দক্ষিণেশ্বরে পণ্ডিত শশধর প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
তৃতীয় ভাগ 

নবম খণ্ড
শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে পণ্ডিত শশধরাদি ভক্তসঙ্গে

দক্ষিণেশ্বরে পণ্ডিত শশধর প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

===========

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৩০শে জুন

কালীব্রহ্ম — ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে তাঁর সেই পূর্বপরিচিত ঘরে মেঝেতে বসিয়া আছেন, — কাছে পণ্ডিত শশধর। মেঝেতে মাদুর পাতা — তাহার উপর ঠাকুর, পণ্ডিত শশধর এবং কয়েকটি ভক্ত বসিয়াছেন। কতকগুলি ভক্ত মাটির উপরেই বসিয়া আছেন। সুরেন্দ্র, বাবুরাম, মাস্টার, হরিশ, লাটু, হাজরা, মণি মল্লিক প্রভৃতি ভক্তেরা উপস্থিত আছেন। ঠাকুর পণ্ডিত পদ্মলোচনের কথা কহিতেছেন। পদ্মলোচন বর্ধমানের রাজার সভাপন্ডিত ছিলেন। বেলা অপরাহ্ন — প্রায় ৪টা।

আজ সোমবার, ৩০শে জুন, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ (১৭ই আষাঢ়, শুক্লা অষ্টমী)। ছয়দিন হইল শ্রীশ্রীরথযাত্রার দিবসে পণ্ডিত শশধরের সহিত ঠাকুরের কলিকাতায় দেখা ও আলাপ হইয়াছিল। আজ আবার পণ্ডিত আসিয়াছেন। সঙ্গে শ্রীযুক্ত ভূধর চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর জ্যেষ্ঠ সহোদর। কলিকাতায় তাহাদের বাড়িতে পণ্ডিত শশধর আছেন।

পণ্ডিত জ্ঞানমার্গের পন্থী। ঠাকুর তাঁহাকে বুঝাইতেছেন — যাঁহারই নিত্য তাঁহারই লীলা — যিনি অখণ্ড সচ্চিদানন্দ, তিনিই লীলার জন্য নানা রূপ ধরিয়াছেন। ঈশ্বরের কথা বলিতে বলিতে ঠাকুর বেহুঁশ হইতেছেন। ভাবে মাতোয়ারা হইয়া কথা কহিতেছেন। পণ্ডিতকে বলিতেছেন, “বাপু, ব্রহ্ম অটল, অচল, সুমেরুবৎ। কিন্তু ‘অচল’ যার আছে তার ‘চল’ও আছে।”

ঠাকুর প্রেমানন্দে মত্ত আছেন। সেই গন্ধর্ব বিনিন্দিত কণ্ঠে গান গাহিতেছেন। গানের পর গান গাহিতেছেন:

কে জানে কালী কেমন, ষড়্‌ দর্শনে না পায় দরশন।

গান – মা কি এমনি মায়ের মেয়ে।
যার নাম জপিয়ে মহেশ বাঁচেন হলাহল খাইয়ে ৷৷
সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় যার কটাক্ষে হেরিয়ে।
সে যে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রাখে উদরে পুরিয়ে ৷৷
যে চরণে শরণ লয়ে দেবতা বাঁচেন দায়ে।
দেবের দেব মহাদেব যাঁর চরণে লুটায়ে ৷৷

গান – মা কি শুধুই শিবের সতী।
যাঁরে কালের কাল করে প্রণতি ৷৷
ন্যাংটাবেশে শত্রু  নাশে মহাকাল হৃদয়ে স্থিতি।
বল দেখি মন সে বা কেমন, নাথের বুকে মারি লাথি ৷৷
প্রসাদ বলে মায়ের লীলা, সকলই জেনো ডাকাতি।
সাবধানে মন কর যতন, হবে তোমার শুদ্ধমতি ৷৷

গান – আমি সুরা পান করি না, সুধা খাই জয় কালী বলে,
মন-মাতালে মাতাল করে, মদ-মাতালে মাতাল বলে।
গুরুদত্ত বীজ লয়ে প্রবৃত্তি তায় মশলা দিয়ে,
জ্ঞান শুঁড়িতে চোয়ায় ভাঁটি, পান করে মোর মন-মাতালে।
মূল মন্ত্র যন্ত্র ভরা, শোধন করি বলে তারা,
প্রসাদ বলে এমন সুরা খেলে চতুর্বর্গ মিলে।

গান – শ্যামাধন কি সবাই পায়,
অবোধ মন বোঝে না একি দায়।
শিবেরই অসাধ্য সাধন মনমজানো রাঙা পায় ৷৷

ঠাকুরের ভাবাবস্থা একটু কম পড়িয়াছে। তাঁহার গান থামিল। একটু চুপ করিয়া আছেন। ছোট খাটটিতে গিয়া বসিয়াছেন।

পণ্ডিত গান শুনিয়া মোহিত হইয়াছেন। তিনি অতি বিনীত ভাবে ঠাকুরকে বলিতেছেন, “আবার গান হবে কি?”

ঠাকুর একটু পরেই আবার গান গাহিতেছেন:

শ্যামাপদ আকাশেতে মন ঘুড়িখানা উড়তেছিল,
কলুষের কুবাতাস পেয়ে গোপ্তা খেয়ে পড়ে গেল।

গান – এবার আমি ভাল ভেবেছি।
ভাল ভাবীর কাছে ভাব শিখেছি।
যে দেশে রজনী নাই, সেই দেশের এক লোক পেয়েছি।
আমি কিবা দিবা কিবা সন্ধ্যা সন্ধ্যারে বন্ধ্যা করেছি ৷৷

গান – অভয় পদে প্রাণ সঁপেছি।
আমি আর কি যমের ভয় রেখেছি ৷৷
কালী নাম মহামন্ত্র আত্মশিরশিখায় বেঁধেছি।
(আমি) দেহ বেচে ভবের হাটে, দুর্গানাম কিনে এনেছি ৷৷

“দুর্গানাম কিনে এনেছি” এই কথা শুনিয়া পণ্ডিত অশ্রুবারি বিসর্জন করিতেছেন। ঠাকুর আবার গাহিতেছেন:

গান – কালীনাম কল্পতরু, হৃদয়ে রোপণ করেছি।
এবার শমন এলে হৃদয় খুলে দেখাব তাই বসে আছি ৷৷
দেহের মধ্যে ছজন কুজন, তাবের ঘরে দূর করেছি।
রামপ্রসাদ বলে দুর্গা বলে যাত্রা করে বসে আছি ৷৷

গান – আপনাতে আপনি থেকো মন যেও নাকো কারু ঘরে।
যা চাবি তাই বসে পাবি (ওরে) খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে ৷৷

ঠাকুর গান গাহিয়া বলিতেছেন — মুক্তি অপেক্ষা ভক্তি বড় —

গান – আমি মুক্তি দিতে কাতর নই,
শুদ্ধাভক্তি দিতে কাতর হই গো।
আমার ভক্তি যেবা পায় সে যে সেবা পায়,
তারে কেবা পায় সে যে ত্রিলোকজয়ী ৷৷
শুদ্ধাভক্তি এক আছে বৃন্দাবনে,
গোপ-গোপী ভিন্ন অন্যে নাহি জানে।
ভক্তির কারণে নন্দের ভবনে
পিতাজ্ঞানে নন্দের বাধা মাথায় বই ৷৷

=============

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৩০শে জুন

শাস্ত্রপাঠ ও পাণ্ডিত্য মিথ্যা — তপস্যা চাই — বিজ্ঞানী

পণ্ডিত বেদাদি শাস্ত্র পড়িয়াছেন ও জ্ঞানচর্চা করেন। ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়া তাঁহাকে দেখিতেছেন ও গল্পচ্ছলে নানা উপদেশ দিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (পণ্ডিতের প্রতি) — বেদাদি অনেক শাস্ত্র আছে, কিন্তু সাধন না করলে, তপস্যা না করলে — ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না।

“ষড় দর্শনে দর্শন মেলে না, আগম নিগম তন্ত্রসারে।

“তবে শাস্ত্রে যা আছে, সেই সব জেনে নিয়ে সেই অনুসারে কাজ করতে হয়। একজন একখানা চিঠি হারিয়ে ফেলেছিল। কোথায় রেখেছে মনে নাই। তখন সে প্রদীপ লয়ে খুঁজতে লাগল। দু-তিনজন মিলে খুঁজে চিঠিখানা পেলে। তাতে লেখা ছিল, পাঁচ সের সন্দেশ আর একখানা কাপড় পাঠাইবে। সেইটুকু পড়ে লয়ে সে আবার চিঠিখানা ফেলে দিলে। তখন আর চিঠির কি দরকার। এখন পাঁচ সের সন্দেশ আর একখানা কাপড় কিনে পাঠালেই হবে।”

[The Art of Teaching : পঠন, শ্রবণ ও দর্শনের তারতম্য ]

“পড়ার চেয়ে শুনা ভাল, — শুনার চেয়ে দেখা ভাল। গুরুমুখে বা সাধুমুখে শুনলে ধারণা বেশি হয়, — আর শাস্ত্রের অসার ভাগ চিন্তা করতে হয় না।

“হনুমান বলেছিল, ‘ভাই, আমি তিথি-নক্ষত্র অত সব জানি না — আমি কেবল রামচিন্তা করি।’

“শুনার চেয়ে দেখা আরও ভাল। দেখলে সব সন্দেহ চলে যায়। শাস্ত্রে অনেক কথা তো আছে; ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার না হলে — তাঁর পাদপদ্মে ভক্তি না হলে — চিত্তশুদ্ধি না হলে — সবই বৃথা। পাঁজিতে লিখেছে বিশ আড়া জল — কিন্তু পাঁজি টিপ্‌লে এক ফোঁটাও পড়ে না! এক ফোঁটাই পড়, তাও না।”

[বিচার কতদিন — ঈশ্বরদর্শন পর্যন্ত — বিজ্ঞানী কে? ]

“শাস্ত্রাদি নিয়ে বিচার কতদিন? যতদিন না ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার হয়। ভ্রমর গুনগুন করে কতক্ষণ? যতক্ষণ ফুলে না বসে। ফুলে বসে মধুপান করতে আরম্ভ করলে আর শব্দ নাই।

ভক্ত — ঈশ্বরদর্শনের পরও শরীর থাকে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — কারু কারু কিছু কর্মের জন্য থাকে, — লোকশিক্ষার জন্য। গঙ্গাস্নানে পাপ যায় আর মুক্তি হয় — কিন্তু চক্ষু অন্ধ যায় না। তবে পাপের জন্য যে কয় জন্ম কর্মভোগ করতে হয় সে কয় জন্ম আর হয় না। যে পাক দিয়েছে সেই পাকটাই কেবল ঘুরে যাবে। বাকীগুলো আর হবে না। কামক্রোধাদি সব দগ্ধ হয়ে যায়, — তবে শরীরটা তাকে কিছু কর্মের জন্য।

পণ্ডিত — ওকেই সংস্কার বলে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — বিজ্ঞানী সর্বদা ঈশ্বরদর্শন করে — তাই তো এরূপ এলানো ভাব। চক্ষু চেয়েও দর্শন করে। কখনও নিত্য হতে লীলাতে থাকে, কখনও লীলা হতে নিত্যেতে যায়।

পণ্ডিত — এটি বুঝলাম না।

শ্রীরামকৃষ্ণ — নেতি নেতি বিচার করে সেই নিত্য অখণ্ড সচ্চিদানন্দে পৌঁছয়। তারা এই বিচার করে — তিনি জীব নন, জগৎ নন, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব নন। নিত্যে পৌঁছে আবার দেখে — তিনি এই সব হয়েছেন — জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব।

“দুধকে দই পেতে মন্থন করে মাখন তুলতে হয়। কিন্তু মাখন তোলা হলে দেখে যে, ঘোলেরই মাখন, মাখনেরই ঘোল। খোলেরই মাঝ, মাঝেরই খোল।”

পণ্ডিত (ভূধরের প্রতি, সহাস্যে) — বুঝলে? এ বুঝা বড় শক্ত!

শ্রীরামকৃষ্ণ — মাখন হয়েছে তো ঘোলও হয়েছে। মাখনকে ভাবতে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে ঘোলকেও ভাবতে হয়, — কেননা ঘোল না থাকলে মাখন হয় না। তাই নিত্যকে মানতে গেলেই লীলাকেও মানতে হয়। অনুলোম ও বিলোম। সাকার-নিরাকার সাক্ষাৎকারের পর এই অবস্থা! সাকার চিন্ময়রূপ, নিরাকার অখণ্ড সচ্চিদানন্দ।

“তিনিই সব হয়েছেন, — তাই বিজ্ঞানীর ‘এই সংসার মজার কুটি’। জ্ঞানীর পক্ষে ‘এ সংসার ধোঁকার টাটি।’ রামপ্রসাদ ধোঁকার টাটি বলেছিল। তাই একজন জবাব দিয়েছিল, —

এই সংসার মজার কুটি, আমি খাই দাই আর মজা লুটি।
ওরে বদ্যি নাহিক বুদ্ধি, বুঝিস কেবল মোটামুটি ৷৷
জনক রাজা মহাতেজা তার কিসের ছিল ক্রটি।
সে এদিক-ওদিক দুদিক রেখে খেয়েছিল দুধের বাটি ৷৷

(সকলের হাস্য)

“বিজ্ঞানী ঈশ্বরের আনন্দ বিশেষরূপে সম্ভোগ করেছে। কেউ দুধ শুনেছে, কেউ দেখেছে, কেউ খেয়েছে। বিজ্ঞানী দুধ খেয়েছে আর খেয়ে আনন্দলাভ করেছে ও হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে।”

“তবে একটি আছে, ঈশ্বরকে দর্শনের পরও কথা চলতে পারে। সে-কথা কেবল ঈশ্বরের আনন্দের কথা, — যেমন মাতালের ‘জয় কালী’ বলা। সর ভ্রমর ফুলে বসে মধুপান করার পর আধ আধ স্বরে গুনগুন করে।”

বিজ্ঞানীর নাম করিয়া ঠাকুর বুঝি নিজের অবস্থা ইঙ্গিতে বলিতেছেন।

“জ্ঞানী ‘নেতি নেতি’ বিচার করে। এই বিচার করতে করতে যেখানে আনন্দ পায় সেই ব্রহ্ম।

“জ্ঞানীর স্বভাব কিরূপ? — জ্ঞানী আইন অনুসারে চলে।

“আমায় চানকে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে কতকগুলি সাধু দেখলাম। তারা কেউ কেউ সেলাই করছিল। (সকলের হাস্য) আমরা যাওয়াতে সে-সব ফেললে। তারপর পায়ের উপর পা দিয়ে বসে আমাদের সঙ্গে কথা কইতে লাগল। (সকলের হাস্য)

“কিন্তু ঈশ্বরীয় কথা জিজ্ঞাসা না করলে জ্ঞানীরা সে-সব কথা কয় না। আগে জিজ্ঞাসা করবে এখন, তুমি কেমন আছ। ক্যায়সা হ্যায় — বাড়ির সব কেমন আছে।

“কিন্তু বিজ্ঞানীর স্বভাব আলাদা। তার এলানো স্বভাব — হয়তো কাপড়খানা আলগা — কি বগলের ভিতর — ছেলেদের মতো।

“ঈশ্বর আছেন এইটি জেনেছে, এর নাম জ্ঞানী। কাঠে নিশ্চিত আগুন আছে যে জেনেছে সেই জ্ঞানী। কিন্তু কাঠ জ্বেলে রাঁধা, খাওয়া, হেউ-ঢেউ হয়ে যাওয়া, যার হয় তার নাম বিজ্ঞানী।

“কিন্তু বিজ্ঞানীর অষ্টপাশ খুলে যায়, কাম-ক্রোধাদির আকার মাত্র থাকে।”

পণ্ডিত — “ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিঃ ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ।”১

[পূর্বকথা — কৃষ্ণকিশোরের বাড়ি গমন — ঠাকুরের বিজ্ঞানীর অবস্থা ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, একখানা জাহাজ সমুদ্র দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ যত লোহা-লক্কড়, পেরেক, ইস্ক্রু উপড়ে যেতে লাগল। কাছে চুম্বকের পাহাড় ছিল তাই সব লোহা আলগা হয়ে উপড়ে যেতে লাগল।

“আমি কৃষ্ণকিশোরের বাড়ি যেতাম। একদিন গিয়েছি, সে বললে, তুমি পান খাও কেন? আমি বললাম, খুশি পান খাব — আরশিতে মুখ দেখব, — হাজার মেয়ের ভিতর ন্যাংটো হয়ে নাচব! কৃষ্ণকোশোরের পরিবার তাকে বকতে লাগল — বললে, তুমি কারে কি বল? — রামকৃষ্ণকে কি বলছ?

“এ-অবস্থা হলে কাম-ক্রোধাদি দগ্ধ হয়ে যায়। শরীরের কিছু হয় না; অন্য লোকের শরীরের মতো দেখতে সব — কিন্তু ভিতর ফাঁক আর নির্মল।”
ভক্ত—ঈশ্বর দর্শনের পরও শরীর থাকে ? 
শ্রীরামকৃষ্ণ—কারু কারু কিছু কর্মের জন্য থাকে,—লােকশিক্ষার জন্য। গঙ্গাস্নানে পাপ যায় আর মুক্তি হয়—কিন্তু চক্ষু অন্ধ যায় না। তবে পাপের জন্য যে কয় জন্ম কর্মভোগ করতে হয় সে কয় জন্মে আর হয় না। যে পাক দিয়েছে সেই পাকটাই কেবল ঘুরে যাবে । বাকীগুলো আর হবে না। কাম-ক্রোধাদি সব দগ্ধ হয়ে যায়, তবে শরীরটা থাকে কিছু কর্মের জন্য। 
পণ্ডিত—ওকেই সংস্কার বলে । 
শ্রীরামকৃষ্ণ—বিজ্ঞানী সর্বদা ঈশ্বর দর্শন করে—তাই ত এরুপ এলানো ভাব। চক্ষু চেয়েও দর্শন করে। কখনও নিত্য হ'তে লীলাতে থাকে,কখনও লীলা হ'তে নিত্যেতে যায়। 
পণ্ডিত—এটি বুঝলাম না। 
শ্রীরামকৃষ্ণ—নেতি নেতি বিচার করে সেই নিতা অখণ্ড সচ্চিদানন্দে পৌঁছায়। তারা এই বিচার করে—তিনি জীব নন, জগৎ নন, চতুবিংশতি তত্ত্ব নন। নিত্যে পৌছে আবার দেখে—তিনি এই সব হয়েছেন—জীব জগৎ, চতুবিংশতি তত্ত্ব। 
"দুধকে দই পেতে মন্থন করে মাখন তুলতে হয়। কিন্তু মাখন তােলা হলে দেখে। যে ঘােলেই মাখন, মাখনেরই ঘোল। খােলেরই মাঝ, মাঝেরই খােল।” 
পণ্ডিত (ভূধরের প্রতি, সহাস্যে)— বুঝলে ? এ বুঝা বড় শক্ত ! 
শ্রীরামকৃষ্ণ—মাখন হয়েছে ত ঘােলও হয়েছে। মাখনকে ভাবতে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে ঘোলকে ভাবতে হয়, কেন না ঘােল না থাকলে মাখন হয় না। তাই নিত্যকে মানতে গেলেই লীলাকেও মানতে হয়। অনুলােম ও বিলােম। সাকার-নিরাকার সাক্ষাৎকারের পর এই অবস্থা। সাকার চিন্ময়রূপ, নিরাকার অখণ্ড সচ্চিদানন্দ। 
“তিনিই সব হয়েছেন, —তাই বিজ্ঞানীর এই সংসার মজার কুটি। জ্ঞানীর পক্ষে এ সংসার ধোঁকার টাটি। রামপ্রসাদ ধোঁকার টাটি বলেছেন। তাই একজন জবাব দিয়েছিল, —এই সংসার মজার কুটি, আমি খাই দাই আর মজা লুটি। 
ওরে বদ্যি নাহিক বুদ্ধি, বুঝি কেবল মােটামুটি । 
জনক রাজা মহাতেজা তার কিসের ছিল ত্রুটি। 
সে এদিক-ওদিক দুদিক রেখে খেয়েছিল দুধের বাটি ॥ ( সকলের হাস্য)। 
“বিজ্ঞানী ঈশ্বরের আনন্দ বিশেষরূপে সম্ভোগ করেছে। কেউ দুধ শুনেছে, কেউ দেখেছে, কেউ খেয়েছে। বিজ্ঞানী দুধ খেয়েছে আর খেয়ে আনন্দ লাভ করেছে ও হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে।”

ঠাকুর একটু চুপ করিলেন ও পণ্ডিতকে তামাক খাইতে বলিলেন। পণ্ডিত দক্ষিণ-পূর্বের লম্বা বারান্দায় তামাক খাইতে গেলেন।

১ মুণ্ডকোপনিষদ্‌             [২।২।৮]

==========

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৩০শে জুন

জ্ঞান ও বিজ্ঞান — ঠাকুর ও বেদোক্ত ঋষিগণ

পণ্ডিত ফিরিয়া আসিয়া আবার ভক্তদের সঙ্গে মেঝেতে বসিলেন। ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়া আবার কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (পণ্ডিতের প্রতি) — তোমাকে এইটে বলি। আনন্দ তিন প্রকার — বিষয়ানন্দ, ভজনানন্দ ও ব্রহ্মানন্দ। যা সর্বদাই নিয়ে আছে — কামিনী-কাঞ্চনের আনন্দ — তার নাম বিষয়ানন্দ। ঈশ্বরের নামগুণগান করে যে আনন্দ তার নাম ভজনান্দ। আর ভগবান দর্শনের যে আনন্দ তার নাম ব্রহ্মানন্দ। ব্রহ্মানন্দলাভের পর ঋষিদের স্বেচ্ছাচার হয়ে যেত।

“চৈতন্যদেবের তিনরকম অবস্থা হত — অন্তর্দশা, অর্ধবাহ্যদশা ও বাহ্যদশা। অন্তর্দশায় ভগবানদর্শন করে সমাধিস্থ হতেন, — জড়সমাধির অবস্থা হত। অর্ধবাহ্যে একটু বাহিরের হুঁশ থাকত। বাহ্যদশায় নামগুণকীর্তন করতে পারতেন।”

হাজরা (পণ্ডিতের প্রতি) — এইতো সব সন্দেহ ঘুচান হল।

শ্রীরামকৃষ্ণ (পণ্ডিতের প্রতি) — সমাধি কাকে বলে? — যেখানে মনের লয় হয়। জ্ঞানীর জড়সমাধি হয়, — ‘আমি’ থাকে না। ভক্তিযোগের সমাধিকে চেতনসমাধি বলে। এতে সেব্য-সেবকের ‘আমি’ থাকে — রস-রসিকের ‘আমি’ — আস্বাদ্য-আস্বাদকের ‘আমি’। ঈশ্বর সেব্য — ভক্ত সেবক; ঈশ্বর রসস্বরূপ — ভক্ত রসিক; ঈশ্বর আস্বাদ্য — ভক্ত আস্বাদক। চিনি হব না, চিনি খেতে ভালবাসি।

পণ্ডিত — তিনি যদি সব ‘আমি’ লয় করেন তাহলে কি হবে? চিনি যদি করে লন?

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — তোমার মনের কথা খুলে বল। “মা কৌশল্যা, একবার প্রকাশ করে বল!” (সকলের হাস্য) তবে কি নারদ, সনক, সনাতন, সনন্দ, সনৎকুমার শাস্ত্রে নাই?

পণ্ডিত — আজ্ঞা হাঁ, শাস্ত্রে আছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — প্রার্থনা কর। তিনি দয়াময়। তিনি কি ভক্তের কথা শুনেন না? তিনি কল্পতরু। তাঁর কাছে গিয়ে যে যা চাইবে তাই পাবে।

ণ্ডিত — আমি তত এ-সব চিন্তা করি নাই। এযন সব বুঝছি।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ব্রহ্মজ্ঞানের পরও ঈশ্বর একটু ‘আমি’ রেখে দেন। সেই ‘আমি’ — “ভক্তের আমি” “বিদ্যার আমি।” তা হতে এ অনন্ত লীলা আস্বাদন হয়। মুষল সব ঘষে একটু তাতেই আবার উলুবনে পড়ে কুলনাশন — যদুবংশ ধ্বংস হল। বিজ্ঞানী তাই এই “ভক্তের আমি” “বিদ্যার আমি” রাখে আস্বাদনের জন্য, লোকশিক্ষার জন্য।

[ঋষিরা ভয়তরাসে — A new light on the Vedanta]

“ঋষিরা ভয়তরাসে। তাদের ভাব কি জান? আমি জো-সো করে যাচ্ছি আবার কে আসে? যদি কাঠ আপনি জো-সো করে ভেসে যায় — কিন্তু তার উপর একটি পাখি বসলে ডুবে যায়। নারদাদি বাহাদুরী কাঠ, আপনিও ভেসে যায়, আবার অনেক জীবজন্তুকেও নিয়ে যেতে পারে। স্টীমবোট (কলের জাহাজ) — আপনিও পার হয়ে যায় এবং অপরকে পার করে নিয়ে যায়।

“নারদাদি আচার্য বিজ্ঞানী, — অন্য ঋষিদের চেয়ে সাহসী। যেমন পাকা খেলোয়াড় ছকবাঁধা খেলা খেলতে পারে। কি চাও, ছয় না পাঁচ? ফি বারেই ঠিক পড়ছে! — এমনি খেলোয়াড়! — সে আবার মাঝে মাঝে গোঁপে তা দেয়।

“শুধু জ্ঞানী যারা, তারা ভয়তরাসে। যেমন সতরঞ্চ খেলায় কাঁচা লোকেরা ভাবে, জো-সো করে একবার ঘুঁটি উঠলে হয়। বিজ্ঞানীর কিছুতেই ভয় নাই। সে সাকার-নিরাকার সাক্ষাৎকার করেছে! — ঈশ্বরের আনন্দ সম্ভোগ করেছে!

“তাঁকে চিন্তা করে, অখণ্ডে মন লয়ে হলেও আনন্দ, — আবার মন লয় না হলেও লীলাতে মন রেখেও আনন্দ।

“শুধু জ্ঞানী একঘেয়ে, — কেবল বিচার কচ্চে ‘এ নয় এ নয়, — এ-সব স্বপ্নবৎ।’ আমি দুহাত ছেড়ে দিয়েছি, তাই সব লই।

“একজন ব্যানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। ব্যান তখন সুতা কাটছিল, নানারকমের রেশমের সুতা। ‘ব্যান’ তার ব্যানকে দেখে খুব আনন্দ করতে লাগল; — আর বললে — ‘ব্যান, তুমি এসেছ বলে আমার যে কি আনন্দ হয়েছে, তা বলতে পারি না, — যাই তোমার জন্য কিছু জলখাবার আনিগে।’ ব্যান জলখাবার আনতে গেছে, — এদিকে নানা রঙের রেশমের সুতা দেখে এ-ব্যানের লোভ হয়েছে। সে একতাড়া সুতা বগলে করে লুকিয়ে ফেললে। ব্যান জলখাবার নিয়ে এল; — আর অতি উৎসাহের সহিত — জল খাওয়াতে লাগল। কিন্তু সুতার দিকে দৃষ্টিপাত করে বুঝতে পারলে যে, একতাড়া সুতো ব্যান সরিয়েছেন। তখন সে সুতোটা আদায় করবার একটা ফন্দি ঠাওরালে।

“সে বলছে, ‘ব্যান, অনেকদিনের পর তোমার সহিত সাক্ষাৎ হল। আজ ভারী আনন্দের দিন। আমার ভারী ইচ্ছা কচ্ছে যে দুজনে নৃত্য করি।’ সে বললে — ‘ভাই, আমারও ভারী আনন্দ হয়েছে।’ তখন দুই ব্যানে নৃত্য করতে লাগল। ব্যান দেখলে যে, ইনি বাহু না তুলে নৃত্য করছেন। তখন তিনি বললেন, ‘এস ব্যান দুহাত তুলে আমরা নাচি, — আজ ভারী আনন্দের দিন।’ কিন্তু তিনি একহাতে বগল টিপে আর-একটি হাত তুলে নাচতে লাগলেন! তখন ব্যান বললেন, ‘ব্যান ওকি! একহাত তুলে নাচা কি, এস দুহাত তুলে নাচি। এই দেখ, আমি দুহাত তুলে নাচছি।’ কিন্তু তিনি বগল টিপে হেসে হেসে একহাত তুলেই নাচতে লাগলেন আর বললেন, ‘যে যেমন জানে ব্যান!’

“আমি বগলে হাত দিয়ে টিপি না, — আমি দুহাত ছেড়ে দিয়েছি — আমার ভয় নাই। তাই আমি নিত্য-লীলা দুই লই।”

ঠাকুর কি বলিতেছেন যে জ্ঞানীর লোকমান্য হবার কামনা জ্ঞানীর মুক্তি কামনা — এই সব থাকে বলে দুহাত তুলে নাচতে পারে না? নিত্য-লীলা দুই নিতে পারে না? আর জ্ঞানীর ভয় আছে, বদ্ধ হই, — বিজ্ঞানীর ভয় নাই?

শ্রীরামকৃষ্ণ — কেশব সেনকে বললা যে, ‘আমি’ ত্যাগ না করলে হবে না। সে বললে, তাহলে মহাশয় দলটল থাকে না। তখন আমি বললাম, “কাঁচা আমি,” “বজ্জাত আমি” — ত্যাগ করতে বলছি, কিন্তু “পাকা আমি” — “বালকের আমি”, “ঈশ্বরের দাস আমি”, “বিদ্যার আমি” — এতে দোষ নাই। “সংসারীর আমি” — “অবিদ্যার আমি” — “কাঁচা আমি” — একটা মোটা লাঠির ন্যায়। সচ্চিদানন্দসাগরের জল ওই লাঠি যেন দুই ভাগ করেছে। কিন্তু “ঈশ্বরের দাস আমি,” “বালকের আমি,” “বিদ্যার আমি” জলের উপর রেখার ন্যায়। জল এক, বেশ দেখা যাচ্ছে — শুধু মাঝখানে একটি রেখা, যেন দুভাগ জল। বস্তুতঃ একজল, — দেখা যাচ্ছে।

“শঙ্করাচার্য ‘বিদ্যার আমি’ রেখেছিলেন — লোকশিক্ষার জন্য।”

[ব্রহ্মজ্ঞানলাভের পর “ভক্তের আমি” — গোপীভাব ]

“ব্রহ্মজ্ঞানলাভের পরেও অনেকের ভিতর তিনি ‘বিদ্যার আমি’ — ‘ভক্তের আমি’ রেখে দেন। হনুমান সাকার-নিরাকার সাক্ষাৎকার করবার পর সেব্য-সেবকের ভাবে, ভক্তের ভাবে থাকতেন। রামচন্দ্রকে বলেছিলেন, ‘রাম, কখন ভাবি তুমি পূর্ণ, আমি অংশ; কখন ভাবি তুমি সেব্য, আমি সেবক; আর রাম, যখন তত্ত্বজ্ঞান হয় তখন দেখি তুমিই আমি, আমিই তুমি!’

“যশোদা কৃষ্ণ বিরহে কাতর হয়ে শ্রীমতীর কাছে গেলেন। তাঁর কষ্ট দেখে শ্রীমতী তাঁকে স্বরূপে দেখা দিলেন — আর বললেন, ‘কৃষ্ণ চিদাত্মা আমি চিচ্ছক্তি। মা তুমি আমার কাছে বর লও।’ যশোদা বললেন, মা আমার ব্রহ্মজ্ঞান চাই না — কেবল এই বর দাও যেন ধ্যানে গোপালের রূপ সর্বদা দর্শন হয়, আর কৃষ্ণভক্তসঙ্গ যেন সর্বদা হয়, আর ভক্তদের যেন আমি সেবা করতে পারি, — আর তাঁর নামগুনকীর্তন যেন আমি সর্বদা করতে পারি।

“গোপীদের ইছা হয়েছিল, ভগবানের ঈশ্বরীয় রূপদর্শন করে। কৃষ্ণ তাদের যমুনায় ডুব দিতে বললেন। ডুব দেওয়ায় যা অমনি বৈকুণ্ঠে সব্বাই উপস্থিত; — ভগবানের সেই ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ রূপ দর্শন হল; — কিন্তু ভাল লাগল না। তখন কৃষ্ণকে তারা বললে, আমাদের গোপালকে দর্শন, গোপালের সেবা এই যেন থাকে আর আমারা কিছুই চাই না।

“মথুরা যাবার আগে কৃষ্ণ ব্রহ্মজ্ঞান দিবার উদ্যোগ করেছিলেন। বলেছিলেন, আমি সর্বভূতের অন্তরে বাহিরে আছি। তোমরা কি একটি রূপ কেবল দেখছ? গোপীরা বলে উঠল, ‘কৃষ্ণ, তবে কি আমাদের ত্যাগ করে যাবে তাই ব্রহ্মজ্ঞানের উপদেশ দিচ্ছ?’

“গোপীদের ভাব কি জান? আমরা রাইয়ের, রাই আমাদের।”

একজন ভক্ত — এই “ভক্তের আমি” কি একেবারে যায় না?

[Sri Ramakrishna and the Vedanta]

শ্রীরামকৃষ্ণ — ও ‘আমি’ এক-একবার যায়। তখন ব্রহ্মজ্ঞান হয়ে সমাধিস্থ হয়। আমারও যায়। কিন্তু বরাবর নয়। সা রে গা মা পা ধা নি, — কিন্তু ‘নি’তে অনেকক্ষণ থাকা যায় না, — আবার নিচের গ্রামে নামতে হয়। আমি বলি “মা আমায় ব্রহ্মজ্ঞান দিও না।” আগে সাকারবাদীরা খুব আসত। তারপর ইদানীং ব্রহ্মজ্ঞানীরা আসতে আরম্ভ করলে। তখন প্রায় ওইরূপ বেহুঁশ হয়ে সমাধিস্থ হতাম — আর হুঁশ হলেই বলতাম, মা আমায় ব্রহ্মজ্ঞান দিও না।

পণ্ডিত — আমরা বললে তিনি শুনবেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — ঈশ্বর কল্পতরু। যে যা চাইবে, তাই পাবে। কিন্তু কল্পতরুর কাছে থেকে চাইতে হয়, তবে কথা থাকে।

“তবে একটি কথা আছে — তিনি ভাবগ্রাহী। যে যা মনে করে সাধনা করে তার সেরূপই হয়। যেমন ভাব তেমনি লাভ। একজন বাজিকর খেলা দেখাচ্ছে রাজার সামনে। আর মাঝে মাঝে বলছে রাজা টাকা দেও, কাপড়া দেও। এমন সময়ে তার জিব তালুর মূলের কাছে উলটে গেল। অমনি কুম্ভক হয়ে গেল। আর কথা নাই, শব্দ নাই, স্পন্দন নাই। তখন সকলে তাকে ইটের কবর তৈয়ার করে সেই ভাবেই পুঁতে রাখলে। হাজার বৎসর পরে সেই কবর কে খুঁড়েছিল। তখন লোকে দেখে যে একজন সমাধিস্থ হয়ে বসে আছে! তারা তাকে সাধু মনে করে পূজা করতে লাগল। এমন সময় নাড়াচাড়া দিতে দিতে তার জিব তালু থেকে সরে এল। তখন তার চৈতন্য হল, আর সে চিৎকার করে বলতে লাগল, লাগ ভেলকি লাগ! রাজা টাকা দেও, কাপড়া দেও!

“আমি কাঁদতাম আর বলতাম, মা বিচারবুদ্ধিতে বজ্রাঘাত হোক!”

পণ্ডিত — তবে আপনারও (বিচারবুদ্ধি) ছিল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, একবার ছিল।

পণ্ডিত — তবে বলে দিন, তাহলে আমাদেরও যাবে। আপনার কেমন করে গেল?

শ্রীরামকৃষ্ণ — অমনি একরকম করে গেল।

============

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৩০শে জুন

ঈশ্বরদর্শন জীবনের উদ্দেশ্য — তাহার উপায়

[ঐশ্বর্য ও মাধুর্য — কেহ কেহ ঐশ্বর্যজ্ঞান চায় না ]

ঠাকুর কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া আছেন। আবার কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ঈশ্বর কল্পতরু। তাঁর কাছে থেকে চাইতে হয়। তযন যে যা চায় তাই পায়।

“ঈশ্বর কত কি করেছেন। তাঁর অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড — তাঁর অনন্ত ঐশ্বর্যের জ্ঞান আমার দরকার কি! আর যদি জানতে ইচ্ছা করে, আগে তাঁকে লাভ করতে হয়, তারপর তিনি বলে দেবেন। যদু মল্লিকের কখানা বাড়ি কত কোম্পানির কাগজ আছে এ-সব আমার কি দরকার! আমার দরকার, জো-সো করে বাবুর সঙ্গে আলাপ করা! তা পগার ডিঙিয়েই হোক! — প্রার্থনা করেই হোক! বা দ্বারবানের ধাক্কা খেয়েই হোক — আলাপের পর কত কি আছে একবার জিজ্ঞাসা করলে বাবুই বলে দেয়। আবার বাবুর সঙ্গে আলাপ হলে আমলারাও মানে। (সকলের হাস্য)

“কেউ কেউ ঐশ্বর্যের জ্ঞান চায় না। শুঁড়ির দোকানে কত মন মদ আছে আমার কি দরকার! আমার এক বোতলেতেই হয়ে যায়। ঐশ্বর্য জ্ঞান চাইবে কি। যেটুকু মদ খেয়েছে তাতেই মত্ত!”

[জ্ঞানযোগ বড় কঠিন — অবতারাদি নিত্যসিদ্ধ ]

“ভক্তিযোগ, জ্ঞানযোগ — এ-সবই পথ। যে-পথ দিয়েই যাও তাঁকে পাবে। ভক্তির পথ সহজ পথ। জ্ঞান বিচারের পথ কঠিন পথ।

“কোন্‌ পথটি ভাল অত বিচার করবার কি দরকার। বিজয়ের সঙ্গে অনেকদিন কথা হয়েছিল, বিজয়কে বললাম, একজন প্রার্থনা করত, ‘হে ঈশ্বর! তুমি যে কি, কেমন আছ, আমায় দেখা দাও।’

“জ্ঞানবিচারের পথ কঠিন। পার্বতী গিরিরাজকে নানা ঈশ্বরীয় রূপে দেখা দিয়ে বললেন, ‘পিতা, যদি ব্রহ্মজ্ঞান চাও সাধুসঙ্গ কর।

“ব্রহ্ম কি মুখে বলা যায় না। রামগীতায় আছে, কেবল তটস্থ লক্ষণে তাঁকে বলা যায়, যেমন গঙ্গার উপর ঘোষপল্লী। গঙ্গার তটের উপর আছে এই কথা বলে ঘোষপল্লীকে ব্যক্ত করা যায়।

“নিরাকার ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার হবে না কেন? তবে বড় কঠিন। বিষয় বুদ্ধির লেশ থাকলে হবে না। ইন্দ্রিয়ের বিষয় যত আছে — রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ সমস্ত ত্যাগ হলে — মনের লয় হলে — তবে অনুভবে বোধে বোধ হয় আর অস্তিমাত্র জানা যায়।”

পণ্ডিত — অস্তীত্যোপলব্ধব্য ইত্যাদি।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁকে পেতে গেলে একটা ভাব আশ্রয় করতে হয়, — বীরভাব, সখীভাব বা দাসীভাব আর সন্তানভাব।

মণি মল্লিক — তবে আঁট হবে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি সখীভাবে অনেকদিন ছিলাম। বলতাম, ‘আমি আনন্দময়ী ব্রহ্মময়ীর দাসী, — ওগো দাসীরা আমায় তোমরা দাসী কর, আমি গরব করে চলে যাব, বলতে বলতে যে, আমি সাধন ব্রহ্মময়ীর দাসী!’

“কারু কারু সাধন না করে ঈশ্বরলাভ হয়, — তাদের নিত্যসিদ্ধ বলে। যারা জপতপাদি সাধন করে ঈশ্বরলাভ করেছে তাদের বলে সাধনসিদ্ধ। আবার কেউ কৃপাসিদ্ধ, — যেমন হাজার বছরের অন্ধকার ঘর, প্রদীপ নিয়ে গেলে একক্ষণে আলো হয়ে যায়!

“আবার আছে হঠাৎসিদ্ধ, — যেমন গরিবের ছেলে বড়মানুষের নজরে পড়ে গেছে। বাবু তাকে মেয়ে বিয়ে দিলে, — সেই সঙ্গে বাড়িঘর, গাড়ি, দাস-দাসী সব হয়ে গেল।

“আর আছে স্বপ্নসিদ্ধ — স্বপ্নে দর্শন হল।”

সুরেন্দ্র (সহাস্যে) — আমরা এখন ঘুমুই, — পরে বাবু হয়ে যাব।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সস্নেহে) — তুমি তো বাবু আছই। ‘ক’য়ে আকার দিলে ‘কা’ হয়; — আবার একটা আকার দেওয়া বৃথা; — দিলে সেই ‘কা’ই হবে! (সকলের হাস্য)

“নিত্যসিদ্ধ আলাদা থাক — যেমন অরণি কাষ্ঠ, একটু ঘষলেই আগুন, — আবার না ঘষলেও হয়। একটু সাধন করলেই নিত্যসিদ্ধ ভগবানকে লাভ করে, আবার সাধন না করলেও পায়।

“তবে নিত্যসিদ্ধ ভগবানলাভ করার পর সাধন করে। যেমন আলু-কুমড়ো গাছে আগে ফল হয় তারপর ফুল।”

পণ্ডিত লাউ-কুমড়োর ফল আগে হয় শুনিয়া হাসিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আর নিত্যসিদ্ধ হোমাপাখির ন্যায়। তার মা উচ্চ আকাশে থাকে। প্রসবের পর ছানা পৃথিবির দিকে পড়ে থাকে। পড়তে পড়তে ডানা উঠে ও চোখ ফুটে। কিন্তু মাটি গায়ে আঘাত না লাগতে লাগতে মার দিকে চোঁচা দৌড় দেয়। কোথায় মা! কোথায় মা! দেখ না প্রহ্লাদের ‘ক’ লিখতে চক্ষে ধারা!

ঠাকুর নিত্যসিদ্ধের কথায় অরণি কাঠ ও হোমাপাখির দৃষ্টান্তের দ্বারা কি নিজের অবস্থা বুঝাইতেছেন?

ঠাকুর পণ্ডিতের বিনীতভাব দেখিয়া সন্তুষ্ট হইয়াছেন। পণ্ডিতের স্বভাবের বিষয় ভক্তদের বলিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — এঁর স্বভাবটি বেশ। মাটির দেওয়ালে পেরেক পুঁতলে কোন কষ্ট হয় না। পাথরে পেরেকের গোড়া ভেঙে যায় তবু পাথরের কিছু হয় না। এমন সব লোক আছে হাজার ঈশ্বরকথা শুনুক, কোন মতে চৈতন্য হয় না, — যেমন কুমির — গায়ে তরবারির চোপ লাগে না!

[পাণ্ডিত্য অপেক্ষা সাধনা ভাল — বিবেক ]

পণ্ডিত — কুমিরের পেটে বর্শা মারলে হয়। (সকলের হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — গুচ্ছির শাস্ত্র পড়লে কি হবে? ফ্যালাজফী (Philosophy)! (সকলের হাস্য)

পণ্ডিত (সহাস্য) — ফ্যালাজফী বটে!

শ্রীরামকৃষ্ণ — লম্বা লম্বা কথা বললে কি হবে? বাণশিক্ষা করতে গেলে আগে কলাগাছ তাগ করতে হয়, — তারপর শরগাছ, — তারপর সলতে, — তারপর উড়ে যাচ্ছে যে পাখি।

“তাই আগে সাকারে মনস্থির করতে হয়।

“আবার ত্রিগুণাতীত ভক্ত আছে, — নিত্য ভক্ত যেমন নারদাদি। সে ভক্তিতে চিন্ময় শ্যাম, চিন্ময় ধাম, চিন্ময় সেবক, — নিত্য ঈশ্বর, নিত্য ভক্ত, নিত্য ধাম।

“যারা নেতি নেতি জ্ঞানবিচার করছে, তারা অবতার মানে না। হাজরা বেশ বলে — ভক্তের জন্যই অবতার, — জ্ঞানীর জন্য অবতার নয়, তারা তো সোঽহম্‌ হয়ে বসে আছে।”

ঠাকুর ও ভক্তেরা সকলেই কিয়ৎকাল চুপ করিয়া আছেন। এইবার পণ্ডিত কথা কহিতেছেন।

পণ্ডিত — আজ্ঞে, কিসে নিষ্ঠুর ভাবটা যায়? হাস্য দেখলে মাংসপেশী (muscles), স্নায়ু (nerves) মনে পড়ে। শোক দেখলে কিরকম nervous system মনে পড়ে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — নারাণ শাস্ত্রী তাই বলত, ‘শাস্ত্র পড়ার দোষ, — তর্ক-বিচার এই সব এনে ফেলে!’

পণ্ডিত — আজ্ঞে, উপায় কি কিছু নাই? — একটু মার্দব —

শ্রীরামকৃষ্ণ — আছে — বিবেক। একটা গান আছে, —

‘বিবেক নামে তার বেটার তত্ত্বকথা তায় সুধাবি।’

“বিবেক, বৈরাগ্য, ঈশ্বরে অনুরাগ — এই উপায়। বিবেক না হলে কথা কখন ঠিক ঠিক হয় না। সামাধ্যয়ী অনেক ব্যাখ্যার পর বললে, ‘ঈশ্বর নীরস!’ একজন বলেছিল, ‘আমাদের মামাদের একগোয়াল ঘোড়া আছে।’ গোয়ালে কি ঘোড়া থাকে?

(সহাস্যে) “তুমি ছানাবড়া হয়ে আছ। এখন দু-পাঁচদিন রসে পড়ে থাকলে তোমার পক্ষেও ভাল, পরেরও ভাল। দু-পাঁচদিন।”

পণ্ডিত (ঈষৎ হাসিয়া) — ছানাবড়া পুড়ে অঙ্গার হয়ে গিয়েছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — না, না; আরসুলার রঙ হয়েছে।

হাজরা — বেশ ভাজা হয়েছে, — এখন রস খাবে বেশ।

[পূর্বকথা — তোতাপুরীর উপদেশ — গীতার অর্থ — ব্যাকুল হও ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — কি জান, — শাস্ত্র বেশি পড়বার দরকার নাই। বেশি পড়লে তর্ক বিচার এসে পড়ে। ন্যাংটা আমায় শেখাত — উপদেশ দিত — গীতা দশবার বললে যা হয় তাই গীতার সার! — অর্থাৎ ‘গীতা’ ‘গীতা’ দশবার বলতে বলতে ‘ত্যাগী’ ‘ত্যাগী’ হয়ে যায়।

“উপায় — বিবেক, বৈরাগ্য, আর ঈশ্বরে অনুরাগ। কিরূপ অনুরাগ? ঈশ্বরের জন্য প্রাণ ব্যাকুল, — যেমন ব্যাকুল হয়ে ‘বৎসের পিছে গাভী ধায়’।”

পণ্ডিত — বেদে ঠিক অমনি আছে, গাভী যেমন বৎসের জন্য ডাকে, তোমাকে আমরা তেমনি ডাকছি।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ব্যাকুলতার সঙ্গে কাঁদো। আর বিবেক-বৈরাগ্য এনে যদি কেউ সর্বত্যাগ করতে পারে, — তাহলে সাক্ষাৎকার হবে।

“সে ব্যাকুলতা এলে উন্মাদের অবস্থা হয় — তা জ্ঞানপথেই থাক, আর ভক্তিপথেই থাক। দুর্বাসার জ্ঞানোন্মাদ হয়েছিল।

“সংসারীর জ্ঞান আর সর্বত্যাগীর জ্ঞান — অনেক তফাত। সংসারীর জ্ঞান — দীপের আলোর ন্যায় ঘরের ভিতরটি আলো হয়, — নিজের দেহ ঘরকন্না ছাড়া আর কিছু বুঝতে পারে না। সর্বত্যাগীর জ্ঞান, সূর্যের আলোর ন্যায়। সে আলোতে ঘরের ভিতর বা’র সব দেখা যায়। চৈতন্যদেবের জ্ঞান সৌরজ্ঞান — জ্ঞানসূর্যের আলো! আবার তাঁর ভিতর ভক্তিচন্দ্রের শীতল আলোও ছিল। ব্রহ্মজ্ঞান, ভক্তিপ্রেম, দুইই ছিল।”

ঠাকুর কি চৈতন্যদেবের অবস্থা বর্ণনা করিয়া নিজের অবস্থা বলিতেছেন?

[জ্ঞানযোগ ভক্তিযোগ — কলিতে নারদীয় ভক্তি ]

“অভাবমুখ চৈতন্য আর ভাবমুখ চৈতন্য। ভাব ভক্তি একটি পথ আছে; আর অভাবের একটি আছে। তুমি অভাবের কথা বলছ। কিন্তু ‘সে বড় কঠিন ঠাঁই গুরুশিষ্য দেখা নাই!’ জনকের কাছে শুকদেব ব্রহ্মজ্ঞান উপদেশের জন্য গেলেন। জনক বললেন, ‘আগে দক্ষিণা দিতে হবে, — তোমার ব্রহ্মজ্ঞান হলে আর দক্ষিণা দেবে না — কেননা গুরুশিষ্যে ভেদ থাকে না।’

“ভাব অভাব সবই পথ। অনন্ত মত অনন্ত পথ। কিন্তু একটি কথা আছে। কলিতে নারদীয় ভক্তি — এই বিধান। এ-পথে প্রথমে ভক্তি, ভক্তি পাকলে ভাব, ভাবের চেয়ে উচ্চ মহাভাব আর প্রেম। মহাভাব আর প্রেম জীবের হয় না। যার তা হয়েছে তার বস্তুলাভ অর্থাৎ ঈশ্বরলাভ হয়েছে।”

পণ্ডিত — আজ্ঞে, বলতে গেলে তো অনেক কথা দিয়ে বুঝাতে হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি নেজামুড়া বাদ দিয়ে বলবে হে।

============

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৩০শে জুন

কালীব্রহ্ম, ব্রহ্মশক্তি অভেদ — সর্বধর্ম-সমন্বয়

শ্রীযুক্ত মণি মল্লিকের সঙ্গে পণ্ডিত কথা কহিতেছেন। মণি মল্লিক ব্রাহ্মসমাজের লোক। পণ্ডিত ব্রাহ্মসমাজের দোষগুন লইয়া ঘোর তর্ক করিতেছেন। ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়া দেখিতেছেন ও হাস্য করিতেছেন। মাঝে মাঝে বলিতেছেন, “এই সত্ত্বের তমঃ — বীরের ভাব। এ-সব চাই। অন্যায় অসত্য দেখলে চুপ করে থাকতে নাই। মনে কর, নষ্ট স্ত্রী পরমার্থ হানি করতে আসছে, তখন এই বীরের ভাব ধরতে হয়। তখন বলবে, কি শ্যালি! আমার পরমার্থ হানি করবি! — এক্ষণি তোর শরীর চিরে দিব।”

আবার হাসিয়া বলিতেছেন, “মণি মল্লিকের ব্রাহ্মসমাজের মত অনেকদিনের — ওর ভিতর তোমার মত ঢোকাতে পারবে না। পুরানো সংস্কার কি এমনি যায়? একজন হিন্দু বড় ভক্ত ছিল, — সর্বদা জগদম্বার পূজা আর নাম করত। মুসলমানদের যখন রাজ্য হল তখন সেই ভক্তকে ধরে মুসলমান করে দিল, আর বললে, তুই এখন মুসলমান হয়েছিস, বল আল্লা! কেবল আল্লা নাম জপ কর। সে অনেক কষ্টে আল্লা, আল্লা বলতে লাগল। কিন্তু এক-একবার বলে ফেলতে লাগল ‘জগদম্বা!’ তখন মুসলমানেরা তাকে মারতে যায়। সে বলে, দোহাই শেখজী! আমায় মারবেন না, আমি তোমাদের আল্লা নাম করতে খুব চেষ্টা করছি, কিন্তু আমাদের জগদম্বা আমার কণ্ঠা পর্যন্ত রয়েছেন, তোমাদের আল্লাকে ঠেলে ঠেলে দিচ্ছেন। (সকলের হাস্য)

(পণ্ডিতের প্রতি, সহাস্যে) — “মণি মল্লিককে কিছু বলো না।

“কি জানো, রুচিভেদ, আর যার যা পেটে সয়। তিনি নানা ধর্ম নানা মত করেছেন — অধীকারী বিশেষের জন্য। সকলে ব্রহ্মজ্ঞানের অধীকারী নয়, তাই আবার তিনি সাকারপূজার ব্যবস্থা করেছেন। মা ছেলেদের জন্য বাড়িতে মাছ এনেছে। সেই মাছে ঝোল, অম্বল, ভাজা আবার পোলাও করলেন। সকলের পেটে কিন্তু পোলাও সয় না; তাই কারু কারু জন্য মাছের ঝোল করেছেন, — তারা পেট রোগা। আবার কারু সাধ অম্বল খায়, বা মাছ ভাজা খায়। প্রকৃতি আলাদা — আবার অধিকারী ভেদ।”

সকলে চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর পণ্ডিতকে বলিতেছেন, “যাও একবার ঠাকুর দর্শন করে এসো, — আবার বাগানে একটু বেড়াও।”

বেলা সাড়ে পাঁচটা বাজিয়াছে। পণ্ডিত ও তাঁহার বন্ধুরা গাত্রোত্থান করিলেন; ঠাকুরবাড়ি দেখিবেন। ভক্তেরাও কেহ কেহ তাঁহাদের সঙ্গে গেলেন।

কিয়ৎক্ষণ পরে মাস্টার সমভিব্যাহারে বেড়াইতে বেড়াইতে ঠাকুরও গঙ্গাতীরে বাঁধাঘাটের দিকে যাইতেছেন। ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন, “বাবুরাম এখন বলে — পড়েশুনে কি হবে।“

গঙ্গাতীরে পণ্ডিতের সহিত ঠাকুরের আবার দেখা হইল। ঠাকুর বলিতেছেন, “কালীঘরে যাবে না? — তাই এলুম।” পণ্ডিত ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “আজ্ঞে, চলুন দর্শন করি গিয়ে।”

ঠাকুর সহাস্যবদন। চাঁদনির ভিতর দিয়া কালীঘরের দিকে যাইতে যাইতে বলিতেছেন, “একটা গানে আছে।” এই বলিয়া মধুর সুর করিয়া গাহিতেছেন:

“মা কি আমার কালো রে!
কালোরূপ দিগম্বরী হৃদিপদ্ম করে আলো রে!”

চাঁদনি হইতে প্রাঙ্গণে আসিয়া আবার বলিতেছেন, একটা গানে আছে, — ‘জ্ঞানাগ্নি জ্বেলে ঘরে, ব্রহ্মময়ীর রূপ দেখ না’!

মন্দিরে আসিয়া ঠাকুর ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। মার শ্রীপাদপদ্মে জবা, বিল্ব; ত্রিনয়নী ভক্তদের কতই স্নেহ চক্ষে দেখিতেছেন। হস্তে বরাভয়। মা বারাণসী চেলী ও বিবিধ অলঙ্কার পরিয়াছেন।

শ্রীমূর্তি দর্শন করিয়া ভূধরের দাদা বলিতেছেন, “শুনেছি নবীন ভাস্করের নির্মাণ।” ঠাকুর বলিতেছেন, “তা জানি না — জানি ইনি চিন্ময়ী!”

ভক্তসঙ্গে ঠাকুর নাটমন্দিরে বেড়াইতে বেড়াইতে দক্ষিণাস্য হইয়া আসিতেছেন! বলিদানের স্থান দেখিয়া পণ্ডিত বলিতেছেন, “মা পাঁঠা কাটা দেখতে পান না।” (সকলের হাস্য)
==========

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৩০শে জুন

ঠাকুর এইবার ফিরিতেছেন। বাবুরামকে বলিলেন, আরে আয়! মাস্টারও সঙ্গে আসিলেন।

সন্ধ্যা হইয়াছে। ঘরের পশ্চিমের গোল বারান্দায় আসিয়া ঠাকুর বসিয়াছেন। ভাবস্থ, — অর্ধবাহ্য। কাছে বাবুরাম ও মাস্টার।

আলকাল ঠাকুরের সেবার কষ্ট হইয়াছে। রাখাল আজকাল থাকেন না। কেহ কেহ আছেন, কিন্তু তাঁহারা ঠাকুরের সকল অবস্থাতে ছুঁতে পারেন না। ঠাকুর সঙ্কেত করে বাবুরামকে বলিতেছেন — “হ — ছু — না, রা — ছু” এ-অবস্থায় আর কাকেও ছুঁতে দিতে পারি না, তুই থাক তাহলে ভাল হয়।”

[ঈশ্বরলাভ ও কর্মত্যাগ — নূতন হাঁড়ি — গৃহীভক্ত ও নষ্টা স্ত্রী ]

পণ্ডিত ঠাকুবাড়ি দর্শন করিয়া ঠাকুরের ঘরে ফিরিয়াছেন। ঠাকুর পশ্চিমের গোল বারান্দা হইতে বলিতেছেন, তুমি একটু জল খাও। পণ্ডিত বললেন, আমি সন্ধ্যা করি নাই। অমনি ঠাকুর ভাবে মাতোয়ারা হইয়া গান গাহিতেছেন, — ও দাঁড়াইয়া পড়িলেন —

গয়াগঙ্গা প্রভাসাদি, কাশী কাঞ্চী কেবা চায়।
কালী কালী বলে আমার অজপা যদি ফুরায়।।
ত্রিসন্ধ্যা যে বলে কালী, পূজা সন্ধ্যা সে কি চায়।
সন্ধ্যা তার সন্ধ্যানে ফেরে কভু সন্ধি নাহি পায়।।
পূজা হোম জপ যজ্ঞ আর কিছু না মনে লয়।
মদনেরই যাগযজ্ঞ ব্রহ্মময়ীর রাঙা পায়।।

ঠাকুর প্রেমোন্মত্ত হইয়া আবার বলিতেছেন, কতদিন সন্ধ্যা? যতদিন ওঁ বলতে মন লীন না হয়।

পণ্ডিত — তবে জল খাই, তারপর সন্ধ্যা করব।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি তোমার স্রোতে বাধা দিব না। সময় না হলে ত্যাগ ভাল না। ফল পাকলে ফুল আপনি ঝরে। কাঁচা বেলায় নারিকেলের বেল্লো টানাটানি করতে নাই, — এরকম করে ভাঙলে গাছ খারাপ হয়।

সুরেন্দ্র বাড়ি যাইবার উদ্যোগ করিতেছেন। বন্ধুবর্গকে আহ্বান করিতেছেন। তাঁহার গাড়িতে লইয়া যাইবেন।

সুরেন্দ্র — মহেন্দ্রবাবু যাবেন?

ঠাকুর এখনও ভাবস্থ, সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ হন নাই। তিনি সেই অবস্থাতেই সুরেন্দ্রকে বলিতেছেন, তোমার ঘোড়া যত বইতে পারে, তার বেশি নিয়ো না। সুরেন্দ্র প্রণাম করিয়া চলিয়া গেলেন।

পণ্ডিত সন্ধ্যা করিতে গেলেন। মাস্টার ও বাবুরাম কলিকাতায় যাইবেন, ঠাকুরকে প্রণাম করিতেছেন। ঠাকুর এখনও ভাবস্থ।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — কথা বেরুচ্ছে না, একটু থাকো।

মাস্টার বসিলেন — ঠাকুর কি আজ্ঞা করিবেন — অপেক্ষা করিতেছেন। ঠাকুর বাবুরামকে সঙ্কেত করিয়া বসিতে বলিলেন। বাবুরাম বলিলেন, আর একটু বসুন। ঠাকুর বলিতেছেন, একটু বাতাস কর। বাবুরাম বাতাস করিতেছেন, মাস্টারও করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে সস্নেহে) — এখন আর তত এস না কেন?

মাস্টার — আজ্ঞা, বিশেষ কিছু কারণ নাই, বাড়ীতে কাজ ছিল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — বাবুরাম কি ঘর, কাল টের পেয়েছি। তাই তো এখন ওকে রাখবার জন্য অত বলছি। পাখি সময় বুঝে ডিম ফুটোয়। কি জানো এরা শুদ্ধ আত্মা, এখনও কামিনী-কাঞ্চনের ভিতর গিয়ে পড়ে নাই। কি বল?

মাস্টার — আজ্ঞা, হাঁ। এখনও কোন দাগ লাগে নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ — নূতন হাঁড়ি, দুধ রাখলে খারাপ হবে না।

মাস্টার — আজ্ঞা হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — বাবুরামের এখানে থাকবার দরকার পড়েছে। অবস্থা আছে কিনা, তাতে ওইসব লোকের থাকা প্রয়োজন। ও বলেছে, ক্রমে ক্রমে থাকব, না হলে হাঙ্গামা হবে — বাড়িতে গোল করবে। আমি বলছি শনিবার, রবিবার আসবে।

এদিকে পণ্ডিত সন্ধ্যা করিয়া আসিয়াছেন। তাঁহার সঙ্গে ভূধর ও তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভাই১পণ্ডিত এইবার জল খাইবেন।

ভূধরের বড়ভাই বলিতেছেন, “আমাদের কি হবে; — একটু বলে দিন আমাদের উপায় কি?”

শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমরা মুমুক্ষু, ব্যাকুলতা থাকলেই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। শ্রাদ্ধের অন্ন খেও না। সংসারে নষ্ট স্ত্রীর মতো থাকবে। নষ্ট স্ত্রী বাড়ির সব কাজ যেন খুব মন দিয়ে করে, কিন্তু তার মন উপপতির উপর রাতদিন পড়ে থাকে। সংসারের কাজ করো, কিন্তু মন সর্বদা ঈশ্বরের উপর রাখবে।

পণ্ডিত জল খাইতেছেন। ঠাকুর বলিতেছেন, আসনে বসে খাও।

খাবার পর পণ্ডিতকে বলিতেছেন — “তুমি তো গীতা পড়েছ, — যাকে সকলে গণে মানে, তাতে ঈশ্বরের বিশেষ শক্তি আছে।”

পণ্ডিত — যদ্‌ যদ্‌ বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিতমেব বা —

শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার ভিতর অবশ্য তাঁর শক্তি আছে।

পণ্ডিত — আজ্ঞা, যে ব্রত নিয়েছি অধ্যবসায়ের সহিত করব কি?

ঠাকুর যেন উপরোধে পড়ে বলছেন, “হাঁ হবে।” তারপরেই অন্য কথার দ্বারা ও-কথা যেন চাপা দিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — শক্তি মানতে হয়। বিদ্যাসাগর বললেন, তিনি কি কারুকে বেশি শক্তি দিয়েছেন? আমি বললাম, তবে একজন লোক একশ জনকে মারতে পারে কেন? কুইন ভিক্টোরিয়ার এত মান, নাম কেন — যদি শক্তি না থাকত? আমি বললাম, তুমি মানো কি না? তখন বলে, ‘হাঁ মানি।’

পণ্ডিত বিদায় লইয়া গাত্রোত্থান করিলেন ও ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। সঙ্গের বন্ধুরাও প্রণাম করিলেন।

ঠাকুর বলিতেছেন, “আবার আসবেন, গাঁজাখোর গাঁজাখোরকে দেখলে আহ্লাদ করে — হয়তো তার সঙ্গে কোলাকুলি করে — অন্য লোক দেখলে মুখ লুকোয়। গরু আপনার জনকে দেখলে গা চাটে, অপরকে গুঁতোয়।” (সকলের হাস্য)

পণ্ডিত চলিয়া গেলে ঠাকুর হাসিয়া বলিতেছেন — ডাইলিউট হয়ে গেছে একদিনেই! — দেখলে কেমন বিনয়ী — আর সব কথা লয়!

আষাঢ় শুক্লা সপ্তমী তিথি। পশ্চিমের বারান্দায় চাঁদের আলো পড়িয়াছে। ঠাকুর সেখানে এখনও বসিয়া আছেন। মাস্টার প্রণাম করিতেছেন। ঠাকুর সস্নেহে বলিতেছেন, “যাবে?”

মাস্টার — আজ্ঞা, তবে আসি।

শ্রীরামকৃষ্ণ — একদিন মনে করেছি, সব্বায়ের বাড়ি এক-একবার করে যাব, — তোমার ওখানে একবার যাব, — কেমন?

মাস্টার — আজ্ঞা, বেশ তো।

১ ভূধরের বড়দাদা শেষজীবন একাকী অতি পবিত্রভাবে ৺কাশীধামে কাটাইয়াছিলেন। ঠাকুরকে সর্বদা চিন্তা করিতেন।

=============

Post a Comment

0 Comments