শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত - প্রথম ভাগ ~ দ্বাদশ খণ্ড

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
প্রথম ভাগ 

দ্বাদশ খণ্ড 
সিঁথির ব্রাহ্মসমাজ পুনর্বার দর্শন ও বিজয়কৃষ্ণ প্রভৃতি ব্রাহ্মভক্তদিগকে উপদেশ ও তাঁহাদের সহিত আনন্দ

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত - প্রথম ভাগ ~ দ্বাদশ খণ্ড

===========

প্রথম পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিমন্দিরে

আবার ব্রাহ্মভক্তেরা মিলিত হইলেন। কালীপূজার পর দিন, কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদতিথি, ১৯শে অক্টোবর, ১৮৮৪ (৪ঠা কার্তিক রবিবার)। এবার শরতের মহোৎসব। শ্রীযুক্তবেণীমাধব পালের মনোহর উদ্যানবাটীতে আবার ব্রাহ্মসমাজের অধিবেশন হইল। প্রাতঃকালেরউপাসনাদি হইয়া গিয়াছে। শ্রীশ্রীপরমহংসদেব বেলা সাড়ে চারিটায় আসিয়া পৌঁছিলেন। তাঁহারগাড়ি বাগানের মধ্যে দাঁড়াইল। অমনি দলে দলে ভক্ত মণ্ডলাকারে তাঁহাকে ঘেরিতে লাগিলেন।প্রথম প্রকোষ্ঠ মধ্যে সমাজের বেদী রচনা হইয়াছে। সম্মুখে দালান। সেই দালানে ঠাকুর উপবেশনকরিলেন। অমনি ভক্তগণ চারিধারে তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া বসিলেন। বিজয়, ত্রৈলোক্য ওঅনেকগুলি ব্রাহ্মভাক্ত উপস্থিত। তন্মধ্যে ব্রাহ্মসমাজভুক্ত একজন সদরওয়ালাও (সাব-জজ)আছেন।

সমাজগৃহ মহোৎসব উপলক্ষে বিচিত্র শোভা ধারণ করিয়াছে। কোথাও নানা বর্ণের পতাকা;মধ্যে মধ্যে হর্ম্যোপরি বা বাতায়নপথে ময়নরঞ্জন, সুন্দর পাদপ-বিভ্রমকারী বৃক্ষপল্লব। সম্মুখেপূর্বপরিচিত সেই সরোবরের স্বচ্ছসলিল মধ্যে শরতের সুনীল নভোমণ্ডল প্রতিভাসিত হইতেছে।উদ্যানস্থিত রাঙ্গা রাঙ্গা পথগুলির দুই পার্শ্বে সেই পূর্বপরিচিত ফল পুষ্পের বৃক্ষশ্রেণী। আজঠাকুরের শ্রীমুখ-নিঃসৃত সেই বেদধ্বনি ভক্তেরা আবার শুনিতে পাইবেন — যে ধ্বনি আর্যঋষিদেরমুখ হইতে বেদাকারে এককালে বহির্গত হইয়াছিল — যে ধ্বনি আর-একবার নবরূপধারীপরমসন্ন্যাসী, ব্রহ্মগতপ্রাণ, জীবের দুঃখে কাতর, ভক্তবৎসল, ভক্তাবতার হরিপ্রেমবিহ্বল, ঈশারমুখে তাঁহার দ্বাদশ শিষ্য সেই নিরক্ষর মৎসজীবিগণ শুনিয়াছিলেন, যে ধ্বনি পুণ্যক্ষেত্রে ভগবানশ্রীকৃষ্ণের মুখ হইতে শ্রীমদ্ভগব্দগীতাকারে এককালে বহির্গত হইয়াছিল — সারথিবিশেশধারীমানবাকার সচ্চিদানন্দগুরু প্রমুখাৎ যে মেঘগম্ভীরধ্বনিমধ্যে বিনয়নম্র ব্যাকুল “গুড়াকেশকৌন্তেয়”ঞ্চঞ্চ এই কথামৃত পান করিয়াছিলেন যথা —

কবিং পুরাণমনুশাসিতারমণোরণীয়াংসমনুসমরেদ্‌ যঃ।
সর্বস্য ধাতারমচিন্ত্যরূপম্‌, আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।।
প্রয়াণকালে মনসাচলেন, ভক্ত্যা যুক্তো যোগবলেন চৈব।
ভ্রুবোর্মধ্যে প্রাণমাবেশ্য সম্যক্‌, স তং পরং পুরুষমুপৈতি দিব্যম্‌।।
যদক্ষরং বেদবিদো বদন্তি, বিশন্তি যদ্‌ যতয়ো বীতরাগাঃ।
যদিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্যং চরন্তি, তৎ তে পদং সংগ্রহেণ প্রবক্ষ্যে।।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আসন গ্রহণ করিয়া সমাজের সুন্দররচিত বেদীর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াইঅমনি নতশির হইয়া প্রণাম করিলেন। বেদী হইতে শ্রীভগবানের কথা হয় — তাই তিনিদেখিতেছেন যে, বেদীক্ষেত্র পুণ্যক্ষেত্র। দেখিতেছেন এখানে অচ্যুতের কথা হয়, তাই সর্বতীর্থেরসমাগম হইয়াছে। আদালতগৃহ দেখিলে যেমন মোকদ্দমা মনে পড়ে ও জজ মনে পড়ে, সেইরূপএই হরিকথার স্থান দেখিয়া তাঁহার ভগবানের উদ্দীপন হইয়াছে।

শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্য গান গাহিতেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ কহিলেন, হ্যাঁগা, ওই গানটি তোমার বেশ“দে মা পাগল করেঞ্চঞ্চ, ওইটি গাও না।

তিনি গাহিতেছেন:

আমায় দে মা পাগল করে (ব্রহ্মময়ী)।

গান শুনিতে শুনিতে শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবান্তর হইল। একেবারে সমাধিস্থ — ‘উপেক্ষিয়ামহত্তত্ত্ব, ত্যজি চতুর্বিংশ তত্ত্ব, সর্বতত্ত্বাতীত তত্ত্ব দেখি আপনি আপনে।’ কর্মেন্দ্রিয়, জ্ঞানেন্দ্রিয়,মন, বুদ্ধি অহংকার সমস্তই যেন পুঁছিয়া গিয়াছে। দেহমাত্র চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় বিদ্যমান। একদিনভগবান পাণ্ডবনাথের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া যুধিষ্ঠির প্রমুখ শ্রীকৃষ্ণগতান্তরাত্মা পাণ্ডবগণকাঁদিয়াছিলেন। তখন আর্যকুলগৌরব ভীষ্মদেব শরশয্যায় শায়িত থাকিয়া অন্তিমকালে ভগবানেরধ্যাননিরত ছিলেন। তখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সবে সমাপ্ত হইয়াছে। সহজেই কাঁদিবার দিন।শ্রীকৃষ্ণের এই সমাধিপ্রাপ্ত অবস্থা বুঝিতে না পারিয়া পাণ্ডবেরা কাঁদিয়াছিলেন; ভাবিয়াছিলেন, তিনিবুঝি দেহত্যাগ করিলেন।

===========

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

হরিকথা প্রসঙ্গে — ব্রাহ্মসমাজে নিরাকারবাদ

কিয়ৎক্ষণ বিলম্বে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া ভাবাবস্থায় ব্রাহ্মভক্তদের উপদেশ দিতেছেন। এই ঈশ্বরীয় ভাব খুব ঘণীভূত; যেন বক্তা মাতাল হইয়া কি বলিতেছেন। ভাব ক্রমে ক্রমে কমিয়া আসিতেছে, অবশেষে পূর্বের ঠিক সহজাবস্থা

[“আমি সিদ্ধি খাব” — গীতা ও অষ্টসিদ্ধি — ঈশ্বরলাভ কি? ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভাবস্থ) — মা, কারণানন্দ চাই না। সিদ্ধি খাব।

“সিদ্ধি কিনা বস্তুলাভ। ‘অষ্টসিদ্ধি’র সিদ্ধি নয়। সে (অণিমা লঘিমাদি) সিদ্ধির কথা কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, ‘ভাই, দেখ যদি দেখ যে, অষ্টসিদ্ধির একটি সিদ্ধি কারও আছে, তাহলে জেনো যে, সে ব্যক্তি আমাকে পাবে না। কেননা, সিদ্ধি থাকলেই অহংকার থাকবে, আর অহংকারের লেশ থাকলে ভগবানকে পাওয়া যায় না।

“আর-এক আছে প্রবর্তক, সাধক, সিদ্ধ, সিদ্ধের সিদ্ধ। যে ব্যক্তি সবে ঈশ্বরের আরাধনায় প্রবৃত্ত হয়েছে, সে প্রবর্তকের থাক। প্রবর্তক ফোঁটা কাটে, তিলক মালা পরে, বাহিরে খুব আচার করে। সাধক আরও এগিয়ে গেছে; তার লোক-দেখানো ভাব কমে যায়। সাধক ঈশ্বরকে পাবার জন্য ব্যকুল হয়, আন্তরিক তাঁকে ডাকে, তাঁর নাম করে, তাঁকে সরল অন্তঃকরণে প্রার্থনা করে। সিদ্ধ কে? যার নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি হয়েছে যে ঈশ্বর আছেন, আর তিনিই সব করছেন; যিনি ঈশ্বরকে দর্শন করেছেন। ‘সিদ্ধের সিদ্ধ’ কে? যিনি তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছেন! শুধু দর্শন নয়, কেউ পিতৃভাবে, কেউ বাৎসল্যভাবে, কেউ সখ্যভাবে, কেউ মধুরভাবে — তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছেন।

“কাঠে আগুন নিশ্চিত আছে, এই বিশ্বাস; আর কাঠ থেকে আগুন বার করে ভাত রেঁধে, খেয়ে শান্তি আর তৃপ্তি লাভ করা; দুটি ভিন্ন জিনিস।

“ঈশ্বরীয় অবস্থার ইতি করা যায় না। তারে বাড়া তারে বাড়া আছে।”

[বিষয়ীর ঈশ্বর — ব্যাকুলতা ও ঈশ্বরলাভ — দৃঢ় হও ]

(ভাবস্থ) — “এরা ব্রহ্মজ্ঞানী, নিরাকারবাদী। তা বেশ।

(ব্রাহ্মভক্তদের প্রতি) — “একটাতে দৃঢ় হও, হয় সাকারে নয় নিরাকারে। তবে ঈশ্বরলাভ হয়, নচেৎ হয় না। দৃঢ় হলে সাকারবাদীও ঈশ্বরলাভ করবে, নিরাকারবাদীও করবে। মিছরির রুটি সিধে করে খাও, আর আড় করে খাও, মিষ্ট লাগবে। (সকলের হাস্য)

“কিন্তু দৃঢ় হতে হবে; ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকতে হবে। বিষয়ীর ঈশ্বর কিরূপ জানো? যেমন খুড়ী-জেঠীর কোঁদল শুনে ছেলেরা খেলা করবার সময় পরস্পর বলে, ‘আমার ঈশ্বরের দিব্য।’ আর যেমন কোন ফিটবাবু, পান চিবুতে চিবুতে হাতে স্টিক ধরে বাগানে বেড়াতে বেড়াতে একটি ফুল তুলে বন্ধুকে বলে, — ঈশ্বর কি বিউটিফুল ফুল করেছেন। কিন্তু এই বিষয়ীর ভাব ক্ষণিক, যেন তপ্ত লোহার উপর জলের ছিটে।

“একটার উপর দৃঢ় হতে হবে। ডুব দাও। না দিলে সমুদ্রের ভিতর রত্ন পাওয়া যায় না। জলের উপর কেবল বাসলে পাওয়া যায় না।”

এই বলিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, যে-গানে কেশবাদি ভক্তদের মন মুগ্ধ করিতেন, সেই গান — সেই মধুর কণ্ঠে — গাইতেছেন; সকলের বোধ হইতেছে, যেন স্বর্গধামে বা বৈকুণ্ঠে বসিয়া আছেন:

ডুব্‌ ডুব্‌ ডুব্‌ রূপসাগরে আমার মন।
তলাতল পাতাল খুঁজলে পাবি রে প্রেম রত্নধন ৷৷

============

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

ব্রাহ্মভক্তসঙ্গে — ব্রাহ্মসমাজ ও ঈশ্বরের ঐশ্বর্য বর্ণনা

শ্রীরামকৃষ্ণ — ডুব দাও। ঈশ্বরকে ভালবাসতে শেখ। তাঁর প্রেমে মগ্ন হও। দেখ, তোমাদের উপাসনা শুনেছি। কিন্তু তোমাদের ব্রাহ্মসমাজে ঈশ্বরের ঐশ্বর্য অত বর্ণনা কর কেন? “হে ঈশ্বর, তুমি আকাশ করিয়াছ; বড় বড় সমুদ্র করিয়াছ, চন্দ্রলোক, সূর্যলোক, নক্ষত্রলোক, সব করিয়াছ” — এ-সব কথায় আমাদের অত কাজ কি?

“সব লোক বাবুর বাগান দেখে অবাক্‌ — কেমন গাছ, কেমন ফুল, কেমন ঝিল। কেমন বৈঠকখানা, কেমন তার ভিতর ছবি — এই সব দেখেই অবাক্‌। কিন্তু কই, বাগানের মালিক যে বাবু তাঁকে খোঁজে ক’জন? বাবুকে খোঁজে দু-একজনা। ঈশ্বরকে ব্যাকুল হয়ে খুঁজলে তাঁকে দর্শন হয়, তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়, কথা হয়; যেমন, আমি তোমাদের সঙ্গে কথা কচ্ছি। সত্য বলছি দর্শন হয়!

“এ-কথা কারেই বা বলছি — কে বা বিশ্বাস করে।”

[শাস্ত্র না প্রত্যক্ষ — The Law of Revelation]

“শাস্ত্রের ভিতর কি ঈশ্বরকে পাওয়া যায়? শাস্ত্র পড়ে হদ্দ অস্তিমাত্র বোধ হয়। কিন্তু নিজে ডুব না দিলে ঈশ্বর দেখা দেন না। ডুব দেবার পর তিনি নিজে জানিয়ে দিলে তবে সন্দেহ দূর হয়। বই হাজার পড়, মুখে হাজার শ্লোক বল, ব্যাকুল হয়ে তাঁতে ডুব না দিলে তাঁকে ধরতে পারবে না। শুধু পাণ্ডিত্যে মানুষকে ভোলাতে পারবে, কিন্তু তাঁকে পারবে না।

“শাস্ত্র, বই শুধু এ-সব তাতে কি হবে? তাঁর কৃপা না হলে কিছু হবে না; যাতে তাঁর কৃপা হয়, ব্যাকুল হয়ে তার চেষ্টা করো; কৃপা হলে তাঁর দর্শন হবে। তিনি তোমাদের সঙ্গে কথা কইবেন।”

[ব্রাহ্মসমাজ ও সাম্য — ঈশ্বরের বৈষম্যদোষ ]

সদরওয়ালা — মহাশয়, তাঁর কৃপা কি একজনের উপর বেশি আর-একজনের উপর কম? তাহলে যে ঈশ্বরের বৈষম্যদোষ হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — সে কি! ঘোড়াটাও টা আর সরাটাও টা! তুমি যা বলছ ঈশ্বর বিদ্যাসাগর ওই কথা বলেছিল। বলেছিল, মহাশয়, তিনি কি কারুকে বেশি শক্তি দিয়েছেন, কারুকে কম শক্তি দিয়েছেন? আমি বললাম, বিভুরূপে তিনি সকলের ভিতর আছেন — আমার ভিতরে যেমনি পিঁপড়েটির ভিতরেও তেমনি। কিন্তু শক্তিবিশেষ আছে। যদি সকলেই সমান হবে, তবে ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নাম শুনে তোমায় আমরা কেন দেখতে এসেছি। তোমার কি দুটো শিং বেরিয়েছে! তা নয়, তুমি দয়ালু, তুমি পণ্ডিত — এই সব গুণ তোমার অপরের চেয়ে বেশি আছে, তাই তোমার এত নাম। দেখ না এমন লোক আছে যে, একলা একশো লোককে হারাতে পারে; আবার এমন আছে, একজনের ভয় পালায়।

“যদি শক্তিবিশেষ না হয় লোকে কেশবকে এত মানতো কেন?

গীতায় আছে, যাকে অনেকে গণে-মানে — তা বিদ্যার জন্যই হউক, বা গান-বাজনার জন্যই হউক, বা লেকচার দেবার জন্যই হউক, বা আর কিছুর জন্যই হউক — নিশ্চিত জেনো যে, তাতে ঈশ্বরের বিশেষ শক্তি আছে।”

ব্রাহ্মভক্ত (সদরওয়ালার প্রতি) — যা বলছেন মেনে নেন না!

শ্রীরামকৃষ্ণ (ব্রাহ্মভক্তের প্রতি) –তুমি কিরকম লোক! কথায় বিশ্বাস না করে শুধু মেনে লওয়া! কপটতা! তুমি ঢঙ কাচ দেখছি!

ব্রাহ্মভক্তটি অতিশয় লজ্জিত হইলেন।

============

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

ব্রাহ্মসমাজ — কেশব ও নির্লিপ্ত সংসার — সংসারত্যাগ

[পূর্বকথা — কেশবকে শিক্ষা — নির্জনে সাধন — জ্ঞানের লক্ষণ ]

সদরওয়ালা — মহাশয়, সংসার কি ত্যাগ করতে হবে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — না, তোমাদের ত্যাগ কেন করতে হবে? সংসারে থেকেই হতে পারে। তবে আগে দিন কতক নির্জনে থাকতে হয়। নির্জনে থেকে ঈশ্বরের সাধনা করতে হয়। বাড়ির কাছে এমনি একটি আড্ডা করতে হয়, যেখান থেকে বাড়িতে এসে অমনি করে একবার ভাত খেয়ে যেতে পার। কেশব সেন, প্রতাপ, এরা সব বলেছিল, মহাশয়, আমাদের জনক রাজার মত। আমি বললুম, জনক রাজা অমনি মুখে বললেই হওয়া যায় না। জনক রাজা হেঁটমুণ্ড হয়ে আগে নির্জনে বসে কত তপস্যা করেছিল! তোমরা কিছু কর, তবে তো ‘জনক রাজা’ হবে। অমুক খুব তর তর করে ইংরাজী লিখতে পারে, তা কি একেবারে লিখতে পেরেছিল? সে গরিবের ছেলে, আগে একজনের বাড়িতে থেকে তাদের রেঁধে দিত, আর দুটি দুটি খেত, অনেক কষ্টে লেখাপড়া শিখেছিল, তাই এখন তর তর করে লিখতে পারে।

“কেশব সেনকে আরও বলেছিলুম, নির্জনে না গেলে, শক্ত রোগ সারবে কেমন করে? রোগটি হচ্ছে বিকার। আবার যে-ঘরে বিকারী রোগী, সেই ঘরেই আচার, তেঁতুল আর জলের জালা! তা রোগ সারবে কেমন করে? আচার, তেঁতুল — এই দেখো, বলতে বলতে আমার মুখে জল এসেছে। (সকলের হাস্য) সম্মুখে থাকলে কি হয়, সকলেই তো জানো? মেয়েমানুষ পুরুষের পক্ষে এই আচার তেঁতুল। ভোগবাসনা — জলের জালা; বিষয়-তৃষ্ণার শেষ নাই, আর এই বিষয় রোগীর ঘরে! এতি কি বিকাররোগ সারে? দিন কতক ঠাইনাড়া হয়ে থাকতে হয়, যেখানে আচার-তেঁতুল নাই, জলের জালা নাই। তারপর নীরোগ হয়ে আবার সেই ঘরে এলে আর ভয় নাই। তাঁকে লাভ করে সংসারে এসে থাকলে, আর কামিনী-কাঞ্চনে কিছু করতে পারে না। তখন জনকের মতো নির্লিপ্ত হতে পারবে। কিন্তু প্রথমাবস্থায় সাবধান হওয়া চাই। খুব নির্জনে থেকে সাধন করা চাই। অশ্বত্থগাছ যখন চারা থাকে, তখন চারিদিকে বেড়া দেয়, পাছে ছাগল-গরুতে নষ্ট করে। কিন্তু গুঁড়ি মোটা হলে আর বেড়ার দরকার থাকে না। হাতি বেঁধে দিলেও গাছের কিছু করতে পারে না। যদি নির্জনে সাধন করে ঈশ্বরের পাদপদ্মে ভক্তিলাভ করে বল বাড়িয়ে, বাড়ি গিয়ে সংসার কর, তাহলে কামিনী-কাঞ্চনে তোমার কিছু করতে পারবে না।

“নির্জনে দই পেতে মাখন তুলতে হয়। জ্ঞানভক্তিরূপ মাখন যদি একবার মনরূপ দুধ থেকে তোলা হয়, তাহলে সংসাররূপ জলের উপর রাখলে নির্লিপ্ত হয়ে ভাসবে। কিন্তু মনকে কাঁচা অবস্থায় — দুধের অবস্থায়, যদি সংসাররূপ জলের উপর রাখ, তাহলে দুধে জলে মিশে যাবে। তখন আর মন নির্লিপ্ত হয়ে ভাসতে পারবে না।

“ঈশ্বরলাভের জন্য সংসারে থেকে, একহাতে ঈশ্বরের পাদপদ্ম ধরে থাকবে আর একহাতে কাজ করবে। যখন কাজ থেকে অবসর হবে, তখন দুই হাতেই ঈশ্বরের পাদপদ্ম ধরে থাকবে, তখন নির্জনে বাস করবে, কেবল তাঁর চিন্তা আর সেবা করবে।”

সদরওয়ালা (আনন্দিত হইয়া) — মহাশয়, এ অতি সুন্দর কথা! নির্জনে সাধন চাই বইকি! ওইটি আমরা ভুলে যাই। মনে করি একেবারে জনক রাজা হয়ে পড়েছি! (শ্রীরামকৃষ্ণ ও সকলের হাস্য) সংসারত্যাগের যে প্রয়োজন নাই, বাড়িতে থেকেও ঈশ্বরকে পাওয়া যায়, এ-কথা শুনেও আমার শান্তি ও আনন্দ হল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ত্যাগ তোমাদের কেন করতে হবে? যেকালে যুদ্ধ করতেই হবে, কেল্লা থেকেই যুদ্ধ ভাল। ‘ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে যুদ্ধ, খিদে-তৃষ্ণা এ-সবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। এ-যুদ্ধ সংসার থেকেই ভাল। আবার কলিতে অন্নগত প্রাণ, হয়তো খেতেই পেলে না। তখন ঈশ্বর-টীশ্বর সব ঘুরে যাবে’। একজন তার মাগকে বলেছিল, ‘আমি সংসারত্যাগ করে চললুম।’ মাগটি একটু জ্ঞানী ছিল। সে বললে, ‘কেন তুমি ঘুরে ঘুরে বেড়াবে? যদি পেটের জন্য দশ ঘরে যেতে না হয় তবে যাও। তা যদি হয়, তাহলে এই একঘরই ভাল।’

“তোমারা ত্যাগ কেন করবে? বাড়িতে বরং সুবিধা। আহারের জন্য ভাবতে হবে না। সহবাস স্বদারার সঙ্গে, তাতে দোষ নাই। শরীরের যখন যেটি দরকার কাছেই পাবে। রোগ হলে সেবা করবার লোক কাছে পাবে।

“জনক, ব্যাস, বশিষ্ঠ জ্ঞানলাভের করে সংসারে ছিলেন। এঁরা দুখানা তরবার ঘুরাতেন। একখানা জ্ঞানের, একখানা কর্মের।”

সদরওয়ালা — মহাশয়! জ্ঞান হয়েছে তা কেমন করে জানব?

শ্রীরামকৃষ্ণ — জ্ঞান হলে তাঁকে (ঈশ্বরকে) আর দূরে দেখায় না। তিনি আর তিনি বোধ হয় না। তখন ইনি! হৃদয়মধ্যে তাঁকে দেখা যায়। তিনি সকলেরই ভিতর আছেন, যে খুঁজে সেই পায়।

সদরওয়ালা — মহাশয়! আমি পাপী, কেমন করে বলি যে, তিনি আমার ভিতর আছেন?

[ব্রাহ্মসমাজ, খ্রীষ্টধর্ম ও পাপবাদ ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — ওই তোমাদের পাপ আর পাপ! এ-সব বুঝি খ্রীষ্টানী মত? আমায় একজন একখানি বই দিলে (বাইবেল) দিলে। একটু পড়া শুনলাম; তা তাতে কেবল ওই এককথা — পাপ আর পাপ! আমি তাঁর নাম করেছি; ঈশ্বর, কি রাম, কি হরি বলেছি — আমার আবার পাপ! এমন বিশ্বাস থাকা চাই। নাম-মাহাত্ম্যে বিশ্বাস থাকা চাই।

সদরওয়ালা — মহাশয়! কেমন করে ওই বিশ্বাস হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁতে অনুরাগ কর। তোমাদেরই গানে আছে, ‘প্রভু! বিনে অনুরাগ করে যজ্ঞযাগ, তোমার কি যায় জানা।’ যাতে এরূপ অনুরাগ, এরূপ ঈশ্বরে ভালবাসা হয়, তার জন্য তাঁর কাছে গোপনে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা করো, আর কাঁদো। মাগের ব্যামো হলে, কি টাকা লোকসান হলে, কি কর্মের জন্য, লোকে একঘটি কাঁদে, ঈশ্বরের জন্য কে কাঁদছে বল দেখি?

===========

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

আমমোক্তারী দাও — গৃহস্থের কর্তব্য কতদিন?

ত্রৈলোক্য — মহাশয়, এঁদের সময় কই; ইংরেজের কর্ম করতে হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সদরওয়ালার প্রতি) — আচ্ছা তাঁকে আমমোক্তারী দাও। ভাল লোকের উপর যদি কেউ ভার দেয়, সে লোক কি আর মন্দ করে? তাঁর উপর আন্তরিক সব ভার দিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাক। তিনি যা কাজ করতে দিয়েছেন, তাই করো।

“বিড়ালছানা পাটোয়ারী বুদ্ধি নাই। মা মা করে। মা যদি হেঁসেলে রাখে সেইখানেই পড়ে আছে। কেবল মিউ মিউ করে ডাকে। মা যখন গৃহস্থের বিছানায় রাখে, তখনও সেই ভাব। মা মা করে।”

সদরওয়ালা — আমরা গৃহস্থ, কতদিন এ-এব কর্তব্য করতে হবে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমাদের কর্তব্য আছে বইকি? ছেলেদের মানুষ করা, স্ত্রীকে ভরণপোষণ করতে, তোমার অবর্তমানে স্ত্রীর ভরণপোষণের যোগাড় করে রাখতে হবে। তা যদি না কর, তুমি নির্দয়। শুকদেবাদি দয়া রেখেছিলেন। দয়া যার নাই সে মানুষই নয়।

সদরওয়ালা — সন্তান প্রতিপালন কতদিন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — সাবালক হওয়া পর্যন্ত। পাখি বড় হলে যখন সে আপনার ভার নিতে পারে, তখন তাকে ধাড়ী ঠোকরায়, কাছে আসতে দেয় না। (সকলের হাস্য)

সদরওয়ালা — স্ত্রীর প্রতি কি কর্তব্য?

শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি বেঁচে থাকতে থাকতে ধর্মোপদেশ দেবে, ভরণপোষণ করবে। যদি সতী হয়, তোমার অবর্তমানে তার খাবার যোগাড় করে রাখতে হবে।

“তবে জ্ঞানোন্মাদ হলে আর কর্তব্য থাকে না। তখন কালকার জন্য তুমি না ভাবলে ঈশ্বর ভাবেন। জ্ঞানোন্মআদ হলে তোমার পরিবারদের জন্য তিনি ভাববেন। যখন জমিদার নাবালক ছেলে রেখে মরে যায়, তখন অছি সেই নাবালকের ভার লয়। এ-সব আইনের ব্যাপার তুমি তো সব জান।”

সদরওয়ালা — আজ্ঞা হাঁ।

বিজয় গোস্বামী — আহা! আহা! কি কথা! যিনি অনন্যমন হয়ে তাঁর চিন্তা করেন, যিনি তাঁর প্রেমে পাগল, তাঁর ভার ভগবান নিজে বহন করেন! নাবালকের অমনি ‘অছি’ এসে জোটে। আহা! কবে সেই অবস্থা হবে। যাদের হয় তারা কি ভাগ্যবান!

ত্রৈলোক্য — মহাশয়, সংসারে যথার্থ কি জ্ঞান হয়? ঈশ্বরলাভ হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) — কেন গো, তুমি তো সারে-মাতে আছো। (সকলের হাস্য) ঈশ্বরে মন রেখে সংসারে আছো তো। কেন সংসারে হবে না? অবশ্য হবে।

[সংসারে জ্ঞানীর লক্ষণ — ঈস্বরলাভের লক্ষণ – জীবন্মুক্ত ]

ত্রৈলোক্য — সংসারে জ্ঞানলাভ হয়েছে তার লক্ষণ কি?

শ্রীরামকৃষ্ণ — হরিনামে ধারা আর পুলক। তাঁর মধুর নাম শুনেই শরীর রোমাঞ্চ হবে আর চক্ষু দিয়ে ধারা বেয়ে পড়বে।

“যতক্ষণ বিষয়াসক্তি তাকে, কামিনী-কাঞ্চনে ভালবাসা থাকে, ততক্ষণ দেহবুদ্ধি যায় না। বিষয়াসক্তি যত কমে ততই আত্মজ্ঞানের দিকে চলে যেতে পারা যায়, আর দেহবুদ্ধি কমে। বিষয়াসক্তি একেবারে চলে গেলে আত্মজ্ঞান হয়, তখন আত্মা আলাদা আর দেহ আলাদা বোধ হয়। নারিকেলের জল না শুকুলে দা দিয়ে কেটে শাঁস আলাদা, মালা আলাদা করা কঠিন হয়। জল যদি শুকিয়ে যায়, তাহলে নড় নড় করে, শাঁস আলাদা হয়ে যায়। একে বলে খড়ো নারিকেল।

“ঈশ্বরলাভ হলে লক্ষণ এই যে, সে ব্যক্তি খড়ো-নারিকেলের মতো হয়ে যায় — দেহাত্মবুদ্ধি চলে যায়। দেহের সুখ-দুঃখে তার সুখ-দুঃখ বোধ হয় না। সে ব্যক্তি দেহের সুখ চায় না। জীবন্মুক্ত হয়ে বেড়ায়।

‘কালীর ভক্ত জীবন্মুক্ত নিত্যানন্দময়।’

“যখন দেখবে ঈশ্বরের নাম করতেই অশ্রু আর পুলক হয়, তখন জানবে, কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি চলে গেছে, ঈশ্বরলাভ হয়েছে। দেশলাই যদি শুকনো হয়, একটা ঘষলেই দপ করে জ্বলে উঠে। আর যদি ভিজে হয়, পঞ্চাশটা ঘষলেও কিছু হয় না। কেবল কাঠিগুলো ফেলা যায়। বিষয়রসে রোসে থাকলে, কামিনী-কাঞ্চন-রসে মন ভিজে থাকলে, ঈশ্বরের উদ্দীপনা হয় না। হাজার চেষ্টা কর, কেবল পণ্ডশ্রম। বিষয়রস শুকুলে তৎক্ষণাৎ উদ্দীপন হয়।”

[উপায় ব্যাকুলতা — তিনি যে আপনার মা ]

ত্রৈলোক্য — বিষয়রস শুকোবার এখন উপায় কি?

শ্রীরামকৃষ্ণ — মার কাছে ব্যাকুল হয়ে ডাকো। তাঁর দর্শন হলে বিষয়রস শুকিয়ে যাবে; কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি সব দূরে চলে যাবে। আপনার মা বোধ থাকলে এক্ষণেই হয়। তিনি তো ধর্ম-মা নন। আপনারই মা। ব্যাকুল হয়ে মার কাছে আব্দার কর। ছেলে ঘুড়ি কিনবার জন্য মার আঁচল ধরে পয়সা চায় — মা হয়তো আর মেয়েদের সঙ্গে গল্প পরছে। প্রথমে মা কোনমতে দিতে চায় না। বলে, ‘না, তিনি বারণ করে গেছেন, তিনি এলে বলে দিব, এক্ষণই ঘুড়ি নিয়ে একটা কাণ্ড করবি।’ যখন ছেলে কাঁদতে শুরু করে, কোন মতে ছাড়ে না, মা অন্য মেয়েদের বলে, ‘রোস মা, এ-ছেলেটাকে একবার শান্ত করে আসি।’ এই কথা বলে, চাবিটা নিয়ে কড়াৎ কড়াৎ করে বাক্স খুলে একটা পয়সা ফেলে দেয়। তোমারও মার কাছে আব্দার করো, তিনি অবশ্য দেখা দিবেন। আমি শিখদের ওই কথা বলেছিলাম। তারা দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে এসেছিল; মা-কালীর মন্দিরের সম্মুখে বসে কথা হয়েছিল। তারা বলেছিল, ‘ঈশ্বর দয়াময়’। জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কিসে দয়াময়?’ তারা বললে, কেন মহারাজ! তিনি সর্বদা আমাদের দেখছেন, আমাদের ধর্ম অর্থ সব দিচ্ছেন, আহার যোগাচ্ছেন। আমি বললুম, যদি কারো ছেলেপুলে হয়, তাদের খবর তাদের খাওয়ার ভার, বাপ নেবে, না, তো কি বামুনপাড়ার লোকে এসে নেবে?

সদরওয়ালা — মহাশয়! তিনি কি তবে দয়াময় নন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — তা কেন গো? ও একটা বললুম; তিনি যে বড় আপনার লোক! তাঁর উপর আমাদের জোর চলে! আপনার লোককে এমন কথা পর্যন্ত বলা যায়, “দিবি না রে শালা।”

===========

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

অহংকার ও সদরওয়ালা

শ্রীরামকৃষ্ণ (সদরওয়ালার প্রতি) — আচ্ছা, অভিমান, অহংকার জ্ঞানে হয় — না, অজ্ঞানে হয়? অহংকার তমোগুণ, অজ্ঞান থেকে উৎপন্ন হয়। এই অহংকার আড়াল আছে বলে তাই ঈশ্বরকে দেখা যায় না। “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল।” অহংকার করা বৃথা। এ-শরীর, এ-ঐশ্বর্য কিছুই থাকবে না। একটা মাতাল দুর্গা প্রতিমা দেখছিল। প্রতিমার সাজগোজ দেখে বলছে, “মা, যতই সাজো-গোজো, দিন দুই-তিন পরে তোমায় টেনে গঙ্গায় ফেলে দিবে।” (সকলের হাস্য) তাই সকলকে বলছি, জজই হও আর যেই হও সব দুদিনের জন্য। তাই অভিমান, অহংকার ত্যাগ করতে হয়।

[ব্রাহ্মসমাজ ও সাম্য — লোক ভিন্ন প্রকৃতি ]

“সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের ভিন্ন স্বভাব। তমোগুণীদের লক্ষণ, অহংকার, নিদ্রা, বেশি ভোজন, কাম, ক্রোধ — এই সব রজোগুণিরা বেশি কাজ জড়ায়; কাপড়; পোশাক ফিট-ফাট, বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, বৈঠকখানায় কুইনের ছবি, যখন ঈশ্বরচিন্তা করে তখন চেলী-গরদ পরেম গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, তার মাঝে মাঝে একটি একটি সোনার রুদ্রাক্ষ; যদি কেউ ঠাকুরবাড়ি দেখতে আসে তবে সঙ্গে করে দেখায় আর বলে, এদিকে আসুন আরও আছে, শ্বেত পাথরের, মার্বেল পাথরের মেঝে আছে, ষোল-ফোকর নাটমন্দির আছে। আবার দান করে, লোককে দেখিয়ে। সত্ত্বগুণী লোক অতি শিষ্ট-শান্ত, কাপড় যা তা; রোজগার পেট চলা পর্যন্ত, কখনও লোকের তোষামোদ করে ধন লয় না, বাড়িতে মেরামত নাই, ছেলেদের পোশাকের জন্য ভাবে না; মান-সম্ভ্রমের জন্য ব্যস্ত হয় না, ঈশ্বরচিন্তা, দানধ্যান সমস্ত গোপনে — লোকে টের পায় না; মশারির ভিতর ধ্যান করে, লোকে ভাবে বাবুর রাতে ঘুম হয় নাই তাই বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছেন। সত্ত্বগুণ সিঁড়ির শেষ ধাপ, তারপরেই ছাদ। সত্ত্বগুণ এলেই ঈশ্বরলাভের আর দেরি হয় না — আর একটু গেলেই তাঁকে পাবে। (সদরওয়ালার প্রতি) — তুমি বলেছিলে সব লোক সমান। এই দেখ, কত ভিন্ন প্রকৃতি।

“আরও কত রকম থাক থাক আছে; — নিত্যজীব, মুক্তজীব, মুমুক্ষজীব, বদ্ধজীব, — নানারকম মানুষ। নারদ, শুকদেব নিত্যজীব, যেমন স্টীম বোট্‌ (কলের জাহাজ) পারে আপনিও যেতে পারে আবার বড় জীবজন্তু হাতি পর্যন্ত পারে নিয়ে যায়। নিত্যজীবেরা নায়েবের স্বরূপ; একটা তালুক শাসন করে আর-একটা তালুক শাসন করতে যায়। আবার মুমুক্ষ জীব আছে, যারা সংসার জাল থেকে মুক্ত হোয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করছে। এদের মধ্যে দুই-একজন জাল থেকে পালাতে পারে, তারা মুক্ত জীব। নিত্যজীবেরা এক-একটা সিয়ানা মাছের মতো; কখনও জালে পড়ে না।

“কিন্তু বদ্ধজীব — সংসারী জীব — তাদের হুঁশ নাই। তারা জালে পড়েই আছে, অথচ জালে বদ্ধ হয়েছি, এরূপ জ্ঞানও নাই। এরা হরিকথা সম্মুখে হলে সেখান থেকে চলে যায়, — বলে হরিনাম মরবার সময় হবে; এখন কেন? আবার মৃত্যুশয্যায় শুয়ে, পরিবার কিম্বা ছেলেদের বলে, ‘প্রদীপে অত সলতে কেন, একটা সলতে দাও; তা না হলে তেল পুড়ে যাবে’; আর পরিবার ও ছেলেদের মনে করে কাঁদে আর বলে, ‘হায়! আমি ম’লে এদের কি হবে।’ আর বদ্ধজীব যাতে এত দুঃখ ভোগ করে, তাই আবার করে; যেমন উটের কাঁটা ঘাস খেতে খেতে মুখ দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ে, তবু কাঁটা ঘাস ছাড়ে না। এদিকে ছেলে মারা গেছে, শোকে কাতর, তবু আবার বছর বছর ছেলে হবে; মেয়ের বিয়েতে সর্বস্বান্ত হল, আবার বছর বছর মেয়ে হবে; বলে, কি করব অদৃষ্টে ছিল। যদি তীর্থ করতে যায়, নিজে ঈশ্বরচিন্তা করবার অবসর পায় না। — কেবল পরিবারদের পুঁটুলি বইতে বইতে প্রাণ যায়, ঠাকুরদের মন্দিরে গিয়ে ছেলেকে চরণামৃত খাওয়াতে, গড়াগড়ি দেওয়াতেই ব্যস্ত। বদ্ধজীব নিজের আর পরিবারদের পেটের জন্য দাসত্ব করে — আর মিথ্যাকথা, প্রবঞ্চনা, তোষামোদ করে ধন উপায় করে। যারা ঈশ্বরচিন্তা করে, ঈশ্বরের ধ্যানে মগ্ন হয়, বদ্ধজীব তাদের পাগল বলে উড়িয়ে দেয়। (সদরওয়ালার প্রতি) মানুষ কত রকম দেখ; তুমি সব এক বলছিলে। কত ভিন্ন প্রকৃতি। কারু বশি শক্তি, কারু কম।”

[বদ্ধজীব মৃত্যুকালে ঈশ্বরের নাম করে না ]

“সংসারাক্ত বদ্ধজীব মৃত্যুকালে সংসারের কথাই বলে। বাহিরে মালা জপলে, গঙ্গাস্নান করলে, তীর্থে গেলে — কি হবে? সংসার আসক্তি ভিতরে থাকলে মৃত্যুকালে সেটি দেখা যায়। কত আবোল-তাবোল বলে; হয়তো বিকারের খেয়ালে ‘হলুদ, পাঁচফোড়ন, তেজপাতা’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। শুকপাখি সহজ বেলা রাধাকৃষ্ণ বলে, বিল্লি ধরলে নিজের বুলি বেরোয়, ক্যাঁ ক্যাঁ করে। গীতায় আছে মৃত্যুকালে যা মনে করবে, পরলোকে তাই হবে। ভরত রাজা ‘হরিণ’, ‘হরিণ’ করে দেহত্যাগ করেছিল, তাই হরিণ-জন্ম হল। ঈশ্বরচিন্তা করে দেহত্যাগ করলে ঈশ্বরলাভ হয়, আর এ-সংসারে আসতে হয় না।”

ব্রাহ্মভক্ত — মহাশয়, অন্য সময় ঈশ্বরচিন্তা করেছে, কিন্তু মৃত্যু সময় করে নাই বলে কি আবার এই সুখ-দুঃখময় সংসারে আসতে হবে? কেন, আগে তো ঈশ্বরচিন্তা করেছিল?

শ্রীরামকৃষ্ণ — জীব ঈশ্বরচিন্তা করে, কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাস নাই, আবার, ভুলে যায়; সংসারে আসক্ত হয়। যেমন এই হাতিকে স্নান করিয়ে দিলে, আবার ধুলা-কাদা মাখে। মনমত্তকরী! তবে হাতিকে নাইয়েই যদি আস্তাবলে সাঁধ করিয়া দিতে পার, তাহলে আর ধুলা-কাদা মাখতে পারে না। যদি জীব মৃত্যুকালে ঈশ্বরচিন্তা করে, তাহলে শুদ্ধমন হয়, সে মন কামিনী-কাঞ্চনে আবার আসক্ত হবার অবসর পায় না।

“ঈশ্বরে বিশ্বাস নাই, তাই এত কর্মভোগ। লোকে বলে যে, গঙ্গা-স্নানের সময় তোমার পাপগুলো তোমায় ছেড়ে গঙ্গার তীরের গাছের উপর বসে থাকে। যাই তুমি গঙ্গাস্নান করে তীরে উঠছো অমনি পাপগুলো তোমার ঘাড়ে আবার চেপে বসে। (সকলের হাস্য) দেহত্যাগের সময় যাতে ঈশ্বরচিন্তা হয়, তাই তার আগে থাকতে উপায় করতে হয়। উপায় — অভ্যাসযোগ। ঈশ্বরচিন্তা অভ্যাস করলে শেষের দিনেও তাঁকে মনে পড়বে।”

ব্রাহ্মভক্ত — বেশ কথা হল। অতি সুন্দর কথা।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কি এলোমেলো বকলুম! তবে আমার ভাব কি জান? আমি যন্ত্র তিনি যন্ত্রী; আমি ঘর তিনি ঘরণী; আমি গাড়ি তিনি Engineer; আমি রথ তিনি রথী; যেমন চালান তেমনি চলি; যেমন করান তেমনি করি।
==========

সপ্তম পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ সংকীর্তনানন্দে

ত্রৈলোক্য আবার গান গাহিতেছেন। সঙ্গে খোল-করতাল বাজিতেছে। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রেমে উন্মত্ত হইয়া নৃত্য করিতেছেন। নৃত্য করিতে করিতে কতবার সমাধিস্থ হইতেছেন। সমাধিস্থ অবস্থায় দাঁড়াইয়া আছেন, স্পন্দহীন দেহ, স্থিরনেত্র, সহাস্যবদন; কোন প্রিয় ভক্তের স্কন্ধদেশে হাত দিয়ে আছেন। আবার ভাবান্তে মত্ত মাতঙ্গের ন্যায় নৃত্য। বাহ্যদশা প্রাপ্ত হইয়া গানের আখর দিতেছেন:

“নাচ মা, ভক্তবৃন্দ বেড়ে বেড়ে;
আপনি নেচে নাচাও গো মা;
(আবার বলি) হৃদিপদ্মে একবার নাচ মা;
নাচ গো ব্রহ্মময়ী সেই ভুবনমোহনরূপে।”

সে অপূর্ব দৃশ্য! মাতৃগতপ্রাণ, প্রেমে মাতোয়ারা সেই স্বর্গীয় বালকের নৃত্য! ব্রাহ্মভক্তেরা তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া নৃত্য করিতেছেন — যেন লোহাকে চুম্বুকে ধরিয়াছে! সকলে উন্মত্ত হইয়া ব্রহ্মনাম করিতেছেন; আবার ব্রহ্মের সেই মধুর নাম, — মা নাম করিতেছেন। অনেকে বালকের মতো “মা, মা” বলিতে বলিতে কাঁদিতেছেন।

কীর্তনান্তে সকলে আসন গ্রহণ করিয়াছেন। শ্রীরামকৃষ্ণও আসীন। সম্মুখে বিজয়। বিজয়ের শাশুড়ী ঠাকুরানী ও অন্যানা মেয়েভক্তেরা তাঁহাকে দর্শন করিবেন ও তাঁহার সঙ্গে কথা বলিবেন বলিয়া সংবাদ পাঠাইলে, তিনি একটি ঘরের ভিতর গিয়া তাহাদের সঙ্গে দেখা করিলেন।

কিয়ৎ পরে ফিরিয়া আসিয়া বিজয়কে বলিতেছেন, “দেখ, তোমার শাশুড়ীর কি ভক্তি! বলে, সংসারের কথা আর বলবেন না। এক ঢেউ যাচ্ছে, আর-এক ঢেউ আসছে! আমি বললুম, ওগো, তোমার আর তাতে কি! তোমার তো জ্ঞান হয়েছে। তোমার শাশুড়ী তাতে বললেন, আমার আবার কি জ্ঞান হয়েছে। এখনও বিদ্যা-মায়া আর অবিদ্যা-মায়ার পার হই নাই, শুধু অবিদ্যার পার হলে তো হবে না, বিদ্যার পার হতে হবে, তবে তো জ্ঞান হবে; আপনিই তো ও-কথা বলেন।”

এ-কথা হইতেছে এমন সময় শ্রীযুক্ত বেণী পাল আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

বেণী পাল (বিজয়ের প্রতি) — মহাশয়, তবে গাত্রোত্থান করুন, অনেক দেরি হয়ে গেছে উপাসনা আরম্ভ করুন।

বিজয় — মহাশয়, আর উপাসনা কি দরকার। আপনাদের এখানে আগে পায়েসের ব্যবস্থা, তারপর কড়ার ডাল ও অন্যান্য ব্যবস্থা।

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিয়া) — যে যেমন ভক্ত সে সেইরূপ আয়োজন করে। সত্ত্বগুণীভক্ত পায়স দেয়, রজোগুণীভক্ত পঞ্চাশ ব্যঞ্জন দিয়ে ভোগ দেয়, তমোগুণীভক্ত ছাগ ও অন্যান্য বলি দেয়।

বিজয় উপাসনা করিতে বেদীতে বসিবেন কিনা ভাবিতেছেন।
============

অষ্টম পরিচ্ছেদ

বিজয়ের প্রতি উপদেশ

[ব্রাহ্মসমাজে লেকচার — আচার্যের কার্য — ঈশ্বরই গুরু ]

বিজয় — আপনি অনুগ্রহ করুন, তবে আমি বেদী থেকে বলব।

শ্রীরামকৃষ্ণ — অভিমান গেলেই হল। ‘আমি লেকচার দিচ্ছি, তোমরা শুন’ — এ-অভিমান না থাকলেই হল। অহংকার জ্ঞানে হয়, না, অজ্ঞানে হয়? যে নিরহংকার তারই জ্ঞান হয়। নিচু জায়গায় বৃষ্টির জল দাঁড়ায়, উঁচু জায়গা থেকে গড়িয়ে যায়।

“যতক্ষণ অহংকার থাকে, ততক্ষণ জ্ঞান হয় না; আবার মুক্তিও হয় না। এই সংসারে ফিরে ফিরে আসতে হয়। বাছুর হাম্বা হাম্বা (আমি আমি) করে, তাই অত যন্ত্রণা। কসায়ে কাটে, চামড়ায় জুতো হয়। আবার ঢোল-ঢাকের চামড়া হয়; সে ঢাক কত পেটে, কষ্টের শেষ নাই। শেষে নাড়ী থেকে তাঁত হয়, সেই তাঁতে যখন ধুনুরীর যন্ত্র তৈয়ার হয়, আর ধুনুরীর তাঁতে তুঁহু তুঁহু (তুমি তুমি) বলতে থাকে, তখন নিস্তার হয়। তখন আর হাম্বা হাম্বা (আমি আমি) বলছে না; বলছে তুঁহু তুঁহু (তুমি তুমি) অর্থাৎ হে ঈশ্বর, তুমি কর্তা, আমি অকর্তা; তুমি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র; তুমিই সব।

“গুরু, বাবা ও কর্তা — এই তিন কথায় আমার গায়ে কাঁটা বেঁধে। আমি তাঁর ছেলে, চিরকাল বালক, আমি আবার ‘বাবা’ কি? ঈশ্বর কর্তা আমি অকর্তা; তিনি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র।

“যদি কেউ আমায় গুরু বলে, আমি বলি, ‘দূর শালা’। গুরু কিরে? এক সচ্চিদানন্দ বই আর গুরু নাই। তিনি বিনা কোন উপায় নাই। তিনিই একমাত্র ভবসাগরের কাণ্ডারী।

(বিজয়ের প্রতি) — “আচার্যগিরি করা বড় কঠিন। ওতে নিজের হানি হয়। অমনি দশজন মানছে দেখে, পায়ের উপর পা দিয়ে বলে, ‘আমি বলছি আর তোমরা শুন’। এই ভাবটা বড় খারাপ। তার ওই পর্যন্ত! ওই একটু মান; লোকে হদ্দ বলবে, ‘আহা বিজয়বাবু বেশ বললেন, লোকটা খুব জ্ঞানী’। ‘আমি বলছি’ এ-জ্ঞান করো না। আমি মাকে বলি, ‘মা তুমি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র; যেমন করাও তেমনি করি; যেমন বলাও তেমনি বলি।”

বিজয় (বিনীতভাবে) — আপনি বলুন, তবে আমি গিয়ে বসব।

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) — আমি কি বলব; চাঁদা মামা সকলের মামা। তুমিই তাঁকে বল। যদি আন্তরিক হয়, কোন ভয় নাই।

বিজয় আবার অনুনয় করাতে শ্রীরামকৃষ্ণ বলিলেন, “যাও, যেমন পদ্ধতি আছে তেমনি করগে; আন্তরিক তাঁর উপর ভক্তি থাকলেই হল।”

বিজয় বেদীতে আসীন হইয়া ব্রাহ্মসমাজের পদ্ধতি অনুসারে উপাসনা করিতেছেন। বিজয় প্রার্থনার সময় মা মা করিয়া ডাকিতেছেন। সকলেরই মন দ্রবীভূত হইল।

উপাসনান্তে ভক্তদের সেবার জন্য ভোজনের আয়োজন হইতেছে। সতরঞ্চি, গালিচা সমস্ত উঠাইয়া পাতা হইতে লাগিল, ভক্তেরা সকলেই বসিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আসন হইল। তিনি বসিয়া শ্রীযুক্ত বেণী পাল প্রদত্ত উপাদেয় লুচি, কচুরি, পাঁপর, নানবিধ মিষ্টান্ন, দধি, ক্ষীর ইত্যাদি সমস্ত ভগবানকে নিবেদন করিয়া আনন্দে প্রসাদ লইলেন।

==========

নবম পরিচ্ছেদ

মা — কালী ব্রহ্ম — পূর্ণজ্ঞানের পর অভেদ

আহারান্তে সকলে পান খাইতে বাড়ি প্রত্যাগমনের উদ্যোগ করিতেছেন। যাইবার পূর্বে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বিজয়ের সহিত একান্তে বসিয়া কথা কহিতেছেন। সেখানে মাস্টার আছেন।

[ব্রাহ্মসমাজে ঈশ্বরের মাতৃভাব — Motherhood of God]

শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি তাঁকে মা মা বলে প্রার্থনা করছিলে। এ-খুব ভাল। কথায় বলে, মায়ের টান বাপের চেয়ে বেশি। মায়ের উপর জোর চলে, বাপের উপর চলে না। ত্রৈলোক্যের মায়ের জমিদারী থেকে গাড়ি গাড়ি ধন আসছিল, সঙ্গে কত লাল পাগড়িওয়ালা লাঠি হাতে দ্বারবান। ত্রৈলোক্য রাস্তায় লোকজন নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, জোর করে সব ধন কেড়ে নিলে। মায়ের ধনের উপর খুব জোর চলে। বলে নাকি ছেলের নামে তেমন নালিশ চলে না।

বিজয় — ব্রহ্ম যদি মা, তাহলে তিনি সাকার না নিরাকার?

শ্রীরামকৃষ্ণ — যিনি ব্রহ্ম, তিনি কালী (মা আদ্যাশক্তি)। যখন নিষ্ক্রিয়, তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় — এই সব কাজ করেন, তাঁকে শক্তি বলে কই। স্থির জল ব্রহ্মের উপমা। জল হেলচে দুলচে, শক্তি বা কালীর উপমা। কালী! কিনা — যিনি মহাকালের (ব্রহ্মের) সহিত রমণ করেন। কালী “সাকার আকার নিরাকারা।” তোমাদের যদি নিরাকার বলে বিশ্বাস, কালীকে সেইরূপ চিন্তা করবে। একটা দৃঢ় করে তাঁর চিন্তা করলে তিনিই জানিয়ে দেবেন, তিনি কেমন। শ্যামপুকুরে পৌঁছিলে তেলীপাড়াও জানতে পারবে। জানতে পারবে যে তিনি শুধু আছেন (অস্তিমাত্রম্‌) তা নয়। তিনি তোমার কাছে এসে কথা কবেন — আমি যেমন তোমার সঙ্গে কথা কচ্ছি। বিশ্বাস করো সব হয়ে যাবে। আর-একটি কথা — তোমার নিরাকার বলে যদি বিশ্বাস, তাই বিশ্বাস দৃঢ় করে করো। কিন্তু মতুয়ার বুদ্ধি (Dogmatism) করো না। তাঁর সম্বন্ধে এমন কথা জোর করে বলো না যে তিনি এই হতে পারেন, আর এই হতে পারেন না। বলো আমার বিশ্বাস তিনি নিরাকার, আর কত কি হতে পারেন তিনি জানেন। আমি জানি না। বুঝতে পারি না। মানুষের একছটাক বুদ্ধিতে ঈশ্বরের স্বরূপ কি বুঝা যায়? একসের ঘটিতে কি চারসের দুধ ধরে? তিনি যদি কৃপা করে কখনও দর্শন দেন, আর বুঝিয়ে দেন, তবে বুঝা যায়; নচেৎ নয়।

‘যিনি ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি, তিনিই মা।’

“প্রসাদ বলে মাতৃভাবে আমি তত্ত্ব করি যাঁরে।
সেটা চাতরে কি ভাঙবো হাঁড়ি, বোঝনা রে মন ঠারে ঠোরে ।।

“আমি তত্ত্ব করি যাঁরে। অর্থাৎ আমি সেই ব্রহ্মের তত্ত্ব করছি। তাঁরেই মা মা বলে ডাকছি। আবার রামপ্রসাদ ওই কথাই বলছে, —

আমি কালীব্রহ্ম জেনে মর্ম, ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি।

“অধর্ম কিনা অসৎ কর্ম। ধর্ম কিনা বৈধী কর্ম — এত দান করতে হবে, এত ব্রাহ্মণ ভোজন করাতে হবে, এই সব ধর্ম।”

বিজয় — ধর্মাধর্ম ত্যাগ করলে কি বাকি থাকে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — শুদ্ধাভক্তি। আমি মাকে বলেছিলাম, মা! এই লও তোমার ধর্ম, এই লও তোমার অধর্ম, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও; এই লও তোমার পাপ, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও; এই লও তোমার জ্ঞান, এই লও তোমার অজ্ঞান, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও! দেখ, জ্ঞান পর্যন্ত আমি চাই নাই। আমি লোকমান্যও চাই নাই। ধর্মাধর্ম ছাড়লে শুদ্ধাভক্তি — অমলা, নিষ্কাম, অহেতুকী ভক্তি — বাকি থাকে।

[ব্রাহ্মসমাজ ও বেদান্ত প্রতিপাদ্য ব্রহ্ম — আদ্যাশক্তি ]

ব্রাহ্মভক্ত — তিনি আর তাঁর শক্তি কি তফাত?

শ্রীরামকৃষ্ণ — পূর্ণজ্ঞানের পর অভেদ। যেমন মণির জ্যোতিঃ আর মণি, অভেদ। মণির জ্যোতিঃ ভাবলেই মণি ভাবতে হয়। দুধ আর দুধের ধবলত্ব যেমন অভেদ। একটাকে ভাবলেই আর-একটাকে ভাবতে হয়। কিন্তু এ অভেদ জ্ঞান — পূর্ণজ্ঞান না হলে হয় না। পূর্ণজ্ঞানে সমাধি হয়, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব ছেড়ে চলে যায় — তাই অহংতত্ত্ব থাকে না। সমাধিতে কি বোধ হয় মুখে বলা যায় না। নেমে একটু আভাসের মতো বলা যায়। যখন সমাধি ভঙ্গের পর ‘ওঁ ওঁ’ বলি, তখন আমি একশো হাত নেমে এসেছি। ব্রহ্ম বেদবিধির পার, মুখে বলা যায় না। সেখানে ‘আমি’ ‘তুমি’ নাই।

“যতক্ষণ ‘আমি’ ‘তুমি’ আছে, যতক্ষণ ‘আমি প্রার্থনা কি ধ্যান করছি’ এ-জ্ঞান আছে, ততক্ষণ ‘তুমি’ (ঈশ্বর) প্রার্থনা শুনছো, এ-জ্ঞানও আছে; ঈশ্বরকে ব্যক্তি বলে বোধ আছে। তুমি প্রভু, আমি দাস; তুমি পূর্ণ, আমি অংশ; তুমি মা, আমি ছেলে — এ-বোধ থাকবে। এই ভেদবোধ; আমি একটি, তুমি একটি। এ ভেদবোধ তিনিই করাচ্ছেন। তাই পুরুষ-মেয়ে, আলো-অন্ধকার — এই সব বোধ হচ্ছে। যতক্ষণ এই ভেদবোধ, ততক্ষণ শক্তি (Personal God) মানতে হবে। তিনিই আমাদের ভিতর ‘আমি’ রেখে দিয়েছেন। হাজার বিচার কর, ‘আমি’ আর যায় না। আর তিনি ব্যক্তি হয়ে দেখা দেন।

“তাই যতক্ষণ ‘আমি’ আছে — ভেদবুদ্ধি আছে — ততক্ষণ ব্রহ্ম নির্গুণ বলবার জো নাই। ততক্ষণ সগুণ ব্রহ্ম মানতে হবে। এই সগুণ ব্রহ্মকে বেদ, পুরাণ, তন্ত্রে কালী বা আদ্যাশক্তি বলে গেছে।”

বিজয় — এই আদ্যাশক্তি দর্শন আর ওই ব্রহ্মজ্ঞান, কি উপায়ে হতে পারে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — ব্যাকুল হৃদয়ে তাঁকে প্রার্থনা করো। আর কাঁদো! এইরূপে চিত্তশক্তি হয়ে যাবে। নির্মল জলে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখতে পাবে। ভক্তের আমিরূপ আরশিতে সেই সগুণ ব্রহ্ম আদ্যাশক্তি দর্শন করবে। কিন্তু আরশি খুব পোঁছা চাই। ময়লা থাকলে ঠিক প্রতিবিম্ব পড়বে না।

“যতক্ষণ ‘আমি’ জলে সূর্যকে দেখতে হয়, সূর্য্যকে দেখবার আর কোনরূপ উপায় হয় না। আর যতক্ষণ প্রতিবিম্ব সূর্যকে দেখবার উপায় নাই, ততক্ষণ প্রতিবিম্ব সূর্যই ষোল আনা সত্য — যতক্ষণ আমি সত্য ততক্ষণ প্রতিবিম্ব সূর্যও সত্য — ষোল আনা সত্য। সেই প্রতিবিম্ব সূর্যই আদ্যাশক্তি।

“ব্রহ্মজ্ঞান যদি চাও — সেই প্রতিবিম্বকে ধরে সত্য সূর্যের দিকে যাও। সেই সগুণ ব্রহ্ম, যিনি প্রার্থনা শুনেন তাঁরেই বলো, তিনিই সেই ব্রহ্মজ্ঞান দিবেন। কেননা, ইনিই সগুণ ব্রহ্ম, তিনিই নির্গুণ ব্রহ্ম, যিনিই শক্তি, তিনিই ব্রহ্ম। পূর্ণজ্ঞানের পর অভেদ।

“মা ব্রহ্মজ্ঞানও দেন। কিন্তু শুদ্ধভক্ত প্রায় ব্রহ্মজ্ঞান চায় না।

“আর-এক পথ — জ্ঞানযোগ, বড় কঠিন পথ। ব্রাহ্মসমাজের তোমরা জ্ঞানী নও, ভক্ত! যারা জ্ঞানী, তাদের বিশ্বাস যে ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা, স্বপ্নবৎ। আমি, তুমি, সব স্বপ্নবৎ!”

[ব্রাহ্মসমাজে বিদ্বেষভাব ]

“তিনি অন্তর্যামী! তাঁকে সরল মনে, শুদ্ধমনে প্রার্থনা কর। তিনি সব বুঝিয়ে দিবেন। অহংকার ত্যাগ করে তাঁর শরণাগত হও; সব পাবে।

“আপনাতে আপনি থেকো মন যেও নাকো কারু ঘরে।
যা চাবি তাই ব’সে পাবি খোঁজ নিজ অন্তপুরে।
পরম ধন এই পরশমণি, যা চাবি তাই দিতে পারে
কত মণি পড়ে আছে, চিন্তামণির নাচ দুয়ারে।।

“যখন বাহিরে লোকের সঙ্গে মিশবে, তখন সকলেকে ভালবাসবে, মিশে যেন এক হয়ে যাবে — বিদ্বেষভাব আর রাখবে না। ‘ও-ব্যক্তি সাকার মানে, নিরাকার মানে না; ও নিরাকার মানে, সাকার মানে না; ও হিন্দু, ও মুসলমান, ও খ্রীষ্টান’ — এই বলে নাক সিটকে ঘৃণা করো না! তিনি যাকে যেমন বুঝিয়েছেন। সকলের ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতি জানবে, জেনে তাদের সঙ্গে মিশবে, — যত দূর পার। আর ভালবাসবে। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে শান্তি আনন্দভোগ করবে। ‘জ্ঞানদীপ জ্বেলে ঘরে ব্রহ্মময়ীর মুখ দেখো না।’ নিজের ঘরে স্ব-স্বরূপকে দেখতে পাবে।

“রাখাল যখন গরু চরাতে যায়, গরু সব মাঠে গিয়ে এক হয়ে যায়। এক পালের গরু। যখন সন্ধ্যার সময় নিজের ঘরে যায়, আবার পৃথক হয়ে যায়। নিজের ঘরে ‘আপনাতে আপনি থাকে’।”

[সন্ন্যাসে সঞ্চয় করিতে নাই — শ্রীযুক্ত বেণী পালের অর্থের সদ্ব্যবহার ]

রাত্রি দশটার পর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়িতে ফিরিবার জন্য গাড়িতে উঠিলেন। সঙ্গে দুই-একজন সেবক ভক্ত। গভীর অন্ধকার, গাছতলায় গাড়ি দাঁড়িয়ে। বেণী পাল রামলালের জন্য লুচি মিষ্টান্নাদি গাড়িতে তুলিয়া দিতে আসিলেন।

বেণী পাল — মহাশয়! রামলাল আসতে পারেন নাই, তার জন্য কিছু খাবার এঁদের হাতে দিতে ইচ্ছা করি। আপনি অনুমতি করুন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ব্যস্ত হইয়া) — ও বাবু বেণী পাল! তুমি আমার সঙ্গে ও-সব দিও না! ওতে আমার দোষ হয়। আমার সঙ্গে কোন জিনিস সঞ্চয় করে নিয়ে যেতে নাই। তুমি কিছু মনে করবে না।

বেণী পাল — যে আজ্ঞা, আপনি আশীর্বাদ করুন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আজ খুব আনন্দ হল। দেখ, অর্থ যার দাস, সেই মানুষ। যারা অর্থের ব্যবহার জানে না, তারা মানুষ হয়ে মানুষ নয়। আকৃতি মানুষের কিন্তু পশুর ব্যবহার! ধন্য তুমি! এতগুলি ভক্তকে আনন্দ দিলে।
============

Post a Comment

0 Comments