইয়ের প্রশংসা সকলেই করছে। কিন্তু হায়! কেনার জন্য কেউ একটা বই পাচ্ছে না; পুস্তক-বিক্রেতারা বিক্রয় বাড়ানোর ব্যাপারে নিতান্ত উদাসীন।

এই নূতন শতাব্দী আপনাদের আরও মহত্তর ভবিষ্যতের জন্য অপূর্ব স্বাস্থ্য ও সামর্থ্য দিক্‌—এই আপনার সন্তান বিবেকানন্দের সতত প্রার্থনা।

বিবেকানন্দ

*******************

পত্র সংখ্যা - ৫১৩

বেলুড় মঠ, হাওড়া
১৪ ফেব্রুআরী, ১৯০১
প্রিয় জো,
বোয়া কলিকাতায় আসছেন জেনে আমি এত আনন্দিত হয়েছি যে, কি বলব। তাঁকে অবিলম্বে মঠে পাঠিয়ে দেবে। আমি এখানেই থাকব। সম্ভব হলে তাঁকে এখানে কয়েক দিন রাখব, তারপর আবার নেপাল যাবার জন্য ছেড়ে দেব।


তোমার ইত্যাদি
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫১৪

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
১৭ ফেব্রুআরী, ১৯০১
প্রিয় জো,
এইমাত্র সুন্দর ও সুদীর্ঘ চিঠিখানা পেলাম। মিস কর্নেলিয়া সোরাবজীর সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল ও তুমি তাঁকে পছন্দ কর জেনে আমি খুব প্রীত হয়েছি। তাঁর বাবার সঙ্গে আমার পুনাতে পরিচয় হয়; তা ছাড়া তাঁর একটি ছোট বোন আমেরিকায় ছিল, তাকেও আমি জানতাম। লিমডির ঠাকুর-সাহেবের সঙ্গে যে সন্ন্যাসী পুনাতে বাস করতেন, তাঁর কথা মনে করিয়ে দিলে হয়তো কর্নেলিয়ার মা-ও আমাকে চিনবেন।

আশা করি, তুমি বরোদায় গিয়ে মহারাণীর সঙ্গে দেখা করবে।

আমি আগের চেয়ে অনেক ভাল আছি এবং কিছুকাল এভাবে থাকব বলেই বিশ্বাস। আমি এইমাত্র মিসেস সেভিয়ারের কাছ থেকে একখানি চমৎকার চিঠি পেয়েছি; তিনি তাতে তোমার সম্বন্ধে কত ভাল কথাই না লিখেছেন।

মিঃ টাটার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল এবং তাঁকে খুব দৃঢ়চেতা ও সজ্জন বলে তোমার মনে হয়েছে জেনে বিশেষ খুশী হয়েছি।

বোম্বে যাবার মত শক্তি যদি পাই, তবে সেখানে যাবার আমন্ত্রণ আমি অবশ্যই গ্রহণ করব।

তুমি যে জাহাজে কলম্বো যাবে, সেটির নাম অবশ্যই ‘তার’ করে জানিও। আমার আন্তরিক ভালবাসা জেনো। ইতি

তোমার স্নেহশীল
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫১৫
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]
ঢাকা
২৯ মার্চ, ১৯০১

মা,
ঢাকা থেকে লেখা আমার অপর চিঠিখানা এর মধ্যে নিশ্চয়ই পেয়েছেন। সারদানন্দ কলিকাতায় জ্বরে দারুণ ভুগছিল। কলিকাতা এ বছর সত্যি নরকে পরিণত হয়েছে। সারদানন্দ আরোগ্যলাভ করেছে এবং এখন মঠে আছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, মঠ বাঙলাদেশের অন্যতম সেরা স্বাস্থ্যকর স্থান।

জানি না, আপনার সঙ্গে আমার মায়ের কি কথাবার্তা হয়েছিল; আমি তো উপস্থিত ছিলাম না। মনে হয়, তিনি মার্গটকে দেখার জন্য বিশেষ ঔৎসুক্য দেখিয়েছেন। আর কিছু নয়—বোধ হয়।

মার্গটকে পরামর্শ দিয়েছি, সে যেন ইংলণ্ডে তার পরিকল্পনাগুলি পাকা করে নেয় এবং ফিরে আসার আগে সেগুলির কার্যকারিতা বেশ কিছুটা পরীক্ষা করে আসে। স্থায়ী ভাল কাজ করতে হলে সময় লাগে।

সারদানন্দ উপযুক্ত বল পেলে দার্জিলিঙে মিসেস ব্যানার্জীর কাছে যেতে পারে। মিসেস ব্যানার্জী কয়েকদিন কলিকাতায় আছেন।

জাপান থেকে জো-র এখনও কোন খবর পাইনি। মিসেস সেভিয়ারের শীঘ্রই জাহাজে ওঠার কথা। আমার মা ও তাঁর সঙ্গিনীরা পাঁচদিন আগে ঢাকা এসেছেন, ব্রহ্মপুত্রে পবিত্র স্নানের যোগ। যখনই কয়েকটি গ্রহের বিশেষ সংযোগ ঘটে, যা খুবই দুর্লভ, তখনই কোন নির্দিষ্ট স্থানে নদীতীরে বিপুল লোকসমাগম হয়। এ বৎসর এক লক্ষেরও বেশী লোক হয়ে ছিল; মাইলের পর মাইল নদী নৌকাতে ঢাকা ছিল।

যদিও নদী সেখানে এক মাইল চওড়া, তবু কর্দমাক্ত। কিন্তু (নদীগর্ভ) শক্ত থাকায় আমরা স্নান পূজা ইত্যাদি করতে পেরেছি।

ঢাকা তো বেশ ভালই লাগছে। আমার মা ও আর সব মেয়েদের নিয়ে চন্দ্রনাথ যাচ্ছি; সেটা পূর্ববাঙলার শেষ প্রান্তে একটি তীর্থস্থান।

আমি ভালই আছি, আশা করি, আপনার, আপনার কন্যার এবং মার্গটের স্বাস্থ্য খুব ভাল যাচ্ছে।


আপনার চিরস্নেহের সন্তান
বিবেকানন্দ

পুনঃ—আমার এক ভগিনী এবং মা আপনাকে ও মার্গটকে তাঁদের ভালবাসা জানিয়েছেন।

—বি
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫১৬

মঠ, বেলুড়
১৫ মে, ১৯০১
প্রিয় স্বরূপ,৪০
নৈনিতাল হতে লিখিত তোমার পত্র বিশেষ উদ্দীপনাপূর্ণ। আমি সবেমাত্র পূর্ববঙ্গ ও আসাম পরিভ্রমণ করে ফিরেছি। অন্যান্য বারের মত এবারেও আমি অত্যন্ত ক্লান্ত এবং ভেঙে পড়েছি।

যদি বরোদার মহারাজের সঙ্গে দেখা করলে সত্যিই কোন কাজ হয়, তবে আমি রাজী আছি; নতুবা ভ্রমণের পরিশ্রম এবং খরচের মধ্যে যেতে চাই না। সুতরাং মহারাজের সঙ্গে দেখা করলে আমাদের কাজের সাহায্য হবে কিনা, সে বিষয়ে তোমার অভিমত—বিশেষ চিন্তা করে এবং সংবাদাদি নিয়ে আমাকে জানাবে। আমি এইমাত্র মিসেস সেভিয়ারের কাছ থেকে সুন্দর একখানি চিঠি পেলাম। অমরনাথ ও নৈনিতালের আর সব বন্ধুদের ভালবাসা জানাবে। তুমি আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জেনো। ইতি


তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫১৭
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
মঠ, বেলুড়
২৬ ডিসেম্বর, ১৯০০

প্রিয় মেরী,
কোন বিখ্যাত নামের সঙ্গে বাঁধা পড়া কখনও কখনও বেশ হয়রানির ব্যপার। আমার চিঠিখানার অদৃষ্টে ঠিক তাই ঘটেছে। ২২ জানুআরী, ১৯০১ চিঠিখানা লিখেছ এবং একটি বিখ্যাত নাম—মিস ম্যাকলাউডের সঙ্গে আমাকে জুড়ে দিয়েছ। তার ফলে চিঠিখানা সারা পৃথিবী তাকে অনুসরণ করে ঘুরেছে। গতকাল জাপান থেকে—মিস ম্যাকলাউড এখন জাপানে—সেটা আমার কাছে এসে পৌঁছেছে; তবেই হল গ্রীক পুরাণের সেই স্ফিংক‍্স‍্ (Sphinx)-এর হেঁয়ালির সমাধানঃ ‘একটি মহৎ নামের সঙ্গে কোন ছোট নামকে যুক্ত করবে না।’

মেরী, তাহলে তোমরা ফ্লোরেন্স ও ইতালীকে উপভোগ করছ। জানি না, এখন তোমরা কোথায়। সুতরাং স্থূলাঙ্গী বৃদ্ধা ‘লেইডী’ (laidy), মনরো এণ্ড কোম্পানীর (Monroe & Co., 7 Rue Scribe) অনুগ্রহের উপর এ চিঠিখানা ছেড়ে দিচ্ছি।

তাহলে বৃদ্ধা মহিলা, তুমি ফ্লোরেন্স ও ইতালীর হ্রদে স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে কাটাচ্ছ। ভাল, যদিও তোমার কবি একে শূন্য বলে আপত্তি জানাচ্ছে।

হ্যাঁ, অনুরক্ত ভগিনী, আমার নিজের খবর কেমন? গত শরতে ভারতে ফিরেছি, সারা শীতকালটা ভুগেছি এবং এই গ্রীষ্মে বড় বড় নদী ও পাহাড় এবং ম্যালেরিয়ার দেশ পূর্ববঙ্গ ও আাসমের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করেছি এবং দু-মাস কঠোর পরিশ্রমের পর আবার স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙেছে। এখন আবার কলিকাতায় ফিরে এসেছি এবং ধীরে ধীরে এর প্রকোপ কাটিয়ে উঠছি।

কয়েক মাস আগে খেতড়ির রাজা পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছেন। তাহলেই দেখছ, এখন আমর চারিদিকে সব কিছু বিঘ্নতায় ভরা এবং আমার নিজেরও স্বাস্থ্য অত্যন্ত খারাপ। তথাপি শীঘ্রই তা নিশ্চয় ঝেড়ে ফেলছি এবং দেখছি এর পরে কি আসে।

ইচ্ছা হয় ইওরোপ গিয়ে তোমার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্পসল্প করে আবার হুট করে ভারতে ফিরে আসি; কারণ মোটের উপর, আজকাল আমি একপ্রকার প্রশান্তি অনুভব করছি এবং আমার অস্থিরতার বার আনা বিদায় দিয়েছি।

হ্যারিয়েট উলী, ইসাবেল এবং হ্যারিয়েট ম্যাক্‌কিণ্ডলিকে আমার ভালবাসা এবং মাকে আমার চিরন্তন ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা। মাকে বল যে ‘দুর্বোধ্য হিন্দু’র কৃতজ্ঞতা বহু পুরুষ পর্যন্ত সক্রিয় থাকবে।


সতত প্রভুসন্নিধানে তোমার
বিবেকানন্দ

পুনঃ—যখন ভাল লাগবে, এক ছত্র লিখ।

—বি
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫১৮
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
মঠ, বেলুড়, হাওড়া
৩ জুন, ১৯০০

কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্র পেয়ে হাসিও পেল, কিঞ্চিৎ দুঃখও হল। হাসির কারণ এই যে, পেটগরমের কি স্বপ্ন দেখে তুমি একটা সত্য ঠাউরে নিজেকে দুঃখিত করেছ। দুঃখের কারণ এই যে, এতে বোঝা যায় তোমার শরীর ভাল নয়—তোমার স্নায়ুমণ্ডলীর পক্ষে বিশ্রামের একান্ত আবশ্যক।

আমি তোমাকে কস্মিন‍্কালেও শাপ দিই নাই, আজ কেন দেব? আজন্ম আমার ভালবাসার পরিচয় পেয়ে কি আজ তোমাদের অবিশ্বাস হল? অবশ্য আমার মেজাজ চিরকালই খারাপ, তায় আজকাল রোগে পড়ে মধ্যে মধ্যে বড্ডই হয়—কিন্তু নিশ্চিত জেনো যে, সে ভালবাসা যাবার নয়।

আমার শরীর আজকাল আবার একটু ভাল হচ্ছে। মান্দ্রাজে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে কি? দক্ষিণে একটু বৃষ্টি আরম্ভ হলেই আমি বোধ হয় বোম্বে, পুনা হয়ে মান্দ্রাজ যাব। বর্ষা আরম্ভ হলেই বোধ হয় দক্ষিণের প্রচণ্ড গরম থেমে যাবে।

সকলকে আমার বিশেষ ভালবাসা দিও, তুমিও জানিও।

কাল শরৎ দার্জিলিঙ হতে মঠে এসেছে—শরীর অনেক সুস্থ, পূর্বাপেক্ষা। আমি ব্রহ্মদেশ আর আসাম ভ্রমণ করে এস্থানে পৌঁছেছি। সকল কাজেই নরম গরম আছে—কখনও চড়াই, কখনও উতরাই। আবার উঠবে। ভয় কি?

যা হোক, আমি বলি যে তুমি কাজকর্ম কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে একদম মঠে চলে এস—এখানে মাসখানেক বিশ্রামের পর তুমি আমি একসঙ্গে will make a grand tour (বিরাট ভ্রমণে বেরুব) in Gujrat, Bombay, Poona, Hyderabad, Mysore to Madras (গুজরাট, বোম্বে, পুনা, হায়দরাবাদ ও মহীশূর হয়ে মান্দ্রাজ পর্যন্ত)। Would not that be grand (ওটা কি খুব চমৎকার হবে না)? তা না যদি পার একান্ত, মান্দ্রাজের লেকচার এখন একমাস স্থগিত থাক—তুমি দুটি দুটি খাও, আর খুব ঘুমাও। আমি দুই-তিন মাসের মধ্যে সেথা আসছি। যা হোক, পত্রপাট একটা বিচার করে লিখবে। ইতি

সাশীর্বাদং
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫১৯
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
মঠ, বেলুড়, হাওড়া

প্রিয় শশী,
আমি আমার মায়ের সঙ্গে রামেশ্বরে যাচ্ছি—এই তো কথা! আমি আদৌ মান্দ্রাজে যাব কিনা জানি না। একান্তই যদি যাই, উহা সম্পূর্ণ গোপনে। আমার দেহ মন একেবারে অবসন্ন, একজন লোকের সঙ্গেও আলাপ-পরিচয় করা আমার পক্ষে অসম্ভব।

আমি কারও সাথী হচ্ছি না; কাউকে সঙ্গে নেবার মতো শক্তি, অর্থ বা ইচ্ছা আমার নাই—তারা গুরুমহারাজের ভক্ত হোক আর না হোক, আসে-যায় না।

তোমায় আবার বলছি—আমি এখন মরে আছি বললেই চলে এবং কারও সহিত সাক্ষাৎ করতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক। এরূপ ব্যবস্থা যদি তুমি না করতে পার, আমি মান্দ্রাজে যাব না।

শরীর বাঁচাবার জন্য আমায় একটু স্বার্থপর হতে হচ্ছে। যোগীন-মা প্রভৃতি নিজেদের ব্যবস্থা করুন। আমার স্বাস্থ্যের বর্তমান অবস্থায় আমি কাউকে সঙ্গে নিতে পারব না। আমার ভালবাসা জানবে। ইতি


তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫২০
মঠ, বেলুড়, হাওড়া
১৪ জুন, ১৯০১

প্রিয় জো,
জাপান—বিশেষতঃ জাপানী শিল্প তুমি উপভোগ করছ, এতে আমি খুব আনন্দিত। জাপানের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শিখতে হবে, এ-কথা তুমি ঠিকই বলেছ। জাপান আমাদের যে সাহায্য করবে, তার মধ্যে থাকবে সহানুভূতি ও মর্যাদা, আর অন্যদিকে পশ্চিমের সাহায্য সহানুভূতিশূন্য ও গঠনবিরোধী। ভারত ও জাপানের মধ্যে একটি যোগসূত্র-স্থাপন সত্যই অত্যন্ত বাঞ্ছনীয়।

আসামে একটু অক্ষম হয়ে পড়েছিলাম। মঠের আবহাওয়া আমাকে কিছুটা চাঙ্গা করে তুলেছে। আসামের পার্বত্য স্বাস্থ্যনিবাস শিলং-এ আমার জ্বর, হাঁপানি ও এলবুমেন বেড়েছিল এবং শরীর দ্বিগুণ ফুলে গিয়েছিল। যা হোক, মঠে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই রোগের লক্ষণগুলি হ্রাস পেয়েছে। এ বছর ভয়ঙ্কর গরম পড়েছে; তবে একটুখানি বৃষ্টি নেমেছে এবং আশা হয়, শীঘ্রই পূর্ণবেগে মৌসুমী এসে যাবে। এখানই আমার কোন পরিকল্পনা নেই, শুধু বোম্বে প্রদেশেআমাকে দারুণ ভাবে চাইছে এবং শীঘ্রই সেখানে যাবার কথা ভাবছি, এই যা; প্রায় সপ্তাহখানেকের মধ্যে আমরা বোম্বে অঞ্চলে ভ্রমণের জন্য যাত্রা শুরু করবার কথা চিন্তা করছি।

লেডী বেটী (Lady Betty) যে ৩০০ ডলার পাঠিয়েছেন বলছ, তা এখনও আমার কাছে এসে পৌঁছয়নি; জেনারেল প্যাটারসনের কাছ থেকে তার কোন সংবাদও আমি পাইনি।

স্ত্রী ও ছেলেপিলে জাহাজে ইওরোপ যাত্রা করার পর থেকে বেচারার অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে; আমাকে বলেছে—তার সঙ্গে দেখা করার জন্য, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমি এত অসুস্থ হয়ে পড়েছি এবং শহরে যেতে আমার এত ভয় যে, বর্ষা আসা পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতেই হবে।

এখন প্রিয় জো, যদি আমাকে জাপান যেতে হয়, তবে এবার কাজটা চালাবার জন্য সারদানন্দকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া লি হুয়াং চাং-এর (Li Huang Chang) নিকট মিঃ ম্যাক্সিমের অঙ্গীকৃত পত্রখানাও আমার অবশ্যই পাওয়া চাই। বাকী ‘মা’ জানেন। এখনও কিছু স্থির নেই।

ভবিষ্যদ‍্‍বক্তাকে দেখতে তাহলে তুমি অ্যালানকুইনান (Alanquinan) গিয়েছিলে? সে কি তার শক্তি-টক্তি সম্বন্ধে তোমার বিশ্বাস জন্মাতে পেরেছিল? কি বললে সে? এ-বিষয়ে সবিশেষ জানাবে।

নেপাল-প্রবেশে বাধা পেয়ে জুল বোয়া লাহোর পর্যন্ত গিয়েছিলেন। কাগজে দেখলাম, তিনি গরম সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন; তারপর জাহাজে নিরাপদ সমুদ্রযাত্রা। মঠে দেখা হবার পর তিনি আমাকে একছত্রও লেখেননি। তুমিও নরওয়ে থেকে জাপান পর্যন্ত সারা পথ মিসেস বুলকে টেনে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর—হ্যাঁ, মাদমোয়াজেল, তুমিও নিঃসন্দেহে একজন পাকা জাদুকর। জো, শরীর ও আত্মাকে চাঙ্গা রাখ; অ্যালানকুইনানের লোকটির অধিকাংশ কথাই সত্যে পরিণত হবে; গৌরব এবং সম্মান তোমার জন্য অপেক্ষা করছে—এবং মুক্তি। বিবাহের মাধ্যমে পুরুষকে অবলম্বন করে ওপরে ওঠাই মেয়েদের স্বাভাবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কিন্তু সেদিন অতীত হয়ে গিয়েছে। কোন পুরুষের সাহায্য ছাড়াই তুমি বড় হবে, যেমনি তুমি বড় আছ, আমাদের প্রিয় অনাড়ম্বর চিরন্তন জো!

জীবনকে আমরা যথেষ্টই দেখেছি, তাই নয়কি, জো? জীবনের কোন অনিত্য বস্তুকেই তাই আমরা আর গ্রাহ্য করি না। মাসের পর মাস আমি সমস্ত ভাবপ্রবণতা ঝেড়ে ফেলার অভ্যাস করছি; অতএব এখানেই বিরত হলাম। এখন বিদায়। আমরা একসঙ্গে কাজ করব—এ ‘মায়ের’ আদেশ; এতে ইতোমধ্যেই বহু লোকের কল্যাণ হয়েছে; আরও অনেক লোকের কল্যাণ সাধিত হবে; তাই হোক। মতলব আঁটা, উঁচুতে ওঠা, সবই বৃথা; ‘মা’ তাঁর নিজের পথ করে নাবেন; … তুমি নিশ্চিন্ত থাক।

সতত প্রীতি ও আশীর্বাদসহ
বিবেকানন্দ

পুনঃ—এইমাত্র মিঃ ওকাকুরার কাছ থেকে ৩০০‍্ টাকার একটি চেক ও আমন্ত্রণ এল। এ খুবই লোভনীয়, কিন্তু তথাপি ‘মা’-ই জানেন।

—বি
*******************

পত্র সংখ্যা (৫২১-৫৩০)

পত্র সংখ্যা (৫২১-৫৩০)

পত্র সংখ্যা - ৫২১
মঠ, বেলুড়, হাওড়া
১৮ জুন, ১৯০০

প্রিয় জো,
তোমার চিঠির সঙ্গে মিঃ ওকাকুরার টাকার রসিদ পাঠালাম। তোমার সব রকম চাতুরীর জন্যই আমি প্রস্তুত।

যা হোক, আমি যাবার জন্য সত্যিই চেষ্টা করছি। কিন্তু জানই তো—যেতে এক মাস, ফিরতে এক মাস, আর থাকতে হবে দিন কয়েক! তা হোক, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি; তবে আমার দুর্বল স্বাস্থ্য এবং কিছু আইনঘটিত ব্যাপার প্রভৃতির জন্য একটু দেরী হতে পারে। ইতি

সতত স্নেহশীল
বিবেকানন্দ

*******************

পত্র সংখ্যা - ৫২২
মঠ, বেলুড়, হাওড়া
১৯০১

প্রিয় জো,
তোমার কাছে আমি যে বিপুল কৃতজ্ঞতা-ঋণে ঋণী, কল্পনাতেও তা পরিশোধ করতে পারি না। তুমি যেখানেই থাক না কেন, আমার মঙ্গলকামনা করতে কখনও ভুলো না। আর তুমি হচ্ছ একমাত্র ব্যক্তি, যে এসব শুভেচ্ছার উপরেও আমার সব ভার বহন কর এবং আমার সব রকম আবেগজনিত বিস্ফোরণ সহ্য কর।

তোমার জাপানী বন্ধু বড়ই সহৃদয়তা দেখিয়েছেন; কিন্তু আমার স্বাস্থ্য এতই খারাপ যে, আশঙ্কা হয়—আমি হয়তো জাপানের জন্য সময় করতে পারব না। আর কিছু না হোক, শুধু সহৃদয় বন্ধু-বান্ধবদের খবর নেবার জন্যও নিজেকে একমাত্র বোম্বে প্রেসিডেন্সির ভেতর দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে হবে।

তা ছাড়া (জাপান) যেতে-আসতেই দু-মাস কেটে যাবে, আর থাকতে পারব মাত্র এক মাস; এ তো আর কাজ করবার পক্ষে তেমন সুবিধাজনক নয়—কি বল? সুতরাং তোমার জাপানী বন্ধু আমার পাথেয় বাবদ যে টাকা পাঠিয়েছেন, তাঁকে তুমি দিয়ে দাও; তুমি যখন নভেম্বরে ভারতে আসবে, তখন আমি তা শোধ করব।

আসামে আমার রোগ আবার ভীষণভাবে দেখা দেয়; ক্রমে সেরে উঠছি। বোম্বের লোকেরা আমার জন্য অপেক্ষা করে করে হয়রান হয়ে গেছে; এবার তাদের দেখতে যাব।

এ-সব সত্ত্বেও যদি তুমি চাও যে, আমার যাওয়া উচিত, তবে তোমার পত্র পেলেই আমি যাত্রা করব।

মিসেস লেগেল লণ্ডন থেকে এক পত্র লিখে জানতে চেয়েছেন যে, তাঁদের প্রেরিত ৩০০ পাউণ্ড আমি পেয়েছি কিনা। ঐ টাকা এসেছে এবং পূর্ব নির্দেশানুযায়ী আমি এক সপ্তাহ আগে বা তারও আগে ‘মনরো এণ্ড কোং, প্যারিস’—এই ঠিকানায় তাঁকে তা জানিয়ে দিয়েছি।

তাঁর শেষ যে চিঠিখানা এসেছে, তার খামটা কে নির্লজ্জভাবে ছিঁড়ে দিয়েছে। ভারতের ডাক-বিভাগ আমার চিঠিগুলো একটু ভদ্রভাবে খুলবারও চেষ্টা করে না!


তোমাদের চিরস্নেহশীল
বিবেকানন্দ

*******************

পত্র সংখ্যা - ৫২৩
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
মঠ, বেলুড়, হাওড়া
৫ জুলাই, ১৯০১

প্রিয় মেরী,
তোমার সুদীর্ঘ সুন্দর চিঠিখানির জন্য অত্যন্ত কৃতজ্ঞ; বিশেষতঃ আমার মনের প্রফুল্লতার জন্য এখনই এ-রকম একটি চিঠির প্রয়োজন ছিল। আমার স্বাস্থ্য খুব খারাপ যাচ্ছে। কিছুদিনের জন্য আরোগ্যলাভ করি, তারপরেই আসে অবশ্যম্ভাবী ভাঙন। যাই হোক এই হল রোগটার প্রকৃতি।

সম্প্রতি আমি পূর্ববাঙলা ও আসাম পরিভ্রমণ করছিলাম। কাশ্মীরের পরেই আসাম ভারতের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা, কিন্তু খুবই অস্বাস্থ্যকর। দ্বীপময় বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ পাহাড়-পর্বতের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে, এ দৃশ্য দেখবার মত।

তুমি জান, আমার এই দেশকে বলা হয় জলের দেশ। কিন্তু তার তাৎপর্য পূর্বে কখনও এমন ভাবে উপলব্ধি করিনি। পূর্ববাঙলার নদীগুলি যেন তরঙ্গসঙ্কুল স্বচ্ছ জলের সমুদ্র, নদী মোটেই নয়, এবং সেগুলি এত দীর্ঘ যে ষ্টীমার—সপ্তাহের পর সপ্তাহ তাদের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে।

মিস ম্যাকলাউড এখন জাপানে। দেশটি দেখে সে একান্ত মুগ্ধ। আমাকে যেতে লিখেছে, কিন্তু এরূপ দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা আমার শরীর সইতে পারবে না বলে বিরত হয়েছি। জাপান আমার পূর্বেই দেখা আছে।

তাহলে তুমি ভিনিসে আনন্দ উপভোগ করছ। বৃদ্ধটি নিশ্চয়ই খুব আমোদপ্রিয়; তবে বৃদ্ধ শাইলকের বাড়ীও ছিল ভিনিসে, তাই নয় কি?

স্যাম এ বছর তোমার সঙ্গে আছে—তাতে আমি খুবই আনন্দিত। উত্তরাঞ্চলের নিরানন্দ অভিজ্ঞতার পর সে নিশ্চয়ই ইওরোপের ভাল জিনিষগুলি উপভোগ করবে। বর্তমানে কোন নূতন চিত্তাকর্ষক বন্ধু আমার জোটেনি, পুরানো যাদের কথা তুমি জান, তাঁরা প্রায় সকলেই ইহজগৎ থেকে বিদায় নিয়েছেন, এমন কি খেতড়ির রাজা পর্যন্ত। সেকেন্দ্রায় সম্রাট্‌ আকবরের সমাধির একটি উঁচু চূড়া থেকে পড়ে গিয়ে তিনি মারা গিয়েছেন। আগ্রার এই পুরাতন রমণীয় স্থাপত্যকীর্তিটি তিনি নিজব্যয়ে সংস্কার করছিলেন, কাজটা পরিদর্শন করতে গিয়ে একদিন পা পিছলে গিয়ে একেবারে কয়েক-শ ফুট নীচে পড়ে যান। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের প্রতি অত্যধিক আগ্রহের ফলে এভাবে মাঝে মাঝে আমাদের দুঃখ পেতে হয়। সাবধান মেরী, তুমি ভারতীয় ধ্বংসাবশেষটির সম্বন্ধে খুব বেশী আগ্রহান্বিত হয়ো না।

মিশনের সীলমোহরে সাপটি হল রহস্যবিদ্যার (mysticism) প্রতীক; সূর্য জ্ঞানের; তরঙ্গায়িত জল কর্মের; পদ্ম প্রেমের; সকলের মাঝখানে হংসটি হল আত্মার প্রতীক।

স্যাম এবং মাকে ভালবাসা।

সদা প্রীতিবদ্ধ
বিবেকানন্দ

পুনঃ—আমার চিঠি সংক্ষিপ্ত করতে হল; আমি সর্বদাই অসুস্থ; এই হল শরীর!
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫২৪

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
৬ জুলাই, ১৯০১
প্রিয় ক্রিষ্টিন,
এক-একবার এক-একটি কাজের ঝোঁক যেন আমায় পেয়ে বসে। আজ লেখার নেশায় আছি। তাই সর্বাগ্রে তোমাকেই কয়েক পঙ‍্‍ক্তি লিখছি। দুর্নাম আছে, আমার ধাত স্নায়ু-প্রধান—আমি অল্পেতেই ব্যাকুল হয়ে পড়ি। কিন্তু প্রিয় ক্রিষ্টিন, এ বিষয়ে তুমিও তো আমার চেয়ে নেহাৎ কম বলে মনে হয় না। আমাদের জনৈক কবি লিখেছেন, ‘হয়তো পর্বত নিশ্চিহ্ন হবে, অগ্নিও শীতল হবে, কিন্তু মহতের হৃদয় কখনও মহত্ত্ব হারাবে না।’ আমি ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র; কিন্তু আমি জানি যে তুমি মহৎ, আর তোমার মহত্ত্বে আমার সর্বদা আস্থা আছে। অন্য সকলের বিষয়ে ভাবনা হলেও তোমার সম্পর্কে আমার একটুও দুশ্চিন্তা নেই।

জগজ্জননীর কাছে তোমাকে সমর্পণ করেছি। তিনিই তোমাকে সর্বদা রক্ষা করবেন ও পথ দেখাবেন। এ কথা নিশ্চয় জানি যে, কোন অনিষ্ট তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না—কোন বাধাবিঘ্ন মুহূর্তের জন্যও তোমাকে নিরুৎসাহ করতে পারবে না। ইতি

ভগবদাশ্রিত
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫২৫
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
মঠ, বেলুড়, হাওড়া
২৭ অগষ্ট, ১৯০১
প্রিয় মেরী,
তুমি যেমন চেয়েছিলে, আমার শরীরের অবস্থা যদি তেমন থাকত—অন্ততঃ তোমাকে একটি বড় চিঠি লেখার মত! বস্তুতঃ, দিন দিন শরীর আরও খারাপের দিকে চলেছে এবং সে ছাড়াও কত সব জটিল ও বিরক্তিকর উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। সে সব লক্ষ্য করা আমি একেবারেই ছেড়ে দিয়েছি।

সুইজারল্যাণ্ডের রমণীয় কাঠের কুটীরে তোমাদের সর্ববিধ আনন্দলাভ হোক, এই আমার শুভাকাঙ্ক্ষা—চমৎকার স্বাস্থ্য, উত্তম ক্ষুধা, এবং চাঙ্গা হবার জন্য সুইজারল্যাণ্ডের বা অন্যান্য প্রাচীন কীর্তির একটু আধটু চর্চা। তুমি পর্বতের মুক্ত বায়ু সেবন করছ জেনে খুব আনন্দিত, কিন্তু স্যামের শরীর সুস্থ নেই জেনে দুঃখিত। তবে তার জন্য কোন উদ্বেগের কারণ নেই, তার শরীরের গঠন এতই সুন্দর!

‘নারীর মনোভাব ও পুরুষের ভাগ্য—দেবতারাও জানেন না, মানুষ কোন্‌ ছার?’৪১ আমার সহজাত প্রকৃতি অনেকটা নারীসুলভ হতে পারে, কিন্তু এই মুহূর্তে আমি যা নিয়ে চিন্তিত, তা হল—তোমার মধ্যে কিছুটা পৌরুষ সঞ্চারিত হোক। অহো মেরী, তোমার মেধা স্বাস্থ্য সৌন্দর্য সবই শুধু একটি প্রয়োজনীয় জিনিষের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে—তা হল ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা। তোমার ঔদ্ধত্য, উৎসাহ ইত্যাদি সব কিছুই অর্থহীন ও কৃত্রিম, তুমি বড়জোর একটি বোর্ডিঙ-স্কুলের মেয়ে—মেরুদণ্ডহীন, মেরুদণ্ডবিহীন!

হায়! জীবনভোর এই শিশু-হাঁটানোর প্রচেষ্টা! কথাটা খুবই রূঢ়, খুবই নির্দয়, কিন্তু উপায় নেই। মেরী, তোমাকে আন্তরিক ও অকপট স্নেহ করি; ভাবপ্রবণ বাক্যের মিছরি দিয়ে তোমার সঙ্গে প্রতারণা করতে পারি না। সে সব আমার কখনও আসে না।

তারপর আবার, আমি এখন মৃত্যুপথযাত্রী। ভাঁড়ামি করবার সময় আমার নেই। জাগো, বালিকা। তোমার কাছ থেকে এখন আমি কঠোর সমালোচনাপূর্ণ চিঠি আশা করছি; সোজাসুজি আঘাত কর, বেশ খানিকটা জাগানো চাই আমাকে।

ম্যাকভী-রা (Mac Veaghs) যখন এখানে ছিলেন, তখন আমি তাদের কোন খবর পাইনি। নিবেদিতা বা মিসেস বুলের কাছ থেকে সোজাসুজি কোন সংবাদ পাইনি, কিন্তু মিসেস সেভিয়ারের পত্র নিয়মিত পাই। তাঁরা সকলে এখন নরওয়েতে মিসেস বুলের অতিথি।

নিবেদিতা কবে ভারতে আসবে, কিম্বা আদৌ আসবে কিনা, জানি না।

এক অর্থে আমি এখন অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি; ‘আন্দোলন’ কি রকম চলছে, তার অনেক কিছুরই আমি বিশেষ লক্ষ্য রাখি না; তবে ‘আন্দোলন’ জোরাল হচ্ছে—একজন লোকের পক্ষে সবকিছু খুঁটিনাটি জানা সম্ভব নয়।

আহার ও নিদ্রার চেষ্টা ছাড়া এখন আর কিছুই করছি না, বাকী সময়টা শরীরের শুশ্রূষা করে কাটাই। প্রিয় মেরী, বিদায়; আশা করি এ জীবনে আমরা আবার কোথাও মিলিত হব; তবে দেখা হোক বা নাই হোক, আমি সতত তোমার স্নেহের ভ্রাতা।



সতত তোমার স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫২৬
[শ্রীমহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখিত]
মঠ, বেলুড়, হাওড়া
২৯ অগষ্ট, ১৯০১

স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
আমার শরীর ক্রমেই সুস্থ হচ্ছে, যদিও এখনও আমি খুবই দুর্বল। … সুগার বা এলবুমেন নেই দেখে সকলেই অবাক। বর্তমান অস্বস্তি শুধু স্নায়বিক। যাই হোক, আমি ক্রমে সেরে উঠছি।

মা-ঠাকরুণ দয়া করে যে প্রস্তাব করেছেন, তাতে আমি বিশেষ কৃতার্থ হয়েছি। কিন্তু মঠের সবাই বলছে যে, নীলাম্বরবাবুর বাড়ী, এমন কি গোটা বেলুড় গ্রামই এ মাসে ও পরের মাসে ম্যালেরিয়ায় ছেয়ে যায়। তারপর ভাড়াও অত্যধিক। সুতরাং মা-ঠাকরুণ যদি আসতে চান, তবে আমি তাঁকে এই পরামর্শ দিই যে, তিনি কলিকাতায় একটি ছোট বাড়ী ঠিক করুন। আমিও সম্ভবতঃ কলিকাতায় গিয়েই থাকব; কারণ বর্তমান শারীরিক দুর্বলতার উপর আবার ম্যালেরিয়া হওয়া মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। আমি এখন সারদানন্দ বা ব্রহ্মানন্দের মত লই নাই। তারা দুজনেই কলিকাতায় আছে। এ দু-মাস কলিকাতায় স্বাস্থ্য অনেকটা ভাল এবং খরচও অনেক কম।

ফল কথা, প্রভু তাঁকে যেরূপ চালান, তিনি সেরূপই চলবেন। আমরা শুধু প্রস্তাব করতে পারি; আমরা যা বলব, তা একেবারে ভুলও হতে পারে। তিনি যদি থাকার জন্য নীলাম্বরবাবুর বাড়ীই পছন্দ করেন, তবে ভাড়া ইত্যাদি আগে থেকেই ঠিক করে রেখ। মায়ের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক—আমি তো এইটুকুই বুঝি।

আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জেনো। ইতি



সতত প্রভুপদাশ্রিত
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫২৭
[শ্রীমহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
মঠ, বেলুড়, হাওড়া
৭ সেপ্টেম্বর, ১৯০১
স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
ব্রহ্মানন্দ ও অপর সকলের মতামত জানা আবশ্যক হওয়ায়, এবং তারা সকলেই কলিকাতায় থাকায় তোমার শেষ পত্রের উত্তর দিতে দেরী হয়ে গেল।

সারা বছরের জন্য বাড়ী নেওয়ার সিদ্ধান্তটা ভেবে-চিন্তে করতে হবে। একদিকে যেমন এ মাসে বেলুড়ে ম্যালেরিয়া হবার ভয় আছে, অন্যদিকে তেমনি কলিকাতায় প্লেগের ভয়। তা ছাড়া কেউ যদি গাঁয়ের ভিতরে যাওয়া সম্বন্ধে সাবধান থাকে, তবে ম্যালেরিয়া থেকে বেঁচে যেতে পারে; কারণ নদীর ধারে ম্যালেরিয়া মোটেই নেই। প্লেগ এখনও নদীর ধারে আসেনি; আর প্লেগের এই প্রকোপ-কালে এ গাঁয়ে যে-কটা বাড়ী ছিল, সবই মাড়োয়ারীদের দ্বারা ভর্তি।

তা ছাড়া, সবচেয়ে বেশী তুমি কত ভাড়া দিতে পার তা জানাও, আমরা তদনুযায়ী বাড়ী দেখব। আর একটা প্রস্তাব হচ্ছে, বাড়ীটি কলিকাতায় নেওয়া। আমি নিজে এখন কলিকাতায় বিদেশী বললেই হয়, তোমার পছন্দমত অন্যেরা দেখে দেবে। যত শীঘ্র সম্ভব এ দুটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত করতে পার ততই ভালঃ (১) মা বেলুড়ে থাকবেন, না কলিকাতায়? (২) যদি কলিকাতায় থাকেন, তবে ভাড়া কত এবং কোন্‌ পাড়ায় থাকা তাঁর পক্ষে ভাল? তোমাদের উত্তর পেলে এ কাজটা ঝট করে হয়ে যাবে।

আমার আন্তরিক ভালবাসা ও শুভেচ্ছা জানবে। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ

পুনঃ—এখানে আমরা সবাই ভাল আছি। এক সপ্তাহ কলিকাতায় থেকে মতি ফিরে এসেছে। গত তিন দিন এখানে দিনরাত বৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের দুটি গরুর বাচ্চা হয়েছে।

—বি
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫২৮
মঠ, বেলুড়, হাওড়া
৭ সেপ্টেম্বর, ১৯০১
কল্যাণীয়া নিবেদিতা,
আমরা সকলেই সাময়িক আবেগে চলি—অন্ততঃ এ-কাজটার বেলায় তাই। আমি স্প্রিংটি (কাজের ঝোঁকটি) চেপে রাখতে চাই; কিন্তু এমন একটা কিছু ঘটে যায়, যার ফলে স্প্রিং অবিরত শব্দ করতে থাকে; আর তা তো দেখতেই পাচ্ছ—এই চিন্তা চলছে, স্মরণ হচ্ছে, লেখা হচ্ছে, আঁচড় কাটা হচ্ছে—আরও কত কিছু!

বর্ষার কথা বলতে গেলে বলতে হয় পূর্ণবেগে তা এসে গেছে, আর দিনরাত চলেছে মুষলধারে বর্ষণ, কেবল বৃষ্টি—বৃষ্টি—আর বৃষ্টি। নদী সব ফুলে উঠে দু-কূল ভাসিয়ে চলেছে, দীঘি-পুকুর সব ভরপুর।

মঠের জমিতে যে বর্ষার জল দাঁড়ায়, তার নিষ্কাশনের জন্য একটি গভীর নর্দমা কাটা হচ্ছে। সেই কাজে খানিকটা খেটে আমি এইমাত্র ফিরলাম। কোন কোন জায়গায় বৃষ্টির জল কয়েক ফুট দাঁড়িয়ে যায়। আমার সেই বিশালাকার সারসটি এবং হংস-হংসীগুলি খুব স্ফূর্তিতে আছে। আমার পোষা কৃষ্ণসার (হরিণ)-টি মঠ থেকে পালিয়েছিল এবং তাকে খুঁজে বের করতে আমাদের দিন-কয়েক বেশ উদ্বেগে কাটাতে হয়েছে। আমার একটি হংসী দুর্ভাগ্যক্রমে কাল মারা গেছে। প্রায় এক সপ্তাহ যাবৎ তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। আমাদের একজন হাস্যরসিক বৃদ্ধ সাধু তাই বলছিলেন, ‘মশায় এই কলিযুগে যখন জল-বৃষ্টিতে হাঁসেরও সর্দি লাগে, আর ব্যাঙও হাঁচতে শুরু করে, তখন আর বেঁচে থেকে লাভ নেই।’

একটি রাজহংসীর পালক খসে যাচ্ছিল। আর কোন প্রতিকার জানা না থাকায় একটি টবে খানিকটা জলের সঙ্গে একটু কার্বলিক অ্যাসিড মিশিয়ে তাতেই কয়েক মিনিটের জন্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল—উদ্দেশ্য ছিল যে, হয় সেরে উঠবে, না হয় মরে যাবে; তা হংসীটা এখন ভাল আছে। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫২৯
মঠ, বেলুড়, হাওড়া
৮ই অক্টোবর, ১৯০১

প্রিয় নিবেদিতা,
… জীবনের স্রোতে উঠছি, পড়ছি। আজ যেন কতটা অবতরণের পথে …।



তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫৩০
মঠ, বেলুড়, হাওড়া
৮ সেপ্টেম্বর, ১৯০১

প্রিয় জো,
Abatement—কথাটার ব্যাখ্যাসমেত যে চিঠিখানা গেছে, তা তুমি ইতোমধ্যেই পেয়েছ নিশ্চয়। আমি নিজে সে চিঠি লিখিনি, আর টেলিগ্রামও পাঠাইনি। আমি তখন এত অসুস্থ ছিলাম যে, দুটোর একটাও করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। পূর্ববঙ্গ-ভ্রমণের পর থেকে শয্যাগত আছি বললেই হয়। দৃষ্টিশক্তির হ্রাস—এই আর একটি উপসর্গ জোটায় এখন আমি আগের চেয়েও খারাপ। এ-সব বিষয়ে আমি লিখতুম না’ কিন্তু কেউ কেউ দেখছি সব খুঁটিনাটি চায়।

যা হোক, তুমি তোমার জাপানী বন্ধুদের নিয়ে আসছ জেনে বেশ আনন্দিত হলাম। আমার ক্ষমতায় যতটা কুলায়, আমি তাঁদের খাতির-যত্ন করব। খুব সম্ভব আমি তখন মান্দ্রাজে থাকব। আমি ভাবছি যে, আগামী সপ্তাহে কলিকাতা ছাড়ব এবং ক্রমশঃ দক্ষিণদিকে এগিয়ে যাব।

তোমার জাপানী বন্ধুদের সঙ্গে উড়িষ্যার মন্দিরগুলি দেখা সম্ভব হবে কিনা, জানি না। আমি ম্লেচ্ছদের খাবার খেয়েছি বলে আমাকেই ঢুকতে দেবে কিনা, জানি না। লর্ড কার্জনকে ভেতরে যেতে দেয়নি।

যা হোক, আমার পক্ষে যতটা করা সম্ভব, তা আমি তোমার বন্ধুদের জন্য করতে সর্বদা প্রস্তুত। মিস মূলার কলিকাতায় আছেন, অবশ্য তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করেননি।



সতত স্নেহশীল
তোমাদের বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা (৫৩১-৫৪০)

পত্র সংখ্যা (৫৩১-৫৪০)

পত্র সংখ্যা - ৫৩১
গোপাললাল ভিলা
বেনারস ক্যাণ্টনমেণ্ট
৯ ফেব্রুআরী, ১৯০২

প্রিয় স্বরূপ,
মিসেস বুলের কণ্ঠাস্থি (Collar-bone)-র অবস্থা জেনে বড় কষ্ট হল। আশা করি চলে-ফিরে বেড়াবার মত শক্তি তিনি পাবেন। তাঁকে আমার আন্তরিক ভালবাসা জানাবে। চারুর চিঠি সম্বন্ধে উত্তর এই, তাকে বলবে সে যেন ‘ব্রহ্মসূত্র’ নিজে নিজে পড়ে। ‘ব্রহ্মসূত্রে বৌদ্ধধর্মের প্রসঙ্গ আছে’—চারুর এ-কথার অর্থ কি? অবশ্য সে ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যগুলিকে লক্ষ্য করেই এ কথা বলেছে, আর সেগুলিকে লক্ষ্য করেই বলা উচিত; ভাষ্যকারদের মধ্যে শঙ্কর তো শুধু শেষ ভাষ্যকার। বৌদ্ধসাহিত্যে অবশ্য বেদান্তের উল্লেখ আছে, আর বৌদ্ধধর্মের মহাযান শাখা তো অদ্বৈতপন্থী। বৌদ্ধ অমরসিংহ বুদ্ধদেবের একটি নাম ‘অদ্বয়বাদী’ বলে উল্লেখ করলেন কেন? চারু লিখেছে, উপনিষদে ‘ব্রহ্ম শব্দের উল্লেখ নাই!! কি আহাম্মকি!

আমার মতে বৌদ্ধধর্মের শাখাদ্বয়ের মধ্যে মহাযান প্রাচীনতর। মায়াবাদ ঋক‍্সংহিতার মতই প্রাচীন। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে যে ‘মায়া’ শব্দ আছে, সেটি ‘প্রকৃতি’র ভাব থেকে ক্রমশঃ বিকশিত হয়েছে। আমার মতে ঐ উপনিষদ্ অন্ততঃ বৌদ্ধধর্ম থেকে প্রাচীনতর।

সম্প্রতি আমি বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে অনেক নূতন আলো পেয়েছি। আর আমি প্রমাণ করতে প্রস্তুত আছিঃ

(১) নানা আকারের শিবপূজা বৌদ্ধদের আগেই প্রচলিত ছিল। বৌদ্ধগণ শৈবদের স্থানগুলি দখল করবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাতে অকৃতকার্য হয়ে সেই আবেষ্টনীরই মধ্যে নিজেদের নূতন নূতন স্থান করে নিয়েছিল—যেমন বুদ্ধগয়ায় ও সারনাথে।

(২) অগ্নিপুরাণে গয়াসুর সম্বন্ধে যে উল্লেখ আছে, তাতে (যেমন ডঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মত) বুদ্ধদেবকে মোটেই লক্ষ্য করা হয়নি, ওটা কেবল পূর্বপ্রচলিত একটি উপাখ্যান মাত্র।

(৩) বুদ্ধ যে গয়শীর্ষ পর্বতে বাস করতে গিয়েছিলেন, তাতেই ঐ স্থানের পূর্বাস্তিত্ব প্রমাণিত হয়।

(৪) আগে থেকেই গয়াতে পিতৃপুরুষের উপাসনা প্রচলিত ছিল, আর বৌদ্ধেরা হিন্দুদের কাছ থেকে পদচিহ্ন-উপাসনার অনুকরণ করেছিল।

(৫) বারাণসী সম্বন্ধে বক্তব্য এইঃ এটি শিবোপাসনার একটি প্রধান স্থান ছিল, ইত্যাদি কথা প্রাচীনতম লিপি প্রভৃতি থেকে প্রমাণিত হয়।

আমি বুদ্ধগয়া ও সাহিত্য থেকে অনেক নূতন তথ্য সংগ্রহ করেছি। চারুকে বল, সে নিজে নিজে পড়ুক, মূর্খদের মত দ্বারা যেন প্রভাবিত না হয়।

আমি এখন বারাণসীতে বেশ ভালই আছি। যদি ধীরে ধীরে এ ভাবেই স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে থাকে। তবে বেশ লাভই হবে।

বৌদ্ধধর্ম ও আধুনিক হিন্দুধর্মের সম্বন্ধ-বিষয়ে আমার মতের সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। আমি এ বিষয়ে একটু-আধটু আলো দেখতে পেয়েছি, তা বিশেষ ভাবে বুঝবার আগেই আমার শরীর যেতে পারে; কিন্তু কি ভাবে এ বিষয়ে অগ্রসর হতে হবে, তা আমি দেখিয়ে দিয়ে যাব; তোমাকে ও তোমাদের গুরুভাইদের তা কার্য পরিণত করতে হবে। তুমি আমার বিশেষ ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি



তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫৩২
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]

গোপাললাল ভিলা, বেনারস ক্যাণ্টনমেণ্ট
১০ ফেব্রুআরী ১৯০২
মাতা ও কন্যাকে ভারতে আবার স্বাগত জানাচ্ছি। জো-র সৌজন্যে মান্দ্রাজের একখানি সংবাদপত্র পেয়ে আমি বিশেষ আনন্দিত হয়েছি; নিবেদিতা মান্দ্রাজে যে অভ্যর্থনা পেয়েছে, তা নিবেদিতা ও মান্দ্রাজ উভয়ের পক্ষেই কল্যাণকর। তার ভাষণ যথার্থই সুন্দর হয়েছিল।

সুদীর্ঘ ভ্রমণ শেষ করে—আশা করি, আপনি এখন ভালভাবে বিশ্রাম নিচ্ছেন, এবং নিবেদিতা বিশ্রাম নিচ্ছে। আমার একান্ত ইচ্ছা যে, আপনারা কয়েক ঘণ্টার জন্য কলিকাতার পশ্চিমের কয়েকটি গ্রামে গিয়ে কাঠ, বাঁশ, বেত, অভ্র ও খড়ের তৈরী পুরাতন বাঙলার চালাঘর দেখে আসুন। এই বাংলোগুলি অপূর্ব শিল্পনৈপুণ্যের নিদর্শন। হায়! আজকাল শুয়োরের খোঁয়ারের মত ঘরগুলোরও ‘বাংলো’ নাম দেওয়া হয়।

প্রাচীনকালে কোন ব্যক্তি যখন প্রাসাদ নির্মাণ করতেন, তার সঙ্গে অতিথি-আপ্যায়নের জন্য একটি বাংলোও তৈরী করতেন। সেই শিল্প লুপ্ত হতে চলেছে। নিবেদিতার সমগ্র বিদ্যালয়টি যদি সেই ছাঁচে তৈরী করে দিতে পারতাম! তবে এখনও যে ক-টি অবশিষ্ট আছে, তাই দেখে রাখা ভাল, অন্ততঃ একটিও। ব্রহ্মানন্দ তার ব্যবস্থাদি করবেন; আপনাদের কাজ শুধু কয়েক ঘণ্টার ভ্রমণ।

ছোটখাট একটু ভ্রমণে মিঃ ওকাকুরা বেরিয়ে পড়েছেন—আগ্রা, গোয়ালিয়র, অজন্তা, ইলোরা, চিতোর, উদয়পুর, জয়পুর এবং দিল্লী দেখবার অভিপ্রায় নিয়ে। বারাণসীর এক সুশিক্ষিত ধনী যুবা—যার পিতার সঙ্গে আমাদের অনেক দিনের বন্ধুত্ব ছিল—গতকাল এই শহরে এসেছে। শিল্প সম্বন্ধে তার বিশেষ আগ্রহ; লুপ্তপ্রায় ভারতীয় শিল্প পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় সে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে প্রচুর অর্থব্যয় করেছে। মিঃ ওকাকুরার চলে যাবার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই সে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তাকে শিল্পময় ভারত (অর্থাৎ যতটুকু অবশিষ্ট আছে) দেখাবার সে-ই উপযুক্ত লোক এবং শিল্প সম্বন্ধে ওকাকুরার নির্দেশে সে নিশ্চয়ই বিশেষ উপকৃত হবে। ওকাকুরা এখানে ভৃত্যদের ব্যবহারের একটি সাধারণ টেরাকোটার জলের পাত্র দেখতে পেয়েছিলেন। সেটির আকৃতি ও খোদিত কারুকার্য দেখে তিনি একেবারে মুগ্ধ। কিন্তু এটি একটি সাধারণ মৃৎপাত্র এবং পথের ধাক্কা সহ্য করার অনুপযোগী, তাই তিনি আমাকে অনুরোধ করে গিয়েছেন, পিতল দিয়ে অবিকল সেরূপ আর একটি তৈরী করাতে। কি করা যায় ভেবে ভেবে আমি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলাম। কয়েক ঘণ্টা পরে আমার যুবক বন্ধুটি আসে, সে সেটা করে দিতে রাজী তো হয়েছেই, আবার বলেছে, ওকাকুরার পছন্দ ওই জিনিষটির চেয়ে বহুগুণ ভাল খোদিত কারুকার্যবিশিষ্ট কয়েক-শ টেরাকোটার পাত্র সে দেখাতে পারে।

সেই অপূর্ব পুরাতন শৈলীতে প্রাচীন চিত্রাবলীতে ও সে দেখাবে বলেছে। প্রাচীন রীতিতে আঁকতে পারে, এরূপ একটি মাত্র পরিবার বারাণসীতে টিকে আছে। তাদের মধ্যে একজন একটি মটর-দানার উপর শিকারের একটি সম্পূর্ণ চিত্র এঁকেছেন—খুঁটিনাটি বর্ণনাসহ একেবারে নিখুঁত কাজ। পর্যটন শেষ করে ওকাকুরা আবার আশা করি এই শহরে ফিরে আসবেন, তখন এই ভদ্রলোকের অতিথি হয়ে অবশিষ্ট দ্রষ্টব্য জিনিষগুলি কিছু কিছু দেখে যাবেন।

মিঃ ওকাকুরার সঙ্গে নিরঞ্জন গিয়েছে। তিনি জাপানী বলে কোন মন্দিরে তাঁর প্রবেশ করা নিয়ে কেউ আপত্তি করে না। মনে হয়, তিব্বতী ও অন্যান্য উত্তরদেশীয় বৌদ্ধগণ বরাবরই শিবপূজার উদ্দেশ্যে এখানে আসছেন।

তারা তাঁকে শিবের প্রতীক স্পর্শ করতে ও পূজা করতে দিয়েছে। মিসেস এনি বেস্যাণ্ট একবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বেচারী যদিও খালি পায়ে শাড়ী পরে পুরোহিতদের সামনে দীনহীনভাবে ধূলোয় লুটিয়ে পড়েছিলেন, তথাপি তাঁকে মন্দিরপ্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। আমাদের বড় বড় মন্দিরগুলিরকোনটাতেই বৌদ্ধদের অহিন্দু বলে মনে করা হয় না।

আমার এখনও কিছু স্থির হয়নি; শীঘ্রই এ স্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে পারি। শিবানন্দ ও ছেলেরা (শিষ্যরা) আপনাকে তাদের স্বাগত, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানাচ্ছে।

আপনার চিরদিনের
অশেষ স্নেহের সন্তান
বিবেকানন্দ

*******************

পত্র সংখ্যা - ৫৩৩
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

গোপাললাল ভিলা, বেনারস ক্যাণ্টনমেণ্ট
১২ ফেব্রুআরী, ১৯০২
কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্রে সবিশেষ জানিয়া আনন্দিত হলাম। নিবেদিতার স্কুল সম্বন্ধে যা আমার বলবার ছিল, তাকে লিখেছি। বলবার এই যে, তার যা ভাল বিচার হয়, করবে।

আর কোন বিষয়ের মতামত আমায় জিজ্ঞেস কর না। তাতে আমার মাথা খারাপ হয়। তুমি কেবল ঐ কাজটা করে দিও—এই পর্যন্ত। টাকা পাঠিয়ে দিও; কারণ উপস্থিত দু-চার টাকা মাত্র আছে।

কানাই মাধুকরী খায়, ঘাটে জপ করে, রাত্রে এসে শোয়; ন্যাদা poor man’s work (গরীদের সেবা) করে; রাত্রে এসে শোয়। খুড়ো (Okakura) আর নিরঞ্জন আগ্রায় গেছে; আজ তাদের পত্র আসতে পারে।

যেমন প্রভু করাবেন করে যেও। এদের-ওদের মতামত কি? সকলকে আমার ভালবাসা জানিও এবং ছেলেদের। ইতি

বিবেকানন্দ

*******************

পত্র সংখ্যা - ৫৩৪
[ভগিনী নিবেদিতাকে লিখিত]
বেনারস
১২ ফেব্রুআরী, ১৯০২
সর্বপ্রকার শক্তি তোমাতে উদ্বুদ্ধ হোক, মহামায়া স্বয়ং তোমার হৃদয়ে এবং বাহুতে অধিষ্ঠিত হোন! অপ্রতিহত মহাশক্তি তোমাতে জাগ্রত হোক এবং সম্ভব হলে সঙ্গে সঙ্গে অসীম শান্তিও তুমি লাভ কর—এই আমার প্রার্থনা …।

যদি শ্রীরামকৃষ্ণ সত্য হন, তবে যেমনভাবে তিনি আমাকে জীবনের পথ দেখিয়েছেন, ঠিক তেমনিভাবে কিম্বা তার চেয়ে সহস্রগুণ স্পষ্টভাবে তোমাকেও যেন তিনি পথ দেখিয়ে নিয়ে যান।

বিবেকানন্দ

*******************

পত্র সংখ্যা - ৫৩৫
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

গোপাললাল ভিলা, বেনারস ছাউনী
১৮ ফেব্রুআরী, ১৯০২
অভিন্নহৃদয়েষু,
কাল তোমায় যে পত্র লিখেছি টাকার প্রাপ্তিস্বীকার সহিত, তাহা এতক্ষণে নিশ্চিত পেয়েছ। আজ এ পত্র লেখবার প্রধান উদ্দেশ্য … সম্বন্ধে। তুমি পত্রপাঠ তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসবে। … তারপর রোগ কি, গয়ায় কেমন ছিল ইত্যাদি; … সুযোগ্য ডাক্তার ডাকিয়ে রোগটি বেশ নির্ণয় করে নেবে। তারপর রামবাবুর বড় মেয়ে বিষ্টুমোহিনী এখন কোথায়?—সে সম্প্রতি বিধবা হয়েছে …।

রোগের চেয়ে ভাবনা বড়! দু-দশ টাকা যা দরকার হয় দেবে। যদি একজনের মনে—এ সংসার নরককুণ্ডের মধ্যে একদিনও একটু আনন্দ ও শান্তি দেওয়া যায়, সেইটুকুই সত্য, এই তো আজন্ম ভুগে দেখছি—বাকী সব ঘোড়ার ডিম।

অতি শীঘ্র জবাব দেবে। খুড়ো (Okakuraবা অক্রূর খুড়ো) আর নিরঞ্জন গোয়ালিয়র হতে পত্র লিখেছে। … এখন এথায় ক্রমে গরম পড়ে আসছে। বোধগয়া অপেক্ষা এথায় শীত অধিক ছিল। … নিবেদিতার সরস্বতীপূজার ধুমধাম শুনে বড়ই খুশী হলাম। নিবেদিতা শীঘ্রই স্কুল খোলে খুলুক। … পাঠ, পুজো, পড়াশুনা সকলের যাতে হয়, সে-চেষ্টা করবে। তোমরা আমার ভালবাসা জানবে।



বিবেকানন্দ

*******************

পত্র সংখ্যা - ৫৩৬
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

গোপাললাল ভিলা, বেনারস
২১ ফেব্রুআরী, ১৯০২

অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার এক পত্র এইমাত্র পাইলাম। … মা, দিদিমা যদি আসতে চান পাঠিয়ে দিও। এই প্লেগ আসবার সময়টা কলিকাতা হতে সরে এলেই ভাল। এলাহাবাদে বড় প্লেগ চলেছে। এবার কাশীতে আসবে কিনা জানি না। তবে প্লেগ গেল বৎসর এই সময়ে কাশীতে এসেছিল। … মিসেস বুলকে আমার নাম করে বল যে, ইলোরা-ফিলোরা মহা কষ্টের পথ এবং ভারী গরম। তাঁর এত tired (ক্লান্ত) শরীর যে, ভ্রমণে যাওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। খুড়োর (Okakura) ক-দিন হল চিঠিপত্র পাইনি। অজন্তা গেছে—এই খবর। মহান্তও কোন খবর দেয় নাই। তবে রাজা প্যারীমোহনের পত্রের জবাবে যদি দেয় …।

নেপালের minister (মন্ত্রী)-এর ব্যাপারটা সবিশেষ লিখবে। মিসেস বুল, মিস ম্যাকলাউড প্রভৃতি সকলকে আমার বিশেষ ভালবাসা, আশীর্বাদাদি দিবে; আর তুমি, বাবুরাম প্রভৃতি সকলে আমার নমস্কার ও ভালবাসা ইত্যাদি জানবে। গোপালদাদা চিঠি পেয়েছেন কিনা? ছাগলটাকে একটু দেখো। ইতি



বিবেকানন্দ

পুনঃ—ছেলেরা সকলে সাষ্টাঙ্গ জানাচ্ছে।

*******************

পত্র সংখ্যা - ৫৩৭
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

গোপাললাল ভিলা, বেনারস
২৪ ফেব্রুআরী, ১৯০২

অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার প্রেরিত একটি আমেরিকান ছোট পার্শেল আজ প্রাতঃকালে পেলুম। রেজেষ্ট্রি-করা যে পত্রের কথা লিখেছ, তা কেন, কোন পত্রই পাইনি। নেপালওয়ালা এল কিনা, কি বৃত্তান্ত, এ-সব তো কিছুই জানতে পারলুম না। … একখানা চিঠি লিখতে হলেই এত হাঙ্গাম আর দেরী!! … এখন হিসাবটা পেলেই যে বাঁচি! তাও আবার ক-মাসে পাই!



বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫৩৮
মঠ, বেলুড়, হাওড়া
২১ এপ্রিল, ১৯০২

প্রিয় জো,
মনে হচ্ছে যেন জাপান যাবার সঙ্কল্পটা ফেঁসে গেল। মিসেস বুল চলে গেলেন; তুমিও যাচ্ছ। আমার সঙ্গে জাপানীদের তেমন পরিচয় নেই।

সদানন্দ নেপালীদের সঙ্গে নেপালে গেছে। কানাইও গেছে; মার্গট এই মাস শেষ হওয়ার আগে যেতে পারলে না বলে ক্রিষ্টিন আগে যাত্রা করতে পারলে না।

লোকে বলে, আমি বেশ আছি; কিন্তু এখনও বড় দুর্বল, আর জল-পান একেবারে নিষিদ্ধ। তবে এইটুকু রয়েছে যে, রাসায়নিক বিশ্লেষণে অনেকটা উন্নতি দেখা গেছে। পায়ের ফোলা একেবারে গেছে।

লেডি বেটি, মিঃ লেগেট, এলবার্টা ও হলিকে আমার অসীম ভালবাসা জানাবে। খুকুর উপর আমার আশীর্বাদ তো তার জন্মের আগে থেকেই আছে, আর চিরকাল থাকবে।

মায়াবতী তোমার কেমন লাগল? এ-বিষয়ে আমার এক ছত্র লিখো।

চিরস্নেহাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫৩৯
মঠ, বেলুড়, হাওড়া
১৫ মে, ১৯০২

প্রিয় জো,
মাদাম কালভেকে লিখিত পত্রখানি পাঠালাম।

আমি অনেকটা ভালই আছি; অবশ্য যতটা আশা করেছিলাম, তার তুলনায় কিছুই নয়। নিরিবিলি থাকার একটা প্রবল আগ্রহ আমার হয়েছে—আমি চিরকালের মত অবসর নেব, আর কোন কাজ আমার থাকবে না। যদি সম্ভব হয় তো আবার আমার পুরাতন ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করব।

জো, তোমার সর্বাঙ্গীণ কুশল হোক—তুমি দেবতার মত আমায় রক্ষণাবেক্ষণ করছ।



চিরস্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
*******************

পত্র সংখ্যা - ৫৪০
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]
মঠ
১৪ জুন, ১৯০২
মা,
আপনার স্নেহপূর্ণ চিঠিখানির উত্তর আরও আগে দিতে পারলে ভাল হত।

ডাক্তার জেন্‌সের সম্বন্ধে একখানি বই আমার কাছে এসেছে, কিন্তু কিছু লিখবার নির্দেশসহ কোন পত্র সঙ্গে না থাকায় আমাদের অতি শ্রদ্ধেয় বন্ধুর সম্বন্ধে কোন মত প্রকাশ করতে সাহস হল না। যা হোক, আপনার বর্তমান অভিপ্রায় অনুসারে আমি মিঃ ফক্সকে যথাসম্ভব সত্বর লিখব।

আমি এক রকম আছি; আর সব ভাল। নিবেদিতা পাহাড়ে আছে। ওকাকুরা শহরে ফিরে এসে শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্র ঠাকুরের অতিথি হয়েছেন, একদিন মঠে এসেছিলেন; কিন্তু আমি বাইরে গিয়েছিলাম। আশা করি শীঘ্রই তাঁর সঙ্গে দেখা হবে এবং তাঁর ভবিষ্যৎ অভিপ্রায় জানতে পারব।

(জাপানী) যুবক হেরির এখানে জ্বর হয়েছিল; সে দিন কয়েকের মধ্যেই সেরে উঠে কিছু দিনের জন্য ওকাকুরার সঙ্গে গেছে। তার ধর্মভাব দেখেই সবাই তাকে ভালবাসে। ব্রহ্মচর্য সম্বন্ধে তার ধারণাগুলি খুব উচ্চ এবং তার অভিলাষ এই যে, জাপানে সে খাঁটি ব্রহ্মচর্যের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি সন্ন্যাসি-সঙ্ঘ স্থাপন করবে। কিন্তু আমার মনে হয় কোন জাতিকে পূর্ণ ব্রহ্মচর্যের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে সর্বপ্রথম বিবাহের পবিত্রতা ও অবিচ্ছেদ্যতার মধ্য দিয়ে মাতৃত্বের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার ভাব অর্জন করতে হবে। রোমান ক্যাথলিক এবং হিন্দুগণ বিবাহবন্ধকে পবিত্র ও অবিচ্ছেদ্য মনে করেন, তাই তাঁরা ব্রহ্মচর্যে প্রতিষ্ঠিত মহাশক্তিমান‍্ পবিত্র বহু নরনারী জন্ম দিতে পেরেছেন। আরবগণের দৃষ্টিতে বিবাহ একটা চুক্তি অথবা বলপূর্বক অধিকারের ব্যাপার মাত্র; ইচ্ছামাত্র সেই বন্ধন ছিন্ন করা যেতে পারে। ফলে কুমারী কিম্বা ব্রহ্মচারীর কোন আদর্শ তাদের মধ্যে বিকশিত হতে পারেনি।

আধুনিক বৌদ্ধধর্ম এমন সব জাতের হাতে গিয়ে পড়েছে, যাদের মধ্যে বিবাহ-প্রথার পূর্ণ অভিব্যক্তি না হওয়ায় তারা সন্ন্যাস-আশ্রমকে একটা হাস্যাস্পদ ব্যাপার করে তুলেছে। সুতরাং যতদিন না জাপানীদের মধ্যে শুধু পরস্পরের প্রতি দৈহিক আকর্ষণ ও ভালবাসা ছাড়াও বিবাহের উচ্চ ও পবিত্র আদর্শ গড়ে উঠছে, ততদিন তাদের মধ্যে বড় সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনীর উদ্ভব কেমন করে সম্ভব হবে, তা আমি বলতে পারি না। আপনি যেমন বুঝতে পেরেছেন যে, সতীত্বই জীবনের একমাত্র গৌরব, তেমনি আমার দৃষ্টিও এ বিষয়ে খুলে গেছে যে, আমরণ সাধুচরিত্র জনকয়েক মহাশক্তিশালী ব্যক্তির জন্ম দিতে হলে জনসাধারণের একটা বৃহত্তম অংশকেও এই সুমহান্ পবিত্রতায় প্রতিষ্ঠিত করা অত্যাবশ্যক।

অনেক কিছু লিখব ভেবেছিলাম; কিন্তু শরীর বড় দুর্বল। মেরী লুই এখানে শ্রীচৈতন্যের ভক্তরূপে এসেছে এবং শুনতে পাচ্ছি যে, জনকয়েক ধনী তাকে লুফে নিয়েছে। সে যেন এবারে প্রচুর অর্থ পায়—এই আমার আকাঙ্ক্ষা। ‘আমাকে যে যেভাবে উপাসনা করে, আমি সে-ভাবেই তাকে অনুগ্রহ করি।’৪২—সে টাকা চেয়েছিল; ভগবান্‌ তাকে প্রচুর টাকা দিন।

আপনার চিরস্নেহাবদ্ধ সন্তান
তোমাদের বিবেকানন্দ

… পাশ্চাত্যের এই সমস্ত জাঁকজমক নিতান্ত নিষ্ফল, শুধু আত্মার বন্ধনস্বরূপ। আমার জীবন এর চেয়ে স্পষ্টতর ভাবে জগতের নিষ্ফলতা কখনও অনুভব করিনি। ভগবান্‌ সকলের বন্ধন মোচন করুন, সকলেই মায়ামুক্ত হোক—এই আমার চিরপ্রার্থনা। ইতি

তোমাদের বিবেকানন্দ
*******************

Post a Comment

0 Comments