জাগরণের অগ্রদূত
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক। বিস্তীর্ণ ভারতভূমির পথপ্রান্তর গ্রামনগর মরুপৰ্বত অরণ্য অতিক্রম করিয়া চলিয়াছেন এক তরুণ সন্ন্যাসী—যাঁহার দৃঢ়বজ্রমুষ্টিতে ধৃত প্রাচীনতার প্রতীক পরিব্রাজকের যষ্টি, উন্নত শীর্ষে শােভমান যুগযুগান্তর-ব্যাপী সাধনার হােমানলসদৃশ গৈরিক উষ্ণীষ, বিশাল নয়নে তপঃ সিদ্ধির দিব্যদ্যুতি।
ভারতাত্মার মূর্ত-বিগ্রহ স্বামী বিবেকানন্দ চলিয়াছেন নব-জাগরণের বার্তা বহন করিয়া হিমালয় হইতে কুমারিকা। রাজার প্রাসাদ, চাষীর কুটির, ভুনাওয়ালার চুল্লী, ভাঙ্গির খাটিয়া, উকিল ডাক্তার অধ্যাপকের গৃহ, মুদি ময়রা মুচির দোকান—যেদিন যেখানে আশ্রয় মিলিয়াছে, সেদিন সেখানেই তিনি ভারতমাতার স্নেহ-স্পর্শ অনুভব করিয়া জননীর সকল দুঃখ কষ্টের অন্তরালে তাহার অধ্যাত্ম-স্বরূপকে জানিয়া লইয়াছেন—তাই তাে তাঁহার কণ্ঠে বিঘােষিত হইল ভারতের চিরন্তন বাণী, শাশ্বত আশা!
পুণ্যভূমির শেষপ্রান্তে সমুদ্রবিধৌত শিলাখণ্ডের উপর ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীর দিব্যদৃষ্টিতে খেলিয়া গেল ভারত-জীবনের চলচ্চিত্র—অতীত, বর্তমান, অনাগত। অতীতের গৌরব, বর্তমানের দৈন্য ও দুর্দশার পারে উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের ইঙ্গিত ধ্যানসিদ্ধ সন্ন্যাসীর মন আশা-চঞ্চল করিয়া তুলিল; তিনি ফিরিলেন লােকালয়ের অভিমুখে, দ্বারে দ্বারে বলিতে লাগিলেন—“ওঠ, জাগাে, সুদীর্ঘ-রজনী অবসানপ্রায়া! ওঠ, জাগাে ভারতবাসী, আর কতদিন মৃত্যুর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকিবে? ওঠ, জাগাে, জগৎ-সভা তােমারই প্রতীক্ষারত!'
এই আহ্বান কেহ শুনিল না। অগ্রদূতের অগ্রগতি অব্যাহতভাবে চলিতে লাগিল। স্বদেশের সীমা অতিক্রম করিয়া বিশ্বের দরবারে উপনীত নূতন বার্তাবহ বজ্রনির্ঘোষে বলিয়া উঠিলেন, ‘ওঠ, জাগাে, অমৃতের পুত্রগণ, কতদিন আর জড়ের উপাসনায় মুগ্ধ থাকিয়া মরণের বেদনায় জর্জরিত হইবে? ওঠ, জাগাে, ভাঙিয়া ফেল এই মােহ-শৃঙ্খল!
বিশ্ববাসী চমকিত, সচকিত হইল এই নূতন বাণীতে! ঝঞাসদৃশ এই বেদান্ত-প্রচারককে গুরুরূপে বরণ করিয়া তাহারা তাহাদের বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত জীবনাদর্শের পথে যাত্রা করিল, প্রাচ্য-প্রতীচ্যের এক মিলন-সেতু রচিত হইল।
এক উদার সর্বজনীন ধর্মের ভিত্তি স্থাপন করিয়া, গৌরবমহিমায় মণ্ডিত হইয়া যুগাচার্য বিবেকানন্দ দেশে ফিরিলেন; দেখিলেন চিকাগাে-ধর্মমহাসভার করতালির ধ্বনি-প্রধ্বনিতে বিরাট ‘লিভিয়াথান’-ভারত-জনতার সুপ্তির ঘাের একটু কাটিয়াছে; ঈষত্র জাগ্রত জনমন তাঁহার কথা শুনিতে চাহিতেছে। তিনিও বিগত সহস্র-বৎসরব্যাপী অবনতির কারণ বিশ্লেষণ করিয়া আগামী সহস্র বৎসরব্যাপী উপায়স্বরূপ সর্বাঙ্গীণ জাতীয়-জীবন-সংগঠনের একটি পরিপূর্ণ আদর্শ দেশবাসীর সমক্ষে স্থাপন করিলেন। এই বিরাট অভ্যুত্থানের সূচনামাত্র করিয়া, প্রবুদ্ধ ভারতের কর্মচক্রে গতিটুকুমাত্র যােজনা করিয়া তিনি চলিয়া গেলেন।
মধ্যাহ্ন ভাস্কর যেন সহসা অন্তর্হিত হইল বিস্ময়-বিহ্বল মানগ-মনে জিজ্ঞাসা জাগিল—কে এই স্বামী বিবেকানন্দ? কোথায় তাঁহার অফুরন্ত শক্তির উৎস?
********
১৮৬৩ খ্রীস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি কলিকাতার শিমলা-পল্লীতে নরেন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত উদারস্বভাব আইনজীবী ছিলেন, মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী জানিতেনকিভাবে মেহের সহিত শাসন মিশাইয়া সন্তানের জীবন গঠন করিতে হয়। অনেক সাধ্যসাধনার পর কাশীধামের বীরেশ্বর শিবের প্রসাদে পুত্র হয় বলিয়া তাহার নাম হইল বীরেশ্বর, সংক্ষেপে বিলে'!
বিলে কোন দিনই শান্তশিষ্ট সুবােধ বালকটি ছিল না, তাহার দুর্দান্ত অশান্ত ভাব কিছুতেই প্রশমিত করিতে না পারিলে জননী তাহাকে কলতলায় লইয়া গিয়া যেই ‘শিব, শিব’ বলিয়া মাথায় জল ঢালিতেন, অমনি সে মন্ত্রমুগ্ধ ভুজঙ্গের মতাে স্থির হইয়া যাইত ও জননীর মুখের পানে চাহিয়া থাকিত।
নির্বিচারে কোন কিছুই মানিয়া লওয়া বিলের স্বভাববিরুদ্ধ। একদিন তাহাকে পিতার মুসলমান মক্কেলপ্রদত্ত সন্দেশ খাইতে দেখিয়া মাতা তিরস্কার করিলে সে প্রশ্ন করিল, 'কেন, খেলে কি হয়?' মাতা বলিলেন, 'অন্য জাতের ছোঁয়া খেলে জাত যায়।'
পরে একদিন পিতা দেখেন, বিলে তাঁহার বৈঠকখানায় বিভিন্নজাতির জন্য রক্ষিত প্রত্যেকটি হকায় টান দিতেছে। পিতা সহাস্যে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ও কি করছিস রে?” পুত্র নিঃসঙ্কোচেবলিল, “দেখছি—কি করে জাত যায়। আনুপূর্বিক সব কথা শুনিয়া পিতা গম্ভীর হইয়া গেলেন; বুঝিলেন, বিলে সামান্য ছেলে নয়।
কলেজে পড়িবার সময় দর্শন ও ইতিহাসের প্রতিই নরেন্দ্রনাথের বিশেষ অনুরাগ; দর্শনের পাশ্চাত্য অধ্যাপক তাঁহার প্রতিভায় বিস্মিত! এভাবে ছাত্রজীবন কাটাইবার সময় নরেন্দ্র ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট হন—ভজন-সঙ্গীতেও তাঁহার খুব উৎসাহ। স্বভাব-সুকণ্ঠ নরেন্দ্রের সঙ্গীত সকলকে মুগ্ধ করিত।
শিমলা-পল্লীতে এক উৎসব-আয়ােজনে নরেন্দ্রের গান শুনিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবসমাধিতে মগ্ন হন, বিদায়কালে তাঁহাকে একবার দক্ষিণেশ্বরে যাইতে বলিয়া গেলেন।
পড়াশুনায় ও গানবাজনায় সে-কথা ভুলিয়া যান; কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁহার মনে সত্যানুসন্ধিৎসা, যথার্থ তত্ত্বজিজ্ঞাসা জাগ্রত হইল—ঈশ্বর-দর্শন-পিপাসা তাহাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিল। সাধক, দার্শনিক, ধর্মপ্রচারক—যাঁহাকে পান তাঁহাকেই জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কি ঈশ্বরকে দর্শন করিয়াছেন?” সর্বত্রই এক উত্তর পান—‘না’। অবশেষে একদিন দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসদেবের কাছে আসিয়া তাঁহাকেও তিনি ঐ চরম প্রশ্ন করিযা বসিলেন। ভয়ে মন দুরু দুরু করিতেছেঃ যদি ইনিও বলেন ‘না’, তবে কোথায় যাইব? স্মিত হাস্যে শ্রীরামকৃষ্ণ বলিলেন, হ্যাঁরে দেখেছি, এই তােকে যেমন দেখছি। তােকেও দেখাতে পারি, যদি আমার কথা শুনিস।
তারপর শুরু হইল গুরুশিষ্যের এক দিব্যলীলা, যাহার শেষে আমরা পাই নরেন্দ্রনাথের পূর্ণ বিকাশ স্বামী বিবেকানন্দে।
শ্রীরামকৃষ্ণ ও নরেন্দ্রনাথের এই মিলন একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বহুদিন ধরিয়া পৃথিবী ও মানবজাতি যেন ঐ শুভ মুহূর্তটির অপেক্ষা করিতেছিল। একজন প্রাচীন ভারতের তথা জগতের সর্ববিধ সাধনার মর্ম অবগত হইয়া, শান্ত পূর্ণ হইয়া সত্যের স্বরূপ-রূপে অবস্থান করিতেছেন—সেখানে সংশয়, জিজ্ঞাসা, বিচার বিবেচনা, সেখানে কর্মচঞ্চল প্রাণের প্রেরণা।
রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের যুগ্মসত্তায় এক সার্থক নবজাগরণের সূচনা অনুভূত হইতেছে। প্রাচীন ও নবীনের বিরােধ, ধর্ম ও বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব বিদূরিত হইয়া এক নূতন সভ্যতার পথ প্রস্তুত হইয়াছে। এই নূতন দৃষ্টির ভিত্তিস্বরূপ এই নবীভূত চিরপুরাতন ধর্মে আজ আর কর্ম আসিয়া ধ্যানের বিঘ্ন জন্মায় না, জ্ঞান-বিচারের উপলখণ্ড ভাবভক্তির স্রোতে বাধা সৃষ্টি না করিয়া উহাকে সামরসের কলধ্বনি-মুখরিত করিয়া তােলে। সকল ধর্মের সকল ভাবের বহু বিচিত্র ধারা এক মহাসমুদ্রে বিলীন হইতে ছুটিয়া চলিয়াছে।
অবিরােধের পথই সমন্বয়ের রাজপথ, এই পথেই অন্তরের জাগরণ ও অগ্রগতি। এই পথ ত্যাগ ও সেবার পত, প্রেম ও পবিত্রতার পথ, শক্তি ও সাতকতার পথ—এই অনন্ত বিস্তারের পথে, বিকাশের পথে, সর্বতােমুখী কল্যাণের পথে স্বামী বিবেকানন্দ আমাদের আহ্বান করিয়া গিয়াছেন এ-যুগের প্রথম প্রভাতী সঙ্গীতে!
স্বামী নিরাময়ানন্দ
0 Comments