শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত - প্রথম ভাগ ~ অষ্টাদশ খণ্ড

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
প্রথম ভাগ 

অষ্টাদশ খণ্ড  
শ্রীরামকৃষ্ণ,নরেন্দ্র, গিরিশ ঘোষ,ডাক্তার সরকার প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে কথোপকথন ও আনন্দ

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত - প্রথম ভাগ ~ অষ্টাদশ খণ্ড

============

প্রথম পরিচ্ছেদ

ভজনানন্দে — সমাধিমন্দিরে

২৭শে অক্টোবর, ১৮৮৫, মঙ্গলবার, বেলা সাড়ে পাঁচটা। আজ নরেন্দ্র, ডাক্তার সরকার, শ্যাম বসু, গিরিশ, ডাক্তার দোকড়ি, ছোট নরেন্দ্র, রাখাল, মাস্টার ইত্যাদি অনেকে উপস্থিত। ডাক্তার আসিয়া হাত দেখিলেন ও ঔষধের ব্যবস্থা করিলেন।

পীড়াসম্বন্ধীয় কথার পর শ্রীরামকৃষ্ণের ঔষধ সেবনের পর ডাক্তার বলিলেন, ‘তবে শ্যামবাবুর সঙ্গে তুমি কথা কও, আমি আসি।’

শ্রীরামকৃষ্ণ ও একজন ভক্ত বলিয়া উঠিলেন, ‘গান শুনবেন?”

ডাক্তার — তুমি যে তিড়িং মিড়িং করে ওঠো। ভাব চেপে রাখতে হবে।

ডাক্তার আবার বসিলেন। তখন নরেন্দ্র মধুরকণ্ঠে গান করিতেছেন। তৎসঙ্গে তানপুরা ও মৃদঙ্গ ঘন ঘন বাজিতেছে। গাহিতেছেন:

(১) চমৎকার অপার জগৎ রচনা তোমার,
শোভার আগার বিশ্ব সংসার।
অযুত তারকা চমকে রতন-কাঞ্চন-হার
কত চন্দ্র কত সূর্য নাহি অন্ত তার।
শোভে বসুন্ধরা ধনধান্যময়, হায় পূর্ণ তোমার ভাণ্ডার
হে মহেশ, অগণনলোক গায় ধন্য ধন্য এ গীতি অনিবার।

(২) নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে ও রূপরাশি।
তাই যোগী ধ্যান ধরে হয়ে গিরি-গুহাবাসী।
অনন্ত আঁধার কোলে, মহানির্বাণ হিল্লোলে,
চিরশান্তি পরিমল, অবিরল যায় ভাসি।
মহাকাল রূপ ধরি, আঁধার বসন পরি,
সমাধিমন্দিরে ও মা কে তুমি গো একা বসি;
অভয়-পদ-কমলে, প্রেমের বিজলী জ্বলে
চিন্ময় মুখমণ্ডলে শোভে অট্ট অট্ট হাসি।

ডাক্তার মাস্টারকে বলিলেন, “It is dangerous to him!”

(এ-গান ঠাকুরের পক্ষে ভাল নয়, ভাব হইলে অনর্থ ঘটিতে পারে)।

শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বলছে?” তিনি উত্তর করিলেন, “ডাক্তার ভয় করছেন, পাছে আপনার ভাবসমাধি হয়।” বলিতে বলিতে শ্রীরামকৃষ্ণ একটু ভাবস্থ হইয়াছেন; ডাক্তারের মুখপানে তাকাইয়া করজোড়ে বলিতেছেন, “না, না, কেন ভাব হবে?” কিন্তু বলিতে বলিতে তিনি গভীর ভাব-সমাধিতে মগ্ন হইলেন। শরীর স্পন্দহীন, নয়ন স্থির! অবাক্‌! কাষ্ঠপুত্তলিকার ন্যায় উপবিষ্ট! বাহ্যশূন্য! মন বুদ্ধি অহংকার চিত্ত সমস্তই অন্তর্মুখ। আর সে মানুষ নয়। নরেন্দ্রের মধুরকণ্ঠে মধুর গান চলিতেছে:

এ কি এ সুন্দর শোভা, কি মুখ হেরি এ!
আজি মোর ঘরে আইল হৃদয়নাথ, প্রেম উৎস উথলিল আজি —
বল হে প্রেমময় হৃদয়ের স্বামী, কি ধন তোমারে দিব উপহার?
হৃদয় প্রাণ লহ লহ তুমি, কি বলিব;
যাহা কিছু আছে মম, সকলি লও হে নাথ।

গান – কি সুখ জীবনে মম ওহে নাথ দয়াময় হে
যদি চরণ-সরোজে পরাণ-মধুপ চিরমগন না রয় হে।
অগণন ধনরাশি তায় কিবা ফলোদয় হে
যদি লভিয়ে সে ধনে, পরম রতনে যতন না করয় হে।
সুকুমার কুমার মুখ দেখিতে না চাই হে
যদি সে চাঁদবয়ানে তব প্রেমমুখে দেখিতে না পাই হে।
কি ছার শশাঙ্কজ্যোতিঃ, দেখি আঁধারময় হে;
যদি সে চাঁদ প্রকাশে তব প্রেম চাঁদ নাহি হয় উদয় হে।
সতীর পবিত্র প্রেম তাও মলিনতাময় হে,
যদি সে প্রেমকনকে, তব প্রেমমণি নাহি জড়িত রয় হে।
তীক্ষ্ণ বিষা ব্যালী সম সতত দংশয় হে,
যদি মোহ পরমাদে নাথ তোমাতে ঘটায় সংশয় হে।
কি আর বলিব নাথ, বলিব তোমায় হে;
তুমি আমার হৃদয়রতন মণি, আনন্দনিলয় হে।

“সতির পবিত্র প্রেম” গানের এই অংশ শুনিতে শুনিতে ডাক্তার অশ্রুপূর্ণলোচনে বলিয়া উঠিলেন, আহা! আহা!

নরেন্দ্র গাহিলেন:

কতদিনে হবে সে প্রেম সঞ্চার।
হয়ে পূর্ণকাম বলব হরিনাম, নয়নে বহিবে প্রেম অশ্রুধার।।
কবে হবে আমার শুদ্ধ প্রাণমন, কবে যাব আমি প্রেমের বৃন্দাবন,
সংসার বন্ধন হইবে মোচন, জ্ঞানাঞ্জনে যাবে লোচন আঁধার।।
কবে পরশমণি করি পরশন লৌহময় দেহ হইবে কাঞ্চন
হরিময় বিশ্ব করিব দর্শন, লুটিব ভক্তিপথে অনিবার।।
(হায়) কবে যাবে আমার ধরম করম, কবে যাবে জাতি কুলের ভরম,
কবে যাবে ভয় ভাবনা সরম, পরিহরি অভিমান লোকাচার।।
মাখি সর্ব অঙ্গে ভক্তপদধূলি, কাঁধে লয়ে চির বৈরাগ্যের ঝুলি,
পিব প্রেমবারি দুই হাতে তুলি, অঞ্জলি অঞ্জলি প্রেমযমুনার।।
প্রেমে পাগল হয়ে হাসিব কাঁদিব সচ্চিদানন্দ সাগরে ভাসিব,
আপনি মাতিয়ে সকলে মাতাব, হরিপদে নিত্য করিব বিহার।

==========

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

জ্ঞান ও বিজ্ঞান বিচারে — ব্রহ্মদর্শন

ইতিমধ্যে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বাহ্যসংজ্ঞালাভ করিয়াছেন। গান সমাপ্ত হইল। তখন পণ্ডিত ও মূর্খের — বালক ও বৃদ্ধের — পুরুষ ও স্ত্রীর — আপামর সাধারণের — সেই মনোমুগ্ধকরী কথা হইতে লাগিল। সভাসুদ্ধ লোক নিস্তব্ধ। সকলেই সেই মুখপানে চাহিয়া রহিয়াছেন। এখন সেই কঠিন পীড়া কোথায়? মুখ এখনও যেন প্রফুল্ল অরবিন্দ, — যেন ঐশ্বরিক জ্যোতিঃ বহির্গত হইতেছে। তখন তিনি ডাক্তারকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, “লজ্জা ত্যাগ কর, ঈশ্বরের নাম করবে, তাতে আবার লজ্জা কি? লজ্জা, ঘৃণা, ভয় — তিন থাকতে নয়। ‘আমি এত বড় লোক, আমি ‘হরি হরি’ বলে নাচব? বড় বড় লোক এ-কথা শুনলে আমায় কি বলবে? যদি বলে, ওহে ডাক্তারটা ‘হরি হরি’ বলে নেচেছে। লজ্জার কথা!’ এ-সব ভাব ত্যাগ কর।”

ডাক্তার — আমার ওদিক দিয়েই যাওয়া নাই; লোকে কি বলবে, আমি তার তোয়াক্কা রাখি না।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার উটি খুব আছে। (সকলের হাস্য)

“দেখ, জ্ঞান-অজ্ঞানের পার হও, তবে তাঁকে জানতে পারা যায়। নানা জ্ঞানের নাম অজ্ঞান। পাণ্ডিত্যের অহংকারও অজ্ঞান। এক ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন, এই নিশ্চয় বুদ্ধির নাম জ্ঞান। তাঁকে বিশেষরূপে জানার নাম বিজ্ঞান। যেমন পায়ে কাঁটা বিঁধেছে, সে কাঁটাটা তোলবার জন্য আর-একটি কাঁটার প্রয়োজন। কাঁটাটা তোলবার পর দুটি কাঁটাই ফেলে দেয়। প্রথমে অজ্ঞান কাঁটা দূর করবার জন্য জ্ঞান কাঁটাটি আনতে হয়। তারপর জ্ঞান-অজ্ঞান দুইটিই ফেলে দিতে হয়। তিনি যে জ্ঞান-অজ্ঞানের পার। লক্ষ্মণ বলেছিলেন, ‘রাম! এ কি আশ্চর্য! এত বড় জ্ঞানী স্বয়ং বশিষ্ঠদেব পুত্রশোকে অধীর হয়ে কেঁদেছিলেন।’ রাম বললেন, ‘ভাই, যার জ্ঞান আছে, তার অজ্ঞানও আছে, যার এক জ্ঞান আছে, তার অনেক জ্ঞানও আছে। যার আলোবোধ আছে, তার অন্ধকারবোধও আছে। ব্রহ্ম — জ্ঞান-অজ্ঞানের পার, পাপ-পুণ্যের পার, ধর্মাধর্মের পার, শুচি-শুচির পার।”

এই বলিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ রামপ্রসাদের গান আবৃত্তি করিয়া বলিতেছেন —

আয় মন বেড়াতে যাবি।
কালীকল্পতরুমূলে রে চারিফল কুড়ায়ে পাবি।।

[অবাঙ্‌মনসোগোচরম্‌ — ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝান যায় না ]

শ্যাম বসু — দুই কাঁটা ফেলে দেওয়ার পর কি থাকবে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — নিত্যশুদ্ধবোধরূপম্‌। তা তোমায় কেমন করে বুঝাব? যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, ‘ঘি কেমন খেলে?’ তাকে এখন কি করে বুঝাবে? হদ্দ বলতে পার, ‘কেমন ঘি না যেমন ঘি।’ একটি মেয়েকে তার সঙ্গী জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তোর স্বামী এসেছে, আচ্ছা ভাই, স্বামী এলে কিরূপ আনন্দ হয়?’ মেয়েটি বললে, ‘ভাই, তোর স্বামী হলে তুই জানবি; এখন তোরে কেমন করে বুঝাব।’ পুরাণে আছে ভগবতী যখন হিমালয়ের ঘরে জন্মালেন, তখন তাঁকে নানারূপে দর্শন দিলেন। গিরিরাজ সব রূপ দর্শন করে শেষে ভগবতীকে বললেন, মা, বেদে যে ব্রহ্মের কথা আছে, এইবার আমার যেন ব্রহ্মদর্শন হয়। তখন ভগবতী বললেন, বাবা, ব্রহ্মদর্শন যদি করতে চাও, তবে সাধুসঙ্গ কর।

“ব্রহ্ম কি জিনিস — মুখে বলা যায় না। একজন বলেছিল — সব উচ্ছিষ্ট হয়েছে, কেবল ব্রহ্ম উচ্ছিষ্ট হন নাই। এর মানে এই যে, বেদ, পুরাণ, তন্ত্র, আর সব শাস্ত্র, মুখে উচ্চারণ হওয়াতে উচ্ছিষ্ট হয়েছে বলা যেতে পারে; কিন্তু ব্রহ্ম কি বস্তু, কেউ এ-পর্যন্ত মুখে বলতে পারে নাই। তাই ব্রহ্ম এ পর্যন্ত উচ্ছিষ্ট হন নাই! আর সচ্চিদানন্দের সঙ্গে ক্রীড়া, রমণ — যে কি আনন্দের তা মুখে বলা যায় না। যার হয়েছে সে জানে।”

==========

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

পণ্ডিতের অহংকার — পাপ ও পুণ্য

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আবার ডাক্তারকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “দেখ, অহংকার না গেলে জ্ঞান হয় না। ‘মুক্ত হব কবে, “আমি” যাবে যবে’। ‘আমি’ ও ‘আমার’ এই দুইটি অজ্ঞান। ‘তুমি’ ও ‘তোমার’ এই দুইটি জ্ঞান। যে ঠিক ভক্ত, সে বলে — হে ঈশ্বর! তুমিই কর্তা, তুমিই সব করছো, আমি কেবল যন্ত্র, আমাকে যেমন করাও তেমনি করি। আর এ-সব তোমার ধন, তোমার ঐশ্বর্য, তোমার জগৎ। তোমারই গৃহ পরিজন, আমার কিছু নয়। আমি দাস। তোমার যেমন হুকুম, সেইরূপ সেবা করবার আমার অধিকার।

“যারা একটু বই-টই পড়েছে, অমনি তাদের অহংকার এসে জোটে। কা-ঠাকুরের সঙ্গে ঈশ্বরীয় কথা হয়েছিল। সে বলে, ‘ও-সব আমি জানি।’ আমি বললুম, যে দিল্লী গিছিল, সে কি বলে বেড়ায় আমি দিল্লী গেছি, আর জাঁক করে? যে বাবু, সে কি বলে আমি বাবু!”

শ্যাম বসু — তিনি (কা-ঠাকুর) আপনাকে খুব মানেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ওগো বলব কি! দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে একটি মেথরাণীর যে অহংকার! তার গায়ে ২/১ খানা গহনা ছিল। সে যে পথ দিয়ে আসছিল, সেই পথে দু-একজন লোক তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। মেথরাণী তাদের বলে উঠল। ‘এই! সরে যা’ তা অন্য লোকের অহংকারের কথা আর কি বলব?

শ্যাম বসু — মহাশয়! পাপের শাস্তি আছে অথচ ঈশ্বর সব করছেন, এ কিরকম কথা?

শ্রীরামকৃষ্ণ — কি, তোমার সোনার বেনে বুদ্ধি!

নরেন্দ্র — সোনার বেনে বুদ্ধি অর্থাৎ calculating বুদ্ধি!

শ্রীরামকৃষ্ণ — ওরে পোদো, তুই আম খেয়ে নে! বাগানে কত শত গাছ আছে, কত হাজার ডাল আছে, কত কোটি পাতা আছে, এ-সব হিসাবে তোর কাজ কি? তুই আম খেতে এসেছিল, আম খেয়ে যা। (শ্যাম বসুর প্রতি) তুমি এ সংসারে ঈশ্বর সাধন জন্য মানব জন্ম পেয়েছ। ঈশ্বরের পাদপদ্মে কিরূপে ভক্তি হয়, তাই চেষ্টা কর। তোমার এত শত কাজ কি? ফিলজফী লয়ে বিচার করে তোমার কি হবে? দেখ, আধপো মদে তুমি মাতাল হতে পার। শুঁড়ির দোকানে কত মন মদ আছে, এ হিসাবে তোমার কি দরকার?

ডাক্তার — আর ঈশ্বরের মদ Infinite! সে মদের শেষ নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ (শ্যাম বসুর প্রতি) — আর ঈশ্বরকে আমমোক্তারী দাও না। তাঁর উপর সব ভার দাও। সৎ লোককে যদি কেউ ভার দেয়, তিনি কি অন্যায় করেন? পাপের শাস্তি দিবেন, কি না দিবেন, সে তিনি বুঝবেন।

ডাক্তার — তাঁর মনে কি আছে, তিনিই জানেন। মানুষ হিসাব করে কি বলবে? তিনি হিসাবের পার!

শ্রীরামকৃষ্ণ (শ্যাম বসুর প্রতি) — তোমাদের ওই এক। কলকাতার লোকগুলো বলে, ‘ঈশ্বরের বৈষম্যদোষ।’ কেননা, তিনি একজনকে সুখে রেখেছেন, আর-একজনকে দুঃখে রেখেছেন। শালাদের নিজের ভিতরও যেমন, ঈশ্বরের ভিতরও তেমনি দেখে।

[‘লোকমান্য’ কি জীবনের উদ্দেশ্য? ]

“হেম দক্ষিণেশ্বরে যেত। দেখা হলেই আমায় বলত, ‘কেমন ভট্টাচার্য মশাই! জগতে এক বস্তু আছে; — মান? ঈশ্বরলাভ যে মানুষ জীবনের উদ্দেশ্য, তা কম লোকই বলে্রিতী

==========

চতুর্থ পরিচ্ছেদ


স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ ও মহাকারণ

শ্যাম বসু — সূক্ষ্মশরীর কেউ কি দেখিয়ে দিতে পারে? কেউ কি দেখাতে পারে যে সেই শরীর বাহিরে চলে যায়?

শ্রীরামকৃষ্ণ — যারা ঠিক ভক্ত, তাদের দায় পড়েছে তোমায় দেখাতে! কোন্‌ শালা মানবে আর না মনবে, তাদের দায় কি! একটা বড়লোক হাতে থাকবে, এ-সব ইচ্ছা তাদের থাকে না।

শ্যাম বসু — আচ্ছা, স্থূলদেহ, সূক্ষ্মদেহ, এ-সব প্রভেদ কি?

শ্রীরামকৃষ্ণ — পঞ্চভূত লয়ে যে দেহ, সেইটি স্থূলদেহ। মন, বুদ্ধি, অহংকার আর চিত্ত, এই লয়ে সূক্ষ্মশরীর। যে শরীরে ভগবানের আনন্দলাভ হয়, আর সম্ভোগ হয়, সেইটি কারণ শরীর। তন্ত্রে বলে, ‘ভগবতী তনু।’ সকলের অতীত ‘মহাকারণ’ (তুরীয়) মুখে বলা যায় না।

[সাধনের প্রয়োজন — ঈশ্বরে একমাত্র ভক্তিই সার ]

“কেবল শুনলে কি হবে? কিছু করো।

“সিদ্ধি সিদ্ধি মুখে বললে কি হবে? তাতে কি নেশা হয়?

“সিদ্ধি বেটে গায়ে মাখলেও নেশা হয় না। কিছু খেতে হয়। কোন্‌টা একচল্লিশ নম্বরের সুতো, কোন্‌টা চল্লিশ নম্বরের — সুতার ব্যবসা না করলে এ-সব কি বলা যায়? যাদের সুতার ব্যবসা আছে, তাদের পক্ষে অমুক নম্বরের সুতা দেওয়া কিছু শক্ত নয়! তাই বলি, কিছু সাধন কর। তখন স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ মহাকারণ কাকে বলে সব বুঝতে পারবে। যখন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবে, তাঁর পাদপদ্মে একমাত্র ভক্তি প্রার্থনা করবে।

“অহল্যার শাপ মোচনের পর শ্রীরামচন্দ্র তাঁকে বললেন, তুমি আমার কাছে বর লও। অহল্যা বললেন, রাম যদি বর দিবে তবে এই বর দাও — আমার যদি শূকরযোনিতেও জন্ম হয় তাতেও ক্ষতি নাই; কিন্তু হে রাম! যেন তোমার পাদপদ্মে আমার মন থাকে।

“আমি মার কাছে একমাত্র ভক্তি চেয়েছিলাম। মার পাদপদ্মে ফুল দিয়ে হাতজোড় করে বলেছিলাম, ‘মা, এই লও তোমার অজ্ঞান, এই লও তোমার জ্ঞান, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার শুচি, এই লও তোমার অশুচি, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার পাপ, এই লও তোমার পুণ্য, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার ভাল, এই লও তোমার মন্দ, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার ধর্ম, এই লও তোমার অধর্ম, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও।’

“ধর্ম কিনা দানাদি কর্ম। ধর্ম নিলেই অধর্ম লতে হবে। পুণ্য নিলেই পাপ লতে হবে। জ্ঞান নিলেই অজ্ঞান লতে হবে। শুচি নিলেই অশুচি লতে হবে। যেমন যার আলোবোধ আছে, তার অন্ধকাবোধও আছে। যার একবোধ আছে, তার অনেকবোধও আছে। যার ভালবোধ আছে তার মন্দবোধও আছে।

“যদি কারও শূকর মাংস খেয়ে ঈশ্বরের পাদপদ্মে ভক্তি তাকে, সে পুরুষ ধন্য; আর হবিষ্য খেয়ে যদি সংসারে আসক্তি থাকে –”

ডাক্তার — তবে সে অধম! এখানে একটি কথা বলি — বুদ্ধ শূকর মাংস খেয়েছিল। শূকর মাংস খাওয়া আর কলিক্‌ (পেটে শূলবেদনা) হওয়া। এ ব্যারামের জন্য বুদ্ধ Opium (আফিং) খেত। নির্বাণ-টির্বাণ কি জান? আফিং খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকত, বাহ্যজ্ঞান থাকত না; — তাই নির্বাণ!

বুদ্ধদেবের নির্বাণ সম্বন্ধে এই ব্যাখ্যা শুনিয়া সকলে হাসিতে লাগিলেন; আবার কথাবার্তা চলিতে লাগিল।

============

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

গৃহস্থ ও নিষ্কাম কর্ম — Theosophy

শ্রীরামকৃষ্ণ (শ্যাম বসুর প্রতি) — সংসারধর্ম; তাতে দোষ নাই। কিন্তু ঈশ্বরের পাদপদ্মে মন রেখে, কামনাশূন্য হয়ে কাজকর্ম করবে। এই দেখ না, যদি কারু পিঠে একটা ফোঁড়া হয়, সে যেমন সকলের সঙ্গে কথাবার্তা কয়, হয়তো কাজকর্মও করে, কিন্তু যেমন ফোঁড়ার দিকে তার মন পড়ে থাকে, সেইরূপ।

“সংসারে নষ্ট মেয়ের মতো থাকবে। মন উপপতির দিকে, কিন্তু সে সংসারের সব কাজ করে। (ডাক্তারের প্রতি) বুঝেছ?”

ডাক্তার — ও-ভাব যদি না থাকে, বুঝব কেমন করে?

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) — আর ওই ব্যাবসা অনেকদিন ধরে করছেন! কি বল? (সকলের হাস্য)

শ্যাম বসু — মহাশয়, থিয়সফি কিরকম বলেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — মোট কথা এই, যারা শিষ্য করে বেড়ায়, তারা হালকা থাকের লোক। আর যারা সিদ্ধাই অর্থাৎ নানারকম শক্তি চায়, তারাও হালকা থাক। যেমন গঙ্গা হেঁটে পার হয় যাব, এই শক্তি। অন্য দেশে একজন কি কথা বলছে তাই বলতে পারা, এই এক শক্তি। ঈশ্বরে শুদ্ধাভক্তি হওয়া এই সব লোকের ভারী কঠিন।

শ্যাম বসু — কিন্তু তারা (থিয়সফিস্ট্‌রা) হিন্দুধর্ম পুনঃস্থাপিত করবার চেষ্টা করছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি তাদের বিষয় ভাল জানি না।

শ্যাম বসু — মরবার পর জীবাত্মা কোথায় যায় — চন্দ্রলোকে, নক্ষত্রলোকে ইত্যাদি — এ-সব থিয়সফিতে জানা যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তা হবে আমার ভাব কিরকম জানো? হনুমানকে একজন জিজ্ঞাসা করেছিল, আজ কি তিথি? হনুমান বললে, ‘আমি বার, তিথি, নক্ষত্র এ-সব কিছু জানি না; কেবল এক রামচিন্তা করি।’ আমার ঠিক ওই ভাব।

শ্যাম বসু — তারা বলে, মহাত্মা সব আছেন। আপনার কি বিশ্বাস?

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমার কথা বিশ্বাস করেন তো আছে। এ-সব কথা এখন থাক। আমার অসুখটা কমলে তুমি আসবে। যাতে তোমার শান্তি হয়, যদি আমায় বিশ্বাস কর — উপায় হয়ে যাবে। দেখছো তো, আমি টাকা লই না, কাপড় লই না। এখানে প্যালা দিতে হয় না, তাই অনেকে আসে! (সকলের হাস্য)

(ডাক্তারের প্রতি) — “তোমাকে এই বলা, রাগ করো না; ও-সব তো অনেক করলে — টাকা, মান, লেকচার; — এখন মনটা দিনকতক ঈশ্বরেতে দাও; আর এখানে মাঝে মাঝে আসবে, ঈশ্বরের কথা শুনলে উদ্দীপন হবে!”

কিয়ৎকাল পরে ডাক্তার বিদায় লইতে গাত্রোত্থান করিলেন। এমন সময় শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র ঘোষ আসিলেন ও ঠাকুরের চরণধূলি লইয়া উপবিষ্ট হইলেন। ডাক্তার তাঁহাকে দেখিয়া আনন্দিত হইলেন ও আবার আসন গ্রহণ করিলেন।

ডাক্তার — আমি থাকতে উনি (গিরিশবাবু) আসবেন না! যাই চলে যাব যাব হয়েছি অমনি এসে উপস্থিত। (সকলের হাস্য)

গিরিশের সঙ্গে ডাক্তারের বিজ্ঞানসভার (Science Association) কথা হইতে লাগিল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমায় একদিন সেখানে লয়ে যাবে?

ডাক্তার — তুমি সেখানে গেলে অজ্ঞান হয়ে যাবে — ঈশ্বরের আশ্চর্য কাণ্ড সব দেখে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — বটে?

============

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

গুরু পূজা

ডাক্তার (গিরিশের প্রতি) — আর সব কর — but do not worship him as God (ঈশ্বর বলে পূজা করো না।) এমন ভাল লোকটার মাথা খাচ্ছ?

গিরিশ — কি করি মহাশয়? যিনি এ সংসার-সমুদ্র ও সন্দেহ সাগর থেকে পার করলেন, তাঁকে আর কি করব বলুন। তাঁর গু কি গু বোধ হয়?

ডাক্তার — গুর জন্য হচ্ছে না। আমারও ঘৃণা নাই! একটা দোকানীর ছেলে এসেছিল, তা বাহ্যে করে ফেললে! সকলে নাকে কাপড় দিলে! আমি তার কাছে আধঘণ্টা বসে! নাকে কাপড় দিই নাই। আর মেথর যতক্ষণ মাথায় করে নিয়ে যায়, ততক্ষণ আমার নাকে কাপড় দেবার জো নাই। আমি জানি সেও যা, আমিও তা, কেন তাকে ঘৃণা করব? আমি কি এঁর পায়ের ধুলা নিতে পারি না? — এই দেখ নিচ্ছি। (শ্রীরামকৃষ্ণের পদধূলি গ্রহণ।)

গিরিশ — Angels (দেবগণ) এই মুহূর্তে ধন্য ধন্য করছেন।

ডাক্তার — তা পায়ের ধুলা লওয়া কি আশ্চর্য! আমি যে সকলেরই নিতে পারি! — এই দাও! এই দাও! (সকলের পায়ের ধুলা গ্রহণ।)

নরেন্দ্র (ডাক্তারের প্রতি) — এঁকে আমরা ঈশ্বরের মতো মনে করি। কিরকম জানেন? যেমন ভেজিটেবল্‌ ক্রিয়েসন্‌ (উদ্ভিদ) ও অ্যানিম্যাল ক্রিয়েসন্‌ (জীবজন্তুগণ)। এদের মাঝামাঝি এমন একটি পয়েন্ট্‌ স্থান আছে, যেখানে এটা উদ্ভিদ কি প্রাণী, স্থির করা ভারী কঠিন। সেইরূপ Man-world (নরলোক) ও God-world (দেবলোক) এই দুয়ের মধ্যে একটি স্থান আছে, যেখানে বলা কঠিন, এ ব্যক্তি মানুষ, না ঈশ্বর।

ডাক্তার — ওহে, ঈশ্বরের কথায় উপমা চলে না।

নরেনদ্র — আমি God (ঈশ্বর) বলছি না, God like man (ঈশ্বর তুল্য ব্যক্তি) বলছি।

ডাক্তার — ও-সব নিজের নিজের ভাব চাপতে হয়। প্রকাশ করা ভাল নয়। আমার ভাব কেউ বুঝলে না। My best friends (যারা আমার পরম বন্ধু) আমায় কঠোর নির্দয় মনে করে। এই তোমরা হয়তো আমায় জুতো মেরে তাড়াবে!

শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি) — সেকি! — এরা তোমায় কত ভালবাসে! তুমি আসবে বলে বাসকসজ্জা করে জেগে থাকে।

গিরিশ — Everyone has the greatest respect for you. (সকলেই আপনাকে যৎপরোনাস্তি শ্রদ্ধা করে।)

ডাক্তার — আমার ছেলে — আমার স্ত্রী পর্যন্ত — আমায় মনে করে hard-hearted (স্নেহমমতা শূন্য), — কেননা, আমার দোষ এই যে, আমি ভাব কারু কাছে প্রকাশ করি না।

গিরিশ — তবে মহাশয়! আপনার মনের কবাট খোলা তো ভাল — at least out of pity for your friends (বন্ধুদের প্রতি অন্ততঃ কৃপা করে) — এই মনে করে যে, তারা আপনাকে বুঝতে পারছে না।

ডাক্তার — বলব কি হে! তোমাদের চেয়েও আমার feelings worked-up হয় (অর্থাৎ আমার ভাব হয়)। (নরেনেদ্রর প্রতি) I shed tears in solitude (আমি একলা একলা বসে কাঁদি।)

[মহাপুরুষ ও জীবের পাপ গ্রহণ — অবতারাদি ও নরেন্দ্র]

ডাক্তার (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — ভাল, তুমি ভাব হলে লোকের গায়ে পা দাও, সেটা ভাল নয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি কি জানতে পারি গা, কারু গায়ে পা দিচ্ছি কিনা!

ডাক্তার — ওটা ভাল নয় — এটুকু তো বোধ হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমার ভাবাবস্থায় আমার কি হয় তা তোমায় কি বলব? সে অবস্থার পর এমন ভাবি, বুঝি রোগ হচ্ছে ওই জন্য! ঈশ্বরের ভাবে আমার উন্মাদ হয়। উন্মাদে এরূপ হয়, কি করব?

ডাক্তার — ইনি মেনেছেন। He expresses regret for what he does; কাজটা sinful (অন্যায়) এটি বোধ আছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি) — তুই তো খুব শঠ (বুদ্ধিমান), তুই বল না; একে বুঝিয়ে দে না।

গিরিশ (ডাক্তারের প্রতি) — মহাশয়! আপনি ভুল বুঝেছেন। উনি সে জন্য দুঃখিত হননি। এঁর দেহ শুদ্ধ — অপাপবিদ্ধ। ইনি জীবের মঙ্গলের জন্য তাদের স্পর্শ করেন। তাদের পাপ গ্রহণ করে এঁর রোগ হবার খুব সম্ভাবনা, তাই কখনও কখনও ভাবেন। আপনার যখন কলিক (শূলবেদনা) হয়েছিল তখন আপনার কি রিগ্রেট (দুঃখ) হয় নাই, কেন রাত জেগে এত পড়তুম? তা বলে রাত জেগে পড়াটা কি অন্যায় কাজ? রোগের জন্য রিগ্রেট (দুঃখ-কষ্ট) হতে পারে। তা বলে জীবের মঙ্গলসাধনের স্পর্শ করাকে অন্যায় কাজ মনে করবেন না।

ডাক্তার (অপ্রতিভ হইয়া, গিরিশের প্রতি) — (তোমার কাছে হেরে গেলুম, দাও পায়ের ধুলা দাও। (গিরিশের পদধূলি গ্রহণ)। (নরেন্দ্রের প্রতি) — আর কিছু নয় হে, his intellectual power (গিরিশের বুদ্ধিমত্তা) মানতে হবে।

নরেন্দ্র (ডাক্তারের প্রতি) — আর-এককথা দেখুন। একটা Scientific discovery (জড় বিজ্ঞানের সত্য বাহির) করবার জন্য আপনি life devote (জীবন উৎসর্গ) করতে পারেন — শরীর, অসুখ ইত্যাদি কিছুই মানেন না। আর ঈশ্বরকে জানা grandest of all sciences (শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান)-এর জন্য ইনি health risk (শরীর নষ্ট হয় হউক, এরূপ মনের ভাব) করবেন না?

ডাক্তার — যত religious reformer (ধর্মাচার্য) হয়েছে, Jesus (যীশু), চৈতন্য, বুদ্ধ, মহম্মদ শেষে সব অহংকারে পরিপূর্ণ — বলে, ‘আমি যা বললুম, তাই ঠিক!’ এ কি কথা!

গিরিশ (ডাক্তারের প্রতি) — মহাশয়, সে দোষ আপনারও হচ্ছে! আপনি একলা তাদের সকলের অহংকার আছে, এ দোষ ধরাতে ঠিক সেই দোষ আপনারও হচ্ছে।

ডাক্তার নীরব হইলেন।

নরেন্দ্র (ডাক্তারের প্রতি) — We offer to him Worship bordering on Divine Worship (এঁকে আমরা পূজা করি — সে পূজা ঈশ্বরের পূজার প্রায় কাছাকাছি) —

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আনন্দে বালকের ন্যায় হাসিতেছেন।

============

Post a Comment

0 Comments