আমেরিকান সংবাদপত্রের রিপোর্ট ~ পার্ট ১

 স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা 

দশম খণ্ড

আমেরিকান সংবাদপত্রের রিপোর্ট

======================

ভারতের ধর্ম ও রীতিনীতিসমূহ

ভারতের ধর্ম ও রীতিনীতিসমূহ

‘সেলেম ইভনিং নিউজ’, ২৯ অগষ্ট, ১৮৯৩

গতকল্য বিকালবেলায় আবহাওয়া খুব গরম থাকা সত্ত্বেও ‘থট্ অ্যাণ্ড ওয়ার্ক ক্লাব’-এর (‘চিন্তা ও কাজ সমিতি’) বেশ কিছু সভ্য-সভ্যা তাঁহাদের অতিথিগণসহ হিন্দুসন্ন্যাসী স্বামী বিবে কানোন্দের১ বক্তৃতা শুনিবার জন্য ওয়েসলি হলে জড়ো হইয়াছিলেন। এই ভদ্রলোক এখন এই দেশে ভ্রমণ করিতেছেন। বক্তৃতাটি ছিল একটি ঘরোয়া ভাষণ। প্রধান আলোচ্য বিষয়ঃ ‘হিন্দুগণের ধর্ম—তাঁহাদের ধর্মগ্রন্থ বেদে যেভাবে ব্যাখ্যাত।’ বক্তা জাতিপ্রথা সম্বন্ধেও বলিয়াছিলেন। তাঁহার মতে জাতি একটি সামাজিক বিভাগমাত্র, উহা ধর্মের উপর নির্ভর করে না।

বক্তা ভারতীয় জনগণের দারিদ্র্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র অপেক্ষা ভারতবর্ষের আয়তন অনেক ক্ষুদ্র হইলেও তথাকার জনসংখ্যা হইল ২৭ কোটি আর ইহাদের মধ্যে ৩ কোটি লোক গড়ে মাসে ৫০ সেণ্টেরও কম উপায় করে। দেশের কোন কোন অঞ্চলে লোককে মাসের পর মাস, এমন কি বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া একপ্রকার গাছের ফুল সিদ্ধ করিয়া খাইয়া জীবনধারণ করিতে হয়। কোথাও কোথাও পরিবারের জোয়ান মরদরাই খায় ভাত, স্ত্রীলোক ও শিশুগণকে ভাতের ফেন দিয়া ক্ষুন্নিবৃত্তি করিতে হয়। কোন বৎসর ধান না হইলে দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী। অর্ধেক লোক একবেলা খাইয়া বাঁচে, বাকী অর্ধেক একবার কোনমতে খাইতে পাইলে পরের বারে কোথায় খাবার জুটিবে, তাহা জানে না। স্বামী বিবে কিওন্দের মতে ভারতের অধিবাসিগণের প্রয়োজন অধিক ধর্ম বা উন্নততর কোন ধর্ম নয়, প্রয়োজন করিতকর্মা হওয়া। আমেরিকাবাসিগণকে ভারতের লক্ষ লক্ষ দুঃস্থ এবং অনশনক্লিষ্ট জনগণের সাহায্যে উন্মুখ করিবার আশাতেই তিনি এই দেশে আসিয়াছেন।

বক্তা একটু বিশদভাবেই তাঁহার স্বদেশবাসিগণের অবস্থা এবং ধর্ম সম্বন্ধে বলেন। তাঁহার ভাষণের সময় মাঝে মাঝে সেণ্ট্রাল ব্যাপটিষ্ট চার্চের ডক্টর এফ. এ. গার্ডনার ও রেভারেণ্ড এস. এফ. নব্‌স্‌ খুঁটিয়া খুঁটিয়া তাঁহাকে প্রশ্ন করেন। বক্তা উল্লেখ করেন, মিশনরীরা ভারতে অনেক দামী দামী কথা আওড়ান এবং শুরুতে অনেক হিতকর কল্পনাও তাঁহাদের ছিল, কিন্তু তাঁহারা কার্যক্ষেত্রে দেশের লোকের শ্রমশিল্প-সংক্রান্ত উন্নতির জন্য কিছুই করেন নাই। তাঁহার মতে আমেরিকানদের কর্তব্য—ভারতে ধর্মপ্রচারের জন্য মিশনরীদের না পাঠাইয়া শ্রমশিল্পের শিক্ষা দিতে পারেন, এমন লোক পাঠান।

দুর্দৈবের সময় খ্রীষ্টান মিশনরীদের কাছে লোকে সাহায্য পায় এবং মিশনরীরা হাতেনাতে শিক্ষাদানের স্কুলও যে খোলেন, ইহা সত্য কিনা, জিজ্ঞাসা করিলে বক্তা বলেন, কখনও কখনও তাঁহারা এরূপ করেন বটে, কিন্তু ইহাতে তাঁহাদের কোন কৃতিত্ব নাই, কেননা ঐরূপ সময় লোককে ধর্মান্তরিত করিবার চেষ্টা আইনতঃ নিষিদ্ধ বলিয়া ঐ চেষ্টা স্বভাবতই তাঁহাদিগকে বন্ধ রাখিতে হয়।

ভারতে স্ত্রীজাতির অনুন্নত অবস্থার কারণ—বক্তার মতে—হিন্দুদের নারীর প্রতি অত্যধিক সম্মান। নারীকে ঘরের বাহিরে যাইতে না দেওয়াই ঐ সম্মান রক্ষার অনুকূল মনে করা হইত। নারী সর্বসাধারণের সংস্পর্শ হইতে দূরে গৃহাভ্যন্তরে শ্রদ্ধা ও পূজা লাভ করিতেন। স্বামীর সহিত চিতায় সহমরণ-প্রথার ব্যাখ্যায় বক্তা বলেন, পত্নী পতিকে এত ভালবাসিতেন যে, তাঁহাকে ছাড়িয়া বাঁচিয়া থাকা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব ছিল। বিবাহে তাঁহারা এক হইয়াছিলেন, মৃত্যুতেও তাঁহাদের এক হওয়া চাই।

বক্তাকে প্রতিমাপূজা এবং জগন্নাথের রথের সম্মুখে স্বেচ্ছায় পড়িয়া মৃত্যুবরণ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলেন, রথের ঐ ব্যাপারে হিন্দুদিগকে দোষ দেওয়া উচিত নয়, কেননা উহা কতকগুলি ধর্মোন্মাদ এবং প্রধানতঃ কুষ্ঠরোগাক্রান্ত লোকের কাজ।

বক্তা স্বদেশে তাঁহার কর্মপদ্ধতির বিষয়ে বলেন, তিনি সন্ন্যাসীদের সঙ্ঘবদ্ধ করিয়া দেশের শিল্পবিজ্ঞান-শিক্ষণের কাজে লাগাইবেন, যাহাতে জনগণ প্রয়োজনীয় কার্যকরী শিক্ষালাভ করিয়া নিজেদের অবস্থার উন্নতি করিতে পারে।

আজ বিকালে বিবে কানোন্দ ১৬৬নং নর্থ ষ্ট্রীটে মিসেস উড্‌স-এর বাগানে ভারতবর্ষের শিশুদের সম্বন্ধে বলিবেন। যে-কোন বালক বালিকা বা তরুণরাও ইচ্ছা করিলে আসিতে পারেন। বিবে কানোন্দের চেহারা বেশ চমৎকার, রঙ কিছু ময়লা, কিন্তু প্রিয়দর্শন। কোমরে দড়ি দিয়া বাঁধা পীতাভ লাল রঙের একটি আলখাল্লা তিনি পরিয়াছিলেন। মাথায় হলুদ রঙের পাগড়ি। সন্ন্যাসী বলিয়া তাঁহার কোন জাতি নাই, সকলের সঙ্গেই তিনি পানাহার করিতে পারেন।
======================

‘ডেলি গেজেট ’, ২৯ অগষ্ট, ১৮৯৩

ভারতবর্ষ হইতে আগত রাজা২ স্বানী বিবি রানন্দ গতকল ওয়েস্‌লি চার্চে সেলেমের ‘থট্ অ্যাণ্ড ওয়ার্ক ক্লাব’-এর অতিথিরূপে বক্তৃতা দিয়াছেন। বহুসংখ্যক ভদ্রমহোদয় ও মহিলা উপস্থিত ছিলেন এবং সম্ভ্রান্ত সন্ন্যাসীর সহিত আমেরিকান রীতিতে করমর্দন করিয়াছিলেন। তাঁহার পরিধানে ছিল একটি কমলালেবু রঙের আলখাল্লা, উহার কটিবন্ধটি লাল। তিনি একটি পাগড়িও পরিয়াছিলেন। পাগড়ির প্রান্ত একদিকে ঝুলিয়া পড়িয়াছিল। উহা তিনি রুমালের কাজে লাগাইতেছিলেন। তাঁহার পায়ে ছিল কংগ্রেস জুতা।

বক্তা অনেকক্ষণ ধরিয়া তাঁহার দেশবাসীর ধর্ম ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিষয় বলেন। সেণ্ট্রাল ব্যাপটিষ্ট চার্চে ডক্টর এফ. এ. গার্ডনার এবং রেভারেণ্ড এস. এফ. নব্‌স্‌ বক্তাকে ঘন ঘন খুঁটিনাটি প্রশ্ন করেন। বক্তা বলেন, মিশনরীরা ভারতবর্ষে সুন্দর সুন্দর মতবাদ প্রচার করেন, গোড়াতে তাঁহাদের উদ্দেশ্যও ছিল ভাল, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেশের লোকের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তাঁহারা কিছুই করেন নাই। বক্তার মতে, আমেরিকানদের উচিত ধর্মপ্রচারের জন্য ভারতে মিশনরী না পাঠাইয়া ভারতবাসীকে শিল্পবিজ্ঞান শিখাইবার জন্য কাহাকেও পাঠান।

ভারতে স্ত্রী এবং পুরুষের সম্পর্ক সম্বন্ধে কিছুক্ষণ বলিবার সময় বক্তা বলেন, তাঁহার দেশে পতিরা পত্নীর কাছে কখনও মিথ্যা বলে না এবং পত্নীর উপর অত্যাচারও করে না। তিনি আরও অনেক দোষের উল্লেখ করেন, যাহা হইতে ভারতের পতিরা মুক্ত।

বক্তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, এ-কথা সত্য কিনা, দৈবদুর্বিপাকের সময় ভারতের জনগণ খ্রীষ্টান মিশনরীদের নিকট সাহায্য পাইয়া থাকে এবং কারিগরী শিক্ষার জন্য তাঁহারা স্কুলও চালান। উত্তরে বক্তা বলেন, কখনও কখনও মিশনরীরা এই ধরনের কাজ করেন বটে, তবে তাহাতে তাঁহাদের কোন কৃতিত্ব নাই, কেননা এরূপ সময়ে লোককে খ্রীষ্টধর্মে প্রভাবান্বিত করিবার চেষ্টা বাধ্য হইয়া তাঁহাদিগকে বন্ধ রাখিতে হয়, কারণ আইনতঃ উহা নিষিদ্ধ।

ভারতের নারীগণের দুর্দশার কারণ নির্ণয় করিতে গিয়া বক্তা বলেন, হিন্দুরা স্ত্রীজাতিকে এত শ্রদ্ধা করে যে, তাঁহাদিগকে তাহারা বাড়ীর বাহিরে আনিবার পক্ষপাতী নয়। গৃহাভ্যন্তরে থাকিয়া নারী পরিবারের সকলের সম্মান লাভ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীলোকের সহমৃতা হইবার প্রাচীন প্রথার ব্যাখ্যা-প্রসঙ্গে বক্তা বলেন, পতির উপর পত্নীর এত গভীর ভালবাসা থাকে যে, তাঁহাকে ছাড়িয়া জীবন-ধারণ করা পত্নীর পক্ষে অসম্ভব। একদিন উভয়ে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হইয়াছিলেন, মূত্যুর পরও সেই সংযোগ তাঁহাদের ছিন্ন হইবার নয়।

প্রতিমাপূজা সম্বন্ধে বক্তা বলেন, তিনি খ্রীষ্টানদের জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, উপাসনার সময় তাঁহারা কি চিন্তা করেন? কেহ কেহ বলিয়াছেন, তাঁহারা গীর্জার কথা ভাবেন, কেহ কেহ বা ঈশ্বরের চিন্তা করেন। বেশ কথা। তাঁহার দেশে লোকে ভগবানের মূর্তির কথা ভাবে। দরিদ্র জনগণের জন্য মূর্তিপূজা প্রয়োজন। বক্তা বলেন, প্রাচীনকালে ভারতীয় ধর্মের প্রথম অভ্যুদয়ের সময়ে নারীরা আধ্যাত্মিক প্রতিভা এবং মানসিক শক্তির জন্য প্রসিদ্ধা ছিলেন। তবে বক্তা স্বীকার করেন, আধুনিক কালে তাঁহাদের অবনতি ঘটিয়াছে। খাওয়া-পরা গল্প-গুজব এবং অপরের কুৎসা-প্রচার ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা তাঁহাদের নাই।

বক্তা স্বদেশে তাঁহার কর্মপ্রণালী সম্বন্ধে বলেন, একদল সন্ন্যাসীকে তিনি সঙ্ঘবদ্ধ করিয়া দেশে কারিগরী শিক্ষাপ্রচারের উপযোগী করিয়া তুলিবেন। ইহা দ্বারা জনগণের অবস্থার উন্নতি হইবে।

‘সেলেম ইভনিং নিউজ’, ১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩

যে পণ্ডিত সন্ন্যাসীটি এই শহরে কিছুদিন হইল আসিয়াছেন, তিনি রবিবার সন্ধ্যা ৭/৩০-এ ইষ্ট চার্চ-এ বক্তৃতা করিবেন। স্বামী (রেভারেণ্ড) বিবা কানন্দ গত রবিবার সন্ধ্যায় এনিস্কোয়াম শহরে এপিস্কোপাল গীর্জায় ভাষণ দিয়াছিলেন। ঐ গীর্জার পাদ্রী এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাইট তাঁহাকে তথায় আমন্ত্রণ করিয়া আনিয়াছিলেন। অধ্যাপক রাইট এই আগন্তুক সন্ন্যাসীকে খুব সমাদর করিতেছেন।

সোমবার রাত্রে ইনি সারাটোগায় যাইবেন এবং ওখানে সমাজবিদ্যা সমিতিতে বক্তৃতা দিবেন। পরে চিকাগোর আগামী ধর্মসম্মেলনে তাঁহার বক্তৃতা করিবার কথা। ভারতে যাঁহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত, তাঁহাদের মত বিবা কানন্দও প্রাঞ্জল এবং শুদ্ধ ইংরেজী বলিতে পারেন। গত শুক্রবার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে তিনি ভারতীয় শিশুদের খেলাধূলা, স্কুল এবং চালচলন সম্বন্ধে সরলভাবে যে মূল্যবান কথাবার্তা বলিয়াছিলেন, তাহা খুব চিত্তাকর্ষক হইয়াছিল। একটি ছোট মেয়ে যখন বলিতেছিল যে, তাহার শিক্ষিকা একবার তাহার আঙুল জোরে চুষিতে থাকায় আঙুলটি প্রায় ভাঙিবার উপক্রম হইয়াছিল, তখন বিবা কানন্দের দরদী হৃদয় বিচলিত হইয়া উঠয়াছিল। … স্বদেশে সকল সন্ন্যাসীর ন্যায় তাঁহাকেও সত্য, শুচিতা ও সৌভ্রাত্রের ধর্ম প্রচার করিয়া বেড়াইতে হয় বলিয়া মহৎ কল্যাণকর যাহা, তাহা তাহার দৃষ্টি এড়ায় না, আবার যদি কোথাও বিষম কোন অন্যায় ঘটে, তাহাও তাহার নজরে আসে। এই সন্ন্যাসী অন্য ধর্মাবলম্বীর প্রতি অত্যন্ত উদার, কাহারও সহিত মতে মিল না হইলেও তাঁহার সম্বন্ধে সদয় কথাই ইঁহার মুখ দিয়া বাহির হয়।

‘ডেলি গেজেট ’, ৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩

ভারত হইতে আগত রাজা স্বানী বিবি রানন্দ রবিবার সন্ধ্যায় ইষ্ট চার্চ-এ ভারতবর্ষের ধর্ম এবং দরিদ্র জনগণ সম্বন্ধে বক্তৃতা করিয়াছেন। যদিও বেশ কিছু শ্রোতৃ জড়ো হইয়াছিলেন, তবুও বিষয়টির গুরুত্ব এবং বক্তার আকর্ষণের বিবেচনায় আরও বেশী লোক হওয়া উচিত ছিল। সন্ন্যাসী তাঁহার দেশী পোষাক পরিয়াছিলেন এবং প্রায় চল্লিশ মিনিট বলিয়াছিলেন। তাঁহার মতে আজিকার ভারতবর্ষ পঞ্চাশ বৎসর আগেকার ভারত নয়। ভারতবর্ষে গিয়া এখন মিশনরীদের ধর্মপ্রচারের কোন প্রয়োজন নাই। গুরুতর প্রয়োজন এখন লোককে কারিগরী এবং সামাজিক শিক্ষাদান। ধর্ম বলিতে যাহা কিছু আবশ্যক, তাহা হিন্দুদের আছে। হিন্দুধর্ম পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম। সন্ন্যাসী খুব মধুরভাষী। শ্রোতৃমণ্ডলীর মনোযোগ তিনি বেশ ধরিয়া রাখিয়াছিলেন।

‘ডেলি সারাটোগিয়ান ’, ৬ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩

… বক্তৃতামঞ্চে তাহার পর আসিলেন হিন্দুস্থানের মান্দ্রাজ হইতে আগত সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ। ইনি ভারতের সর্বত্র প্রচার করিয়া বেড়ান। সমাজবিদ্যায় ইহার অনুরাগ আছে, এবং বক্তা হিসাবে ইনি বুদ্ধিমান্ চিত্তাকর্ষক। ভারতের মুসলমান রাজত্ব সম্বন্ধে ইনি বলিলেন।

অদ্যকার বক্তৃতাসূচীতে কয়েকটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় আছে, বিশেষতঃ হার্টফোর্ডের কর্ণেল জেকব গ্রীনের আলোচ্য ‘স্বর্ণ ও রৌপ্য—উভয় ধাতুর মুদ্রামান’। বিবে কানন্দ পুনরায় বক্তৃতা করিবেন। এইবার তাঁহার বিষয় হইবে—‘ভারতে রৌপ্যের ব্যবহার’।

======================

বিশ্বমেলায় হিন্দুগণ

‘বষ্টন ইভনিং ট্রান্‌স্‌ক্রিপ্ট’, ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩

চিকাগো, ২৩ সেপ্টেম্বরঃ

আর্ট প্যালেসের প্রবেশদ্বারের বামদিকে একটি ঘর আছে, যাহাতে একটি চিহ্ন ঝুলিতেছে—‘নং ১—প্রবেশ নিষেধ।’ এই ঘরে ধর্ম-মহাসম্মেলনের বক্তারা সকলেই মাঝে মাঝে, পরস্পরের সহিত অথবা সভাপতি মিঃ বনীর সহিত কথাবার্তা বলিতে আসিয়া থাকেন। মিঃ বনীর খাস দফতর এই গৃহেরই সংলগ্ন। ঘরের জোড়া কবাট সতর্ক পাহারা দ্বারা জনসাধারণ হইতে দূরে সংরক্ষিত, উঁকি দিয়া দেখিবার উপায় নাই। কেবলমাত্র মহাসভার প্রতিনিধিরাই এই ‘পুণ্য’ সীমানায় ঢুকিতে পারেন, তবে বিশেষ অনুমতি লইয়া ভিতরে প্রবেশ যে একেবারে অসম্ভব, তাহা নহে। কেহ কেহ ঐরূপ ঢুকেন এবং খ্যাতনামা অতিথিদের একটু নিকট সংস্পর্শ উপভোগ করেন। কলম্বাস হলে বক্তৃতা-মঞ্চের উপর যখন তাঁহারা বসিয়া থাকেন, তখন তো এই সুযোগ পাওয়া যায় না।

এই সাক্ষাৎকার-কক্ষে সমধিক আকর্ষণীয় ব্যক্তি হইলেন ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ। লম্বা মজবুত চেহারা, হিন্দুস্থানীদের বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গী, মুখ কামান, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন সুসমঞ্জস, দাঁতগুলি সাদা, সুচারু ওষ্ঠদ্বয় কথোপকথনের সময় স্নিগ্ধ হাসিতে একটু ফাঁক হইয়া যায়। তাঁহার সুঠাম মাথায় পীতাভ বা লালরঙের পাগড়ি থাকে। তিনি কখনও উজ্জ্বল কমলালেবু বর্ণের, কখনও বা গাঢ় লাল আলখাল্লা পরেন। আলখাল্লাটি কোমরবন্ধ দিয়া বাঁধা এবং হাঁটুর নীচে পড়ে। বিবেকানন্দ চমৎকার ইংরাজী বলেন এবং আন্তরিকতার সহিত জিজ্ঞাসা করিলে সানন্দে যে কোন প্রশ্নের উত্তর দেন।

তাঁর সহজ চালচলনের সহিত একটি ব্যক্তিগত গাম্ভীর্যের স্পর্শ পাওয়া যায়। বিশেষতঃ যখন তিনি মহিলাদের সহিত কথা বলেন, তখন বোঝা যায়, ইনি সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী। তাঁহার সম্প্রদায়ের নিয়ম সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলে তিনি বলিলেন, ‘আমি যাহা খুশী তাহা করিতে পারি, আমি স্বাধীন। কখনও আমি হিমালয় পর্বতে বাস করি, কখনও বা শহরের রাস্তায়। পরের বারের খাবার কোথায় জুটিবে, তাহা আমি জানি না। আমার কাছে কোন টাকা পয়সা থাকে না। চাঁদা তুলিয়া আমাকে এখানে পাঠান হইয়াছে।’ নিকটে দুই-একজন তাঁহার স্বদেশবাসী দাঁড়াইয়াছিলেন। তাঁহাদের দিকে তাকাইয়া বিবেকানন্দ বলিলেন, ‘এঁরা আমার ভার লইবেন।’ ইহা দ্বারা অনুমিত হয়, তাঁহার চিকাগোর খাইখরচ অপরে দিতেছে। যে পোষাক তিনি পরিয়াছিলেন, উহা তাঁহার স্বাভাবিক সন্ন্যাসীর পরিচ্ছদ কিনা জিজ্ঞাসা করিলে বিবেকানন্দ উত্তর দিলেন, ‘ইহা তো একটি উৎকৃষ্ট পোষাক। দেশে আমি সামান্য কাপড় ব্যবহার করি। জুতাও পরি না।’ জাতিভেদে তিনি বিশ্বাসী কিনা প্রশ্ন করিলে বলিলেন ,‘জাতি একটি সামাজিক প্রথা। ধর্মের সহিত ইহার কোন সম্পর্ক নাই। আমি সব জাতির লোকের সঙ্গে মেলামেশা করি।’

মিঃ বিবেকানন্দের চেহারা এবং চালচলন হইতে ইহা সুস্পষ্ট যে, তিনি অভিজাত বংশে জন্মিয়াছেন। বহু বৎসরের স্বেচ্ছাকৃত দারিদ্র্য এবং গৃহহীন পরিব্রজ্যা সত্ত্বেও তাঁহার জন্মগত আভিজাত্য অক্ষুণ্ণ রহিয়াছে। তাঁহার পারিবারিক নাম কেউ জানে না। ধর্মজীবন বরণ করিয়া তিনি তাঁহার ‘বিবেকানন্দ’ নাম গ্রহণ করিয়াছিলেন। ‘স্বামী’ কথাটি সন্ন্যাসীর প্রতি সম্মানসূচক প্রয়োগ। তাঁহার বয়স ত্রিশ হইতে খুব বেশী নয়। তাঁহাকে দেখিলে মনে হয়, তিনি যেন জীবনের পরিপূর্ণতা এবং পরজীবনের ধ্যানের জন্যই সৃষ্ট। তথাপি মনে অনিবার্য কৌতূহল জাগেঃ ইঁহার সংসার-বিমুখতার মূলে কি কারণ নিহিত ছিল?

সব কিছু ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসী হওয়া সম্বন্ধে একটি মন্তব্য শুনিয়া বিবেকানন্দ হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, ‘প্রত্যেক নারীর মধ্যে আমি যখন শুধু জগন্মাতাকেই দেখিতে পাই, তখন আমি বিবাহ করিব কেন? এইসব ত্যাগ করিয়াছি কেন? সাংসারিক বন্ধন এবং আসক্তি হইতে নিজেকে মুক্ত করিবার জন্য, যাহাতে আর পুনর্জন্ম না হয়। মৃত্যুকালে আমি দৈবী সত্তায় মিশিয়া যাইতে চাই, ভগবানের সহিত এক হইয়া যাইতে চাই। আমি তখন বুদ্ধত্ব লাভ করিব।’

এই কথা দ্বারা বিবেকানন্দ বলিতে চান না যে, তিনি বৌদ্ধ। কোন নাম বা সম্প্রদায় তাঁহাকে চিহ্নিত করিতে পারে না। তিনি উচ্চতর ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের সার্থক পরিণতিস্বরূপ, বিশাল স্বপ্নময় আত্মত্যাগপ্রধান হিন্দু সংস্কৃতির সুযোগ্য সন্তান, তিনি একজন যথার্থ সন্ন্যাসী, মহাপুরুষ।

বিবেকানন্দের কাছে তাঁহার গুরু পরমহংস রামকৃষ্ণ সম্বন্ধে কতকগুলি পুস্তিকা বিলি করিবার জন্য থাকে। রামকৃষ্ণ ছিলেন একজন হিন্দু সাধক। তাঁহার উপদেশে লোকে এত আকৃষ্ট হইত যে, অনেকে তাঁহার মৃত্যুর পর সংসারত্যাগ করিয়াছেন। মজুমদারও৩ এই মহাপুরুষকে গুরুর ন্যায় দেখিতেন। তবে মজুমদারের আদর্শ, যেমন যীশুখ্রীষ্ট শিক্ষা দিতেন, সংসারে অনাসক্তভাবে থাকিয়া পৃথিবীতে দেবভাব-প্রতিষ্ঠা।

ধর্ম-মহাসভায় বিবেকানন্দের ভাষণ আমাদের উপরকার আকাশের ন্যায় উদার। সকল ধর্মের যাহা কিছু শ্রেষ্ঠ, তাহা তিনি গ্রহণ করিয়াছেন। ইহাই হইবে ভবিষ্যতের সর্বজনীন ধর্ম। সকল মানুষের প্রতি সহানুভূতি আর শাস্তি ভয়ে বা পুরস্কারের লোভে নয়, ঈশ্বরের প্রীতির জন্য সৎকর্ম—ইহাও তাঁহার ভাষণের অন্যতম বক্তব্য। তাঁহার চমৎকার ভাবরাশি ও চেহারার জন্য তিনি ধর্ম-মহাসভায় অত্যন্ত সমাদৃত। মঞ্চের উপর দিয়া তাঁহাকে শুধু চলিয়া যাইতে দেখিলেও লোকে হর্ষধ্বনি করিয়া উঠে। হাজার হাজার মানুষের এই অভিবাদন তিনি বালকসুলভ সরলতার সহিত গ্রহণ করেন, তাহাতে আত্মশ্লাঘার লেশমাত্র নাই। এই বিনীত তরুণ ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসীর পক্ষে নিঃস্বতা ও আত্মবিলুপ্তি হইতে সহসা ঐশ্বর্য ও প্রখ্যাতিতে আবর্তন নিশ্চিতই একটি অভিনব অভিজ্ঞতা। যখন জিজ্ঞাসা করা হইল, থিওজফিষ্টরা হিমালয়ে ‘মহাত্মা’দের অবস্থান সম্বন্ধে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করেন, ঐ-বিষয়ে তিনি কিছু জানেন কিনা। বিবেকানন্দ শুধু বলিলেন, ‘আমি তাঁহাদের কাহাকেও কখনও দেখি নাই।’ ইহার তাৎপর্য এই যে, হিমালয়ে ঐরূপ মহাত্মা হয়তো আছেন, তবে হিমালয়ের সহিত যথেষ্ট পরিচয় থাকিলেও তাঁহার এখন ‘মহাত্মা’দের সহিত সাক্ষাৎ ঘটে নাই।
===========

ধর্ম-মহাসভায়

দি ডিউবুক, আইওয়া ‘টাইম্‌স্’, ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩

বিশ্বমেলা, ২৮ সেপ্টেম্বর (বিশেষ সংবাদ):

ধর্ম-মহাসভার অধিবেশনটিতে তীব্র বাগ্‌বিতণ্ডা দেখা দিয়াছিল। ভদ্রতার পাতলা আবরণ অবশ্য বজায় ছিল, কিন্তু উহার পিছনে বৈরভাব প্রকাশ পাইতেছিল। রেভারেণ্ড জোসেফ কুক হিন্দুদের কঠোর সমালোচনা করেন, হিন্দুরা তাঁহাকে তীব্রতরভাবে পাল্টা আক্রমণ করিলেন। রেভারেণ্ড কুক বলেন, বিশ্বসংসার অনাদি—এ-কথা বলা একপ্রকার অমার্জনীয় পাগলামি। প্রত্যুত্তরে এশিয়ার প্রতিনিধিগণ বলেন, কোন এক নির্দিষ্ট সময়ে সৃষ্ট জগতের অযৌক্তিকতা স্বতঃসিদ্ধ। ওহাইও নদীর তীর হইতে লম্বা-পাল্লার কামান দাগিয়া বিশপ জে. পি নিউম্যান গর্জন করিয়া ঘোষণা করিলেন, প্রাচ্য-দেশীয়েরা মিশনরীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা উক্তি দ্বারা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সমগ্র খ্রীষ্টান সমাজকে অপমানিত করিয়াছেন, আর প্রাচ্য প্রতিনিধিগণ তাঁহাদের শান্ত ও গর্বিত হাসি হাসিয়া উত্তর দিলেন, উহা শুধু বিশপের অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু নয়।
=========

বৌদ্ধ দর্শন

সোজাসুজি প্রশ্নের উত্তরে তিনজন সুপণ্ডিত বৌদ্ধ চমৎকার সরল ও মনোজ্ঞ ভাষায় ঈশ্বর, মানুষ এবং প্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁহাদের মুখ্য বিশ্বাস উপন্যস্ত করেন। (ইহার পরে ধর্মপালের ‘বুদ্ধের নিকট জগতের ঋণ’ সংজ্ঞক বক্তৃতাটির চুম্বক দেওয়া হইয়াছে। অন্য এক সূত্রে জানা যায়, ধর্মপাল ভাষণের আগে একটি সিংহলী স্বস্তিবাচন গাহিয়াছিলেন।) অতঃপর সাংবাদিক লিখিতেছেনঃ

ধর্মপালের বক্তৃতার উপসংহারভাগ এত সুন্দর হইয়াছিল যে, চিকাগোর শ্রোতৃমণ্ডলী পূর্বে ঐরূপ কখনও শুনেন নাই। বোধ করি ডিমসথেনীজও উহা ছাড়াইয়া যাইতে পারেন নাই।

=============

বদমেজাজী মন্তব্য

বদমেজাজী মন্তব্য

হিন্দু সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের ভাগ্য কিন্তু এত ভাল ছিল না। গোড়াতেই তাঁহার মেজাজ ঠিক ছিল না, অথবা কিছুক্ষণের মধ্যেই বাহ্যতঃ তাঁহার ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়াছিল। তিনি কমলালেবু রঙের আলখাল্লা পরিয়াছিলেন। মাথায় ছিল ফিকা হলুদ রঙের পাগড়ি। বক্তৃতা দিতে উঠিয়াই তিনি খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী জাতিদের ভীষণ আক্রমণ করিলেন ও বলিলেন, ‘আমরা যাঁহারা প্রাচ্য দেশ হইতে আসিয়াছি, এখানে বসিয়া দিনের পর দিন মাতব্বরী ভাষায় শুনিতেছি যে, আমাদিগের খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করা উচিত, কেননা খ্রীষ্টান জাতিসমূহ সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধিশালী। আমাদের চারিপাশে তাকাইয়া আমরা দেখিতে পাই যে, পৃথিবীতে খ্রীষ্টান দেশসমূহের মধ্যে ইংলণ্ড ২৫ কোটি এশিয়াবাসীর ঘাড়ে পা দিয়া বিত্তবিভব লাভ করিয়াছে। ইতিহাসের পাতা উল্টাইয়া আমরা দেখি, খ্রীষ্টান ইওরোপের সমৃদ্ধি শুরু হয় স্পেনে। আর স্পেনের ঐশ্বর্যলাভ মেক্সিকো আক্রমণের পর হইতে। খ্রীষ্টানরা সম্পত্তিশালী হয় মানুষ-ভাইদের গলা কাটিয়া। এই মূল্যে হিন্দুরা বড়লোক হইতে চায় না।’

(বক্তারা এই ভাবে আক্রমণ করিয়া চলিলেন। প্রত্যেক পরবর্তী বক্তা পূর্বগামী বক্তা অপেক্ষা যেন বেশী উত্তেজিত হইয়া উঠিতেছিলেন।)

‘আউটলুক ’, ৭ অক্টোবর, ১৮৯৩

… ভারতবর্ষের খ্রীষ্টান মিশনরীদের কাজ সম্বন্ধে আলোচনা উঠিলে বিবেকানন্দ তাঁহার ধর্মযাজকের উপযোগী উজ্জ্বল কমলালেবু রঙের পোষাকে জবাব দিবার জন্য দাঁড়াইয়া উঠেন। খ্রীষ্টীয় মিশনসমূহের কাজের তিনি তীব্র সমালোচনা করেন। ইহা সুস্পষ্ট যে, তিনি খ্রীষ্টধর্মকে বুঝিবার চেষ্টা করেন নাই; তবে তাঁহার এই উক্তিও সত্য যে, খ্রীষ্টান প্রচারকগণ হাজার হাজার বৎসরের বদ্ধমূল বিশ্বাস এবং জাতিসংস্কারযুক্ত হিন্দুধর্মকে বুঝিবার কোন প্রয়াস দেখান নাই। বিবেকানন্দের মতে—মিশনরীরা ভারতে গিয়া শুধু দুইটি কাজ করেন, যথা—দেশবাসীর পবিত্রতম বিশ্বাসসমূহের নিন্দা এবং জনগণের নীতি ও ধর্মবোধকে শিথিল করিয়া দেওয়া।

‘ক্রিটিক’, ৭ অক্টোবর, ১৮৯৩

ধর্ম-মহাসভার প্রতিনিধিগণের মধ্যে দুই ব্যক্তি ছিলেন সর্বাপেক্ষা চিত্তাকর্ষক—সিংহলের বৌদ্ধ ধর্মযাজক এইচ. ধর্মপাল এবং হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ। ধর্মপালের একটি ধারাল উক্তিঃ ‘যদি ধর্মসংক্রান্ত ব্যাখান ও মতবাদ তোমার সত্যানুসন্ধানের পথে বাধা সৃষ্টি করে, তাহা হইলে উহাদিগকে সরাইয়া রাখ। কোন পূর্ব ধারণার বশীভূত না হইয়া চিন্তা করিতে, ভালবাসার জন্যই মানুষকে ভালবাসিতে, নিজের বিশ্বাসসমূহ নির্ভীক ভাবে প্রকাশ করিতে এবং পবিত্র জীবন যাপন করিতে শেখ, সত্যের সূর্যালোক নিশ্চয়ই তোমাকে দীপ্ত করিবে।’

যদিও এই অধিবেশনের (ধর্ম-মহাসভার অন্তিম অধিবেশন) সংক্ষিপ্ত ভাষণসমূহের অনেকগুলিই খুব চমৎকার হইয়াছিল এবং শ্রোতৃবৃন্দের ভিতর প্রভূত উৎসাহ উদ্দীপিত করিয়াছিল, কিন্তু হিন্দু সন্ন্যাসীর ন্যায় অপর কেহই মহাসভার মূল আদর্শ, উহার কার্যগত ত্রুটি এবং উহার উৎকৃষ্ট প্রভাব সুন্দরভাবে প্রকাশ করিতে পারেন নাই। তাঁহার ভাষণটি এখানে সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হইতেছে। শ্রোতৃমণ্ডলীর উপর এই ভাষণের কি আশ্চর্য প্রভাব হইয়াছিল, তাহার শুধু ইঙ্গিত মাত্র আমি দিতে পারি। বিবেকানন্দ যেন দেবদত্ত বাগ্মিতার অধিকার লইয়া জন্মিয়াছেন। তাঁহার হলুদ ও কমলালেবু রঙের চিত্তাকর্ষী পোষাক এবং প্রতিভাদীপ্ত দৃঢ়তাব্যঞ্জক মুখচ্ছবি তাঁহার আন্তরিকতাপূর্ণ বাণী ও সুমিষ্ট সতেজ কণ্ঠস্বর অপেক্ষা কম আকর্ষণ বিস্তার করে নাই।

… স্বামীজীর ধর্ম-মহাসভার শেষ ভাষণটির অধিকাংশ উদ্ধৃত করিয়া সাংবাদিক মন্তব্য করিতেছেনঃ

বৈদেশিক মিশন সম্বন্ধে যে-সকল মনোবৃত্তি ধর্ম-মহাসম্মেলনে প্রকাশ পাইয়াছিল, উহাই বোধ হয় এই সম্মেলনের সর্বাপেক্ষা সুস্পষ্ট ফল। বিদ্যা ও জ্ঞানে গরিষ্ঠ প্রাচ্য পণ্ডিতগণকে শিক্ষা দিবার জন্য খ্রীষ্টীয় ধর্মমতের কতকগুলি অর্ধশিক্ষিত শিক্ষানবীশকে পাঠাইবার ধৃষ্টতা ইংরেজী-ভাষাভাষী শ্রোতৃবর্গের নিকট ইহার আগে এমন দৃঢ়ভাবে আর তুলিয়া ধরা হয় নাই। আমরা যদি হিন্দুদের ধর্ম সম্বন্ধে কিছু বলিতে চাই, তবে পরমতসহিষ্ণুতা এবং সহানুভূতির ভাব লইয়া উহা বলিতে হইবে। চরিত্রে এই দুইটি গুণ আছে, এমন সমালোচক খুব দুর্লভ। বৌদ্ধেরা যেমন আমাদের নিকট হইতে শিখিতে পারে, আমাদেরও যে বৌদ্ধদের নিকট হইতে অনেক শিখিবার আছে, ইহা আজ হৃদয়ঙ্গম করা প্রয়োজন। সামঞ্জস্যের মাধ্যমেই শ্রেষ্ঠ প্রভাব কার্যকর হয়।

লুসি মনরো

‘চিকাগো’, ৩ অক্টোবর, ১৮৯৩

‘নিউ ইর্য়ক ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকা ১ অক্টোবর, (১৮৯৩) ধর্ম-মহাসভার প্রত্যেক প্রতিনিধিকে একটি সংক্ষিপ্ত উক্তি দ্বারা ঐ মহতী সভার বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করিবার অনুরোধ করিলে স্বামীজী গীতা এবং ব্যাসের বচন হইতে নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিদ্বয় বলিয়াছিলেনঃ

‘মণিমালার মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট সূত্রের ন্যায় আমি প্রত্যেক ধর্মের মধ্যে আসিয়া উহাকে ধারণ করিয়া রহিয়াছি।’

‘প্রত্যেক ধর্মেই পবিত্র, সাধুপ্রকৃতি, পূর্ণতাসম্পন্ন মানুষ দৃষ্ট হয়। অতএব সব মতই মানুষকে একই সত্যে লইয়া যায়, কারণ বিষ হইতে অমৃতের উৎপত্তি কি সম্ভবপর?’

============

ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য

‘ক্রিটিক’, ৭ অক্টোবর, ১৮৯৩

ধর্ম-মহাসভার একটি পরিণাম এই যে, উহা একটি বিশেষ সত্যের প্রতি আমাদের চোখ খুলিয়া দিয়াছিল। ঐ সত্যটি হইল এইঃ প্রাচীন ধর্মমতসমূহের অন্তর্নিহিত দর্শনে বর্তমান মানুষের উপযোগী অনেক চমৎকার শিক্ষণীয় বিষয় রহিয়াছে। একবার যখন ইহা আমরা পরিষ্কাররূপে বুঝিতে পারিলাম, তখন ঐ-সকল ধর্ম-ব্যাখ্যাতাগণের প্রতি আমাদের ঔৎসুক্য বাড়িয়া চলিল এবং স্বভাবসুলভ অনুসন্ধিৎসা লইয়া আমরা তাঁহাদিগকে বুঝিতে তৎপর হইলাম। ধর্ম-মহাসভা শেষ হইলে উপযুক্ত সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করা সহজ হইয়াছিল সিউআমি বিবেকানন্দের বক্তৃতা এবং প্রসঙ্গগুলির মাধ্যমে। বিবেকানন্দ এখন এই শহরে (চিকাগো) রহিয়াছেন। তাঁহার এই দেশে আসিবার মূল উদ্দেশ্য ছিল—তাঁহার স্বদেশবাসী হিন্দুগণের মধ্যে নূতন নূতন শ্রমশিল্প আরম্ভ করিতে আমেরিকানগণকে প্ররোচিত করা। কিন্তু বর্তমানে সাময়িকভাবে তিনি ঐ পরিকল্পনা ত্যাগ করিয়াছেন, কেননা তিনি দেখিতেছেন, আমেরিকান জাতি পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা বদান্য বলিয়া এই দেশে বহু লোক নানা উদ্দেশ্যে সাহায্যের জন্য আসিতেছে। আমেরিকায় এবং ভারতে দরিদ্রদের আপেক্ষিক অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করিলে বিবেকানন্দ জবাব দিলেন, আমেরিকায় যাহাদিগকে গরীব বলা হয়, তাহারা ভারতে গেলে রাজার হালে থাকিতে পারিবে। তিনি চিকাগোর নিকৃষ্ট পাড়া ঘুরিয়া দেখিয়াছেন। তাহাতে তাঁহার উক্ত সিদ্ধান্তই পাকা হইয়াছে। আমেরিকার অর্থনৈতিক মান দেখিয়া তিনি খুশী।

যদিও বিবেকানন্দ উচ্চ ব্রাহ্মণকুলে জন্মিয়াছিলেন, তথাপি সন্ন্যাসিসঙ্ঘে যোগদান করিবার জন্য তিনি কুলমর্যাদা ত্যাগ করিয়াছেন। সন্ন্যাসীকে স্বেচ্ছায় জাতির সব অভিমান বিসর্জন দিতে হয়। বিবেকানন্দের আকৃতিতে তাঁহার আভিজাত্য সুচিহ্নিত। তাঁহার মার্জিত রুচি, বাগ্মিতা এবং মনোমুগ্ধকর ব্যক্তিত্ব আমাদিগকে হিন্দু সংস্কৃতি সম্বন্ধে নূতন ধারণা দিয়াছে। তাঁহার প্রতি লোকে স্বতই একটি আকর্ষণ অনুভব করে। তাঁহার মুখশ্রীতে এমন একটি কমনীয়তা, বুদ্ধিমত্তা ও জীবন্তভাব আছে যে, উহা তাঁহার গৈরিক পোষাক এবং গভীর সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরের সহিত মিলিয়া মানুষের মনকে অবিলম্বে তাঁহার প্রতি অনুকূল করে। এই জন্য ইহা মোটেই আশ্চর্য নয় যে, অনেক সাহিত্য-সভা তাঁহাকে বক্তৃতার জন্য আহ্বান করিয়াছে এবং বহু গীর্জাতেও তিনি ধর্মালোচনা করিয়াছেন। ইহার ফলে বুদ্ধের জীবন এবং বিবেকানন্দের ধর্মমত আমাদের নিকট সুপরিচিত হইয়া উঠিয়াছে। তিনি কোন স্মারকলিপি ছাড়াই বক্তৃতা দেন, তথ্য এবং সিদ্ধান্ত এমন নিপুণভাবে ন্যস্ত করেন যে, তাঁহার আন্তরিকতায় দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে। তাঁহার বলিবার উদ্দীপনা মাঝে মাঝে এত বাড়িয়া যায় যে, শ্রোতারা মাতিয়া উঠে। বিবেকানন্দ একজন যোগ্যতম জেসুইট ধর্মযাজকের মতই পণ্ডিত ও সংস্কৃতিমান্। তাঁহার মনের গঠনেও জেসুইটদের খানিকটা ধাঁচ যেন আছে। তাঁহার কথোপকথনে ছোট ছোট ব্যঙ্গোক্তিগুলি ছুরির মত ধারাল হইলেও এত সূক্ষ্ম যে, তাঁহার অনেক শ্রোতাই উহা ধরিতে পারে না। তথাপি তাঁহার সৌজন্যের কখনও অভাব হয় না। তিনি আমাদের রীতিনীতির এমন কোন সাক্ষাৎ সমালোচনা কখনও করেন না, যাহাতে উহা কটু শোনায়। বর্তমানে তিনি আমাদিগকে তাঁহার বৈদান্তিক ধর্ম ও দার্শনিকগণের বাণী সম্বন্ধে শিক্ষা দিতেছেন। বিবেকানন্দের মতে অজ্ঞান জনগণের জন্য মূর্তিপূজার প্রয়োজন রহিয়াছে; তবে তিনি আশা করেন, এমন সময় আসিবে যখন আমরা সাকার উপাসনা এবং পূজা অতিক্রম করিয়া বিশ্বপ্রকৃতিতে ভগবানের সত্তা অনুভব করিব, মানুষের মধ্যে দেবত্বের উপলব্ধি করিতে পারিব। বুদ্ধ দেহত্যগ করিবার আগে যেমন বলিয়াছিলেন, বিবেকানন্দও সেইরূপ বলেন—‘তোমার নিজের মুক্তি তুমি নিজেই সম্পাদন কর। আমি তোমাকে কোন সাহায্য করিতে পারি না। কেহই পারে না। নিজেই নিজেকে সাহায্য কর।’

লুসি মনরো

======

পুনর্জন্ম

‘ইভানষ্টন ইনডেক্স’, ৭ অক্টোবর, ১৮৯৩

গত সপ্তাহে কংগ্রীগেশনাল চার্চ-এ অনেকটা সম্প্রতি-সমাপ্ত ধর্ম-মহাসভার ন্যায় একটি বক্তৃতামালার অনুষ্ঠান হইয়াছিল। বক্তা ছিলেন দুইজনঃ সুইডেনের ডক্টর কার্ল ভন বারগেন এবং হিন্দু সন্ন্যাসী সিউআমি বিবেকানন্দ। … সিউআমি বিবেকানন্দ ছিলেন ধর্ম-মহাসভায় একজন ভারতীয় প্রতিনিধি। তিনি তাঁহার অপূর্ব কমলালেবু রঙের পোষাক, ওজস্বী ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ বাগ্মিতা এবং হিন্দুদর্শনের আশ্চর্য ব্যাখ্যার জন্য বহু লোকের মনোযোগ আকর্ষণ করিয়াছেন। তাঁহার চিকাগোতে অবস্থান তাঁহার প্রতি অবিচ্ছিন্ন উৎসাহ ও সাধুবাদের হেতু হইয়াছে। বক্তৃতাগুলি তিনটি সন্ধ্যায় আয়োজিত হইয়াছিল।

শনিবার এবং মঙ্গলবার সন্ধ্যার আলোচ্য বিষয়গুলির তালিকা দিয়া সাংবাদিক বলিতেছেনঃ

বৃহস্পতিবার ৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় ডক্টর ভন বারগেনের আলোচ্য বিষয় ছিল—‘সুইডেনের রাজকন্যা’-বংশের প্রতিষ্ঠাতা ‘হালডাইন বীমিশ’। হিন্দু সন্ন্যাসী বলেন ‘পুনর্জন্ম’ সম্বন্ধে। শেষের বক্তৃতাটি বেশ চিত্তাকর্ষক হইয়াছিল, কেননা এই বিষয়টির আলোচ্য মতসমূহ পৃথিবীর এই অঞ্চলে বিশেষ শোনা যায় না। ‘আত্মার জন্মান্তর-গ্রহণ’ তত্ত্বটি এই দেশে অপেক্ষাকৃত নূতন এবং খুব কম লোকেই উহা বুঝিতে পারে; কিন্তু প্রাচ্যে উহা সুপরিচিত এবং ওখানে উহা প্রায় সকল ধর্মের বনিয়াদ। যাঁহারা মতবাদরূপে ইহার ব্যবহার করেন না, তাঁহারাও ইহার বিরুদ্ধে কিছু বলেন না। পুনর্জন্মতত্ত্বের মীমাংসার প্রধান বিষয় হইল—আমাদের অতীত বলিয়া কিছু আছে কিনা। বর্তমান জীবন আমাদের একটি আছে, তাহা আমরা জানি। ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও একটা স্থির অনুভব আমাদের থাকে। তথাপি অতীতকে স্বীকার না করিয়া বর্তমানের অস্তিত্ব কিরূপে সম্ভব? বর্তমান বিজ্ঞান প্রমাণ করিয়াছে যে, জড়ের কখনও বিনাশ নাই, অবিচ্ছিন্ন উহার অস্তিত্ব। সৃষ্টি শুধু আকৃতির পরিবর্তন মাত্র। আমরা শূন্য হইতে আসি নাই। কেহ কেহ সব কিছুর সাধারণ কারণরূপে ঈশ্বরকে স্বীকার করেন। তাঁহারা মনে করেন, এই স্বীকার দ্বারাই সৃষ্টির পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা হইল। কিন্তু প্রত্যেক ব্যাপারেই আমাদিগকে ঘটনাগুলি বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে—কোথা হইতে এবং কিভাবে বস্তুর উৎপত্তি ঘটে। যে-সব যুক্তি দিয়া ভবিষ্যৎ অবস্থান প্রমাণ করা হয়, সেই যুক্তিগুলিই অতীত অস্তিত্বকে প্রমাণ করে। ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়াও অন্য কারণ স্বীকার করা প্রয়োজন। বংশগতির দ্বারা ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়। কেহ কেহ বলেন, ‘কই, আমরা পূর্বেকার জন্ম তো স্মরণ করিতে পারি না।’ কিন্তু এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া গিয়াছে, যেখানে পূর্বজন্মের স্পষ্ট স্মৃতি বিদ্যমান। এখানেই জন্মান্তরবাদের বীজ নিহিত। সেহেতু হিন্দুরা মূকপ্রাণীর প্রতি দয়ালু, সেইজন্যই অনেকে মনে করেন, হিন্দুরা নিকৃষ্ট যোনিতে জন্মান্তরে বিশ্বাসী। ইঁহারা নিম্ন প্রাণীর প্রতি দয়াকে কুসংস্কার ছাড়া অন্য কিছু মনে করিতে পারেন না। জনৈক প্রাচীন হিন্দু ঋষি ধর্মের সংজ্ঞা দিয়াছেনঃ যাহাই মানুষকে উন্নত করে, তাহার নাম ধর্ম। পশুত্বকে দূর করিতে হইবে, মানবত্বকে দেবত্বে লইয়া যাইতে হইবে। জন্মান্তরবাদ মানুষকে এই ক্ষুদ্র পৃথিবীতে সীমাবদ্ধ করিয়া রাখে না। মানুষের আত্মা অন্য উচ্চতর লোকে গিয়া মহত্তর জীবন লাভ করিতে পারে। পাঁচ ইন্দ্রিয়ের স্থলে সেখানে তাহার আটটি ইন্দ্রিয় থাকিতে পারে। এইভাবে উচ্চতর ক্রমবিকাশ লাভ করিয়া অবশেষে সে পূর্ণতার পরাকাষ্ঠা—অমৃতত্ব লাভ করিবে। মহাজনদের লোকসমূহে তখন সে নির্বাণের গভীর আনন্দ উপলব্ধি করিতে থাকিবে।

=========

হিন্দুসভ্যতা

[যদিও ষ্টিয়াটর শহরে ৯ অক্টোবর তারিখে প্রদত্ত স্বামীজীর বক্তৃতায় প্রচুর লোক সমাগম হইয়াছিল। ‘ষ্টিয়াটর ডেইলি ফ্রী প্রেস’ (৯ অক্টোবর) শুধু নিম্নের নীরস বিবরণটুকু পরিবেশন করিয়াছেন।]

অপেরা হাউসে শনিবার রাত্রে এই খ্যাতিমান্ হিন্দুর বক্তৃতা খুব চিত্তাকর্ষক হইয়াছিল। তুলনামূলক ভাষাবিদ্যার সাহায্যে তিনি আর্যজাতিসমূহ এবং নূতন গোলার্ধে তাঁহাদের বংশধরদিগের মধ্যে বহুপূর্বে স্বীকৃত সম্বন্ধ প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। ভারতবর্ষের ত্রি-চতুর্থ জনগণ যাহা দ্বারা অত্যন্ত হীনভাবে নিপীড়িত, সেই জাতিভেদ-প্রথার তিনি মৃদু সমর্থন করিলেন, আর গর্বের সহিত ইহাও বলিলেন যে, যে-ভারতবর্ষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া পৃথিবীর ক্ষমতাদৃপ্ত জাতিসমূহের উত্থান এবং পতন দেখিয়াছে, সেই ভারতবর্ষই এখন বাঁচিয়া আছে। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁহার দেশবাসীর ন্যায় অতীতকে ভালবাসেন। তাঁহার জীবন নিজের জন্য নয়, ঈশ্বরের জন্য উৎসর্গীকৃত। তাঁহার স্বদেশে ভিক্ষাবৃত্তি এবং পদব্রজে ভ্রমণকে খুব উৎসাহিত করা হয়, তবে তিনি তাঁহার বক্তৃতায় সে-কথা বিশেষ উল্লেখ করেন নাই। ভারতীয় গৃহে রান্না হইবার পর প্রথম খাইতে দেওয়া হয় কোন অতিথিকে। তারপর গৃহপালিত পশু, চাকর-বাকর এবং গৃহস্বামীকে খাওয়াইয়া বাড়ীর মেয়েরা অন্ন গ্রহণ করেন। দশবৎসর বয়সে ছেলেরা গুরুগৃহে যায়। গুরু দশ হইতে বিশ বৎসর পর্যন্ত তাহাদিগকে শিক্ষাদান করেন। তারপর তাহারা বাড়ীতে ফিরিয়া পারিবারিক পেশা অবলম্বন করে, অথবা পরিব্রাজক সন্ন্যাসী হয়। সে ক্ষেত্রে তাহাদের জীবন অনবরত ভ্রমণ, ভগবৎ-সাধনা এবং ধর্মপ্রচারে কাটে। যে অশন-বসন লোকে স্বেচ্ছায় তাহাদিগকে দেয়, তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকিতে হয়, তাহারা টাকাকড়ি কখনও স্পর্শ করে না। বিবেকানন্দ এই শেষোক্ত শ্রেণীর। বৃদ্ধ বয়সে লোকে সংসার ত্যাগ করে এবং কিছুকাল শাস্ত্রপাঠ এবং তপস্যা করিয়া যদি আত্মশুদ্ধি অনুভব করে, তখন তাহারাও ধর্মপ্রচারে লাগিয়া যায়। বক্তা বলেন যে, মানসিক উন্নতির জন্য অবসর প্রয়োজন। এদেশের আদিবাসীদের—যাহাদিগকে কলাম্বাস বর্বর অবস্থায় দেখিয়াছিলেন—তাহাদিগকে সুশিক্ষা না দিবার জন্য তিনি আমেরিকান জাতির সমালোচনা করেন। এই বিষয়ে প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে তিনি তাঁহার অজ্ঞতার পরিচয় দিয়াছেন। তাঁহার বক্তৃতা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। তিনি যাহা বলিয়াছেন, তাহার তুলনায় অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুক্ত রাখিয়াছেন।

=================

একটি চিত্তাকর্ষক বক্তৃতা

একটি চিত্তাকর্ষক বক্তৃতা

উইসকনসিন ষ্টেট জার্নাল’ ২১ নভেম্বর, ১৮৯৩

সুপ্রসিদ্ধ হিন্দু সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ ম্যাডিসন শহরের কংগ্রীগেশনাল চার্চ-এ গতরাত্রে যে বক্তৃতা দিয়াছেন, তাহা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক হইয়াছিল। উহা গভীর দার্শনিক চিন্তা এবং মনোজ্ঞ ধর্মভাবের ব্যঞ্জক। যদিও বক্তা একজন পৌত্তলিক, তবুও তাঁহার উপদেশাবলীর অনেকগুলি খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীরা অনায়াসে অনুসরণ করিতে পারেন। তাঁহার ধর্মমত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মত উদার। সব ধর্মকেই তিনি মানেন। যেখানেই সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়, সেখান হইতেই তিনি উহা গ্রহণ করিতে উন্মুখ। তিনি ঘোষণা করিলেন, ভারতীয় ধর্মসমূহের গোঁড়ামি, কুসংস্কার এবং অলস ক্রিয়াকাণ্ডের কোন স্থান নাই।

=======

হিন্দুধর্ম

‘মিনিয়াপলিস্ ষ্টার’ ২৫ নভেম্বর ১৮৯৩

গতকল্য সন্ধ্যায় ফার্ষ্ট ইউনিটেরিয়ান চার্চ-এ (মিনিয়াপলিস্‌‌ শহরে) স্বামী বিবে কানন্দ হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে ব্যাখান দিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণ্যধর্ম চিরন্তন সত্যসমূহের মূর্ত প্রকাশ; সেইজন্য উহা স্বকীয় যাবতীয় সূক্ষ্ম ভাবরাশি দ্বারা সমাগত শ্রোতৃবৃন্দকে বিশেষভাবে অভিনিবিষ্ট করিয়াছিল। শ্রোতাদের মধ্যে অনেক চিন্তাশীল নরনারী ছিলেন, কেননা বক্তাকে আমন্ত্রণ করিয়াছিলেন ‘পেরিপ্যাটেটিকস্’ নামক দার্শনিক সমিতি। নানা খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মযাজক, বহু পণ্ডিত ব্যক্তি এবং ছাত্রেরাও সভায় উপস্থিত ছিলেন। বিবে কানন্দ একজন ব্রাহ্মণ ধর্মযাজক। তিনি তাঁহার দেশীয় পোষাকে আসিয়াছিলেন—মাথায় পাগড়ি, কোমরে লাল কটিবন্ধ দিয়া বাঁধা গৈরিক আলখাল্লা এবং অধোদেশেও লাল পরিচ্ছদ।

তিনি তাঁহার ধর্মের শিক্ষাগুলি অত্যন্ত আন্তরিকতার সহিত ধীর এবং স্পষ্টভাবে উপস্থাপিত করিতেছিলেন, ত্বরিত বাগ্‌‍বিলাস অপেক্ষা শান্ত বাচনভঙ্গী দ্বারাই যেন তিনি শ্রোতৃমণ্ডলীর মনে দৃঢ় প্রত্যয় লইয়া আসিতেছিলেন। তাঁহার কথাগুলি খুব সাবধানে প্রযুক্ত। উহাদের অর্থও বেশ পরিষ্কার। হিন্দুধর্মের সরলতর সত্যগুলি তিনি তুলিয়া ধরিতেছিলেন। খ্রীষ্টধর্ম সম্বন্ধে তিনি কোন কটূক্তি না করিলেও এমনভাবে উহার প্রসঙ্গ করিতেছিলেন, যাহাতে ব্রাহ্মণ্যধর্মকেই পুরোভাগে রাখা হইতেছিল। হিন্দুধর্মের সর্বাবগাহী চিন্তা এবং মুখ্য ভাব হইল মানবাত্মার স্বাভাবিক দেবত্ব। আত্মা পূর্ণস্বরূপ, ধর্মের লক্ষ্য হইল মানুষের এই সহজাত পূর্ণতাকে বিকাশ করা। বর্তমান শুধু অতীত এবং ভবিষ্যতের মধ্যবর্তী সীমারেখা। মানুষের ভিতর ভাল এবং মন্দ দুই প্রবৃত্তিই রহিয়াছে। সৎ সংস্কার বলবান্ হইলে মানুষ ঊর্ধ্বতর গতি লাভ করে অসৎ সংস্কারের প্রাধান্যে সে নিম্নগামী হয়। এই দুইটি শক্তি অনবরত তাহার মধ্যে ক্রিয়া করিতেছে। ধর্ম মানুষকে উন্নত করে, আর অধর্ম ঘটায় তাহার অধঃপতন।

কানন্দ আগামীকল্য সকালে ফার্ষ্ট ইউনিটেরিয়ান চার্চ-এ বক্তৃতা করিবেন।

‘ডে ময়েন নিউজ’, ২৮ নভেম্বর , ১৮৯৩

সুদূর ভারতবর্ষ হইতে আগত মনীষী পণ্ডিত স্বামী বিবেকানন্দ গত রাত্রে সেণ্ট্রাল চার্চ-এ বক্তৃতা দিয়াছিলেন। চিকাগোর বিশ্বমেলা উপলক্ষে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ধর্ম-মহাসভায় তিনি তাঁহার দেশের ও ধর্মের প্রতিনিধিরূপে আসিয়াছিলেন। রেভারেণ্ড এইচ. ও. ব্রীডেন বক্তাকে শ্রোতৃমণ্ডলীর নিকট পরিচিত করিয়া দেন। বক্তা উঠিয়া সমবেত সকলকে মাথা নীচু করিয়া অভিবাদনের পর তাঁহার ভাষণ আরম্ভ করেন। বিষয় ছিল—হিন্দুধর্ম। তাঁহার বক্তৃতা একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁহার নিজের ধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মমত সম্পর্কে তিনি যে-সব দার্শনিক ধারণা পোষণ করেন, তাহার কিছু কিছু পরিচয় ঐ বক্তৃতাতেই পাওয়া গিয়াছিল। তাঁহার মতে শ্রেষ্ঠ খ্রীষ্টান হইতে গেলে সকল ধর্মের সহিত পরিচয় অত্যাবশ্যক। এক ধর্মে যাহা নাই, অপর ধর্ম হইতে তাহা লওয়া যায়। ইহাতে কোন ক্ষতি নাই। প্রকৃত খ্রীষ্টানের পক্ষে ইহা প্রয়োজনীয়। বিবেকানন্দ বলেন, ‘তোমরা যখন আমাদের দেশে কোন মিশনরীকে পাঠাও, তিনি ‘হিন্দু খ্রীষ্টানে’ পরিণত হন, পক্ষান্তরে আমি তোমাদের দেশে আসিয়া ‘খ্রীষ্টান হিন্দু’ হইয়াছি।’ আমাকে এই দেশে অনেক সময় জিজ্ঞাসা করা হইয়াছে, আমি এখানে লোককে ধর্মান্তরিত করিবার চেষ্টা করিব কিনা। এই প্রশ্ন আমি অপমানজনক বলিয়া মনে করি। আমি ধর্ম পরিবর্তনে বিশ্বাস করি না। আজ কোন ব্যক্তি পাপকার্যে রত আছে, তোমাদের ধারণা—কাল যদি সে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়, তাহা হইলে ধীরে ধীরে সে সাধুত্ব লাভ করিবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠে, এই পরিবর্তন কোথা হইতে আসে? ইহার ব্যাখ্যা কি? ঐ ব্যক্তির তো নূতন একটি আত্মা হয় নাই, কেননা পূর্বের আত্মা মরিলে তবে তো নূতন আত্মার আবির্ভাবের কথা। বলিতে পার, ভগ‍বান্ তাহার ভিতর পরিবর্তন আনিয়াছেন। ভাল, কিন্তু ভগবান্ তো পূর্ণ, সর্বশক্তিমান্ এবং পবিত্রতার স্বরূপ। তাহা হইলে প্রসঙ্গোক্ত ব্যক্তির খ্রীষ্টান হইবার পর ভগবান্ পূর্বের সেই ভগবানই থাকেন, কেবল যে পরিমাণ সাধুতা তিনি ঐ ব্যক্তিকে দিয়াছিলেন, উহা তাঁহাতে ঘাটতি পড়িবে।

আমাদের দেশে দুটি শব্দ আছে যাহার অর্থ এদেশে সম্পূর্ণ আলাদা। শব্দ দুটি হইল ‘ধর্ম’ এবং ‘সম্প্রদায়’। আমাদের ধারণায় ধর্ম হইল সেই সার্বজনীন সত্য, যাহা সকল ধর্মমতের মধ্যেই অনুস্যূত। আমরা পরমত-অসহিষ্ণুতা ছাড়া আর সব কিছুই সহ্য করি। অপর শব্দটি—‘সম্প্রদায়’, তাহার অর্থ একটি সমমতসমর্থক সখ্যবদ্ধ ব্যক্তির দল, যাঁহারা নিজদিগকে ধার্মিকতার আবরণে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়াইয়া বলিতে থাকেন, ‘আমাদের মতই ঠিক, তোমরা ভুলপথে চলিতেছ।’ ইঁহাদের প্রসঙ্গে আমার দুই ব্যাঙের গল্পটি মনে পড়িল।

কোন কুয়ায় একটি ব্যাঙের জন্ম হয়, বেচারা সারাজীবন ওখানেই কাটাইতে থাকে। একদিন সমুদ্রের এক ব্যাঙ ঐ কুয়ায় পড়িয়া যায়। দুইজনের গল্প শুরু হইল সমুদ্র লইয়া। কূপমণ্ডূক ঐ আগন্তুককে জিজ্ঞাসা করিল, ‘সমুদ্র কত বড়?’ সাদাসিধা কোন উত্তর না পাইয়া সে তখন কুয়ার এক কোণ হইতে আর এক কোণে লাফ দিয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘সাগর অত বড় কিনা।’ আগন্তুক বলিল, ‘তা তো বটেই।’ তখন কুয়ার ব্যাঙ আরও একটু বেশী দূর লাফাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা, তবে এত বড় কি?’ সাগরের ব্যাঙ তখন উত্তর দিল ‘হ্যাঁ’, তখন কূপমণ্ডুক মনে মনে বলিল—‘এই ব্যাঙটি নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী। আমি ওকে আমার কুয়ায় স্থান দিব না।’ সম্প্রদায়গুলিরও এই একই অবস্থা। তাহাদের নিজেদের মত যাহারা বিশ্বাস করে না, তাহাদিগকে তাহারা দূর করিয়া দিতে এবং পদদলিত করিতে চায়।৪

==========

হিন্দু সন্ন্যাসী

‘অ্যাপীল–অ্যাভাল্যাঞ্চ’, ১৬ জানুআরী ১৮৯৪

স্বামী বিবে কানন্দ নামে যে হিন্দু সন্ন্যাসী আজ রাত্রে এখানকার (মেমফিস্ শহরের) বক্তৃতাগৃহে ভাষণ দিবেন, তিনি এদেশে অদ্যাবধি ধর্মসভায় বা বক্তৃতামঞ্চে উপস্থিত শ্রেষ্ঠ বক্তাদের অন্যতম। তাঁহার অতুলনীয় বাগ্মিতা, অতীন্দ্রিয় বিষয়ে গভীর উপলব্ধি, তর্কপটুতা এবং উদার আন্তরিকতা বিশ্ব-ধর্মসম্মেলনের বিশিষ্ট চিন্তানায়কদের প্রখর মনোযোগ এবং সহস্র সহস্র নরনারীর প্রশংসা আকর্ষণ করিয়াছিল।

তারপর হইতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজ্যে তিনি বক্তৃতা-সফর করিয়াছেন এবং লোকে তাঁহার কথা শুনিয়া মুগ্ধ হইয়াছে।

বিবে কানন্দ কথোপকথনে অতিশয় অমায়িক ভদ্রলোক। ভাষায় তিনি যে-সকল শব্দ ব্যবহার করেন, তাহা ইংরেজী ভাষার রত্নবিশেষ। তাঁহার চালচলন অত্যন্ত সুসংস্কৃত পাশ্চাত্য শিষ্টাচার ও রীতিনীতির সমকক্ষ। মানুষ হিসাবে তাঁহার সাহচর্য বড়ই হৃদয়গ্রাহী এবং কথাবার্তায় পাশ্চাত্য জগতের যে-কোন শহরের বৈঠকখানায় তিনি বোধ করি অপরাজেয়। তিনি শুধু প্রাঞ্জলভাবে নয় অনর্গলভাবেও ইংরেজী বলিয়া যান, আর তাঁহার অভিনব দীপ্তিমান্ ভাবরাশি আলঙ্কারিক ভাষায় চমকপ্রদ প্রবাহে যেন তাঁহার জিহ্বা হইতে নামিয়া আসে।

স্বামী বিবে কানন্দ ব্রাহ্মণবংশে জন্মগ্রহণ করেন এবং ব্রাহ্মণজনোচিত শিক্ষাদীক্ষায় পালিত হন, কিন্তু পরে তিনি জাতি ও কুলমর্যাদা পরিত্যাগ করিয়া ধর্মযাজক বা প্রাচ্যদেশের আদর্শে যাহাকে ‘সন্ন্যাসী’ বলা হয়, তাহাই হন। তিনি বরাবরই ঈশ্বর সম্বন্ধে মহত্তম ধারণা পোষণ করিয়া আসিয়াছেন এবং সেই ধারণার অঙ্গীভূত রহস্যময় বিশ্বপ্রকৃতির চৈতন্যাত্মকতায় বিশ্বাসী। বিবে কানন্দ বহু বৎসর ভারতবর্ষে উচ্চতর বিদ্যার সাধনায় এবং প্রচারে কাটাইয়াছেন। ইহার ফলে তিনি এমন প্রগাঢ় জ্ঞান আয়ত্ত করিয়াছেন যে, এই যুগের মহান্‌ চিন্তাশীল পণ্ডিতগণের অন্যতম বলিয়া তাঁহার পৃথিবীময় খ্যাতি।

বিশ্ব-ধর্মসম্মেলনে তাঁহার আশ্চর্য প্রথম বক্তৃতাটি তৎক্ষণাৎ সমবেত বিশিষ্ট ধর্মনায়কদের মধ্যে তাঁহাকে চিহ্নিত করিয়া দিয়াছিল। সম্মেলনের অধিবেশনসমূহে তাঁহার ধর্মের সপক্ষে তিনি অনেকবার বলিয়াছেন। মানুষের ও তাহার স্রষ্টার প্রতি মানুষের উচ্চতর কর্তব্য-সম্বন্ধ নির্ণয় করিয়া তাঁহার মুখ হইতে এমন কতকগুলি কথা বাহির হইয়াছিল, যাহা ইংরেজী ভাষার অতি মূল্যবান্ মনোজ্ঞ দার্শনিক সম্পদ। চিন্তায় তিনি একজন শিল্পী, বিশ্বাসে অধ্যাত্মবাদী এবং বক্তৃতামঞ্চে সুনিপুণ নাট্যকার বিশেষ।

মেমফিস্ শহরে পৌঁছিবার পর হইতে তিনি মিঃ হু. এল. ব্রিঙ্কলীর অতিথিরূপে রহিয়াছেন। ওখানে দিবারাত্র তাঁহার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে উৎসুক শহরের বহু ব্যক্তি তাঁহার সাক্ষাৎ করিয়াছেন। তিনি টেনেসী ক্লাবেরও একজন বেসরকারী অতিথি। শনিবার সন্ধ্যায় মিসেস এস. আর. শেফার্ড কর্তৃক তাঁহার জন্য একটি অভ্যর্থনার আয়োজন করা হয়। রবিবারে কর্ণেল আর বি. স্নোডেন তাঁহার অ্যানিসডেল-এর গৃহে এই মাননীয় অতিথিকে ভোজনে আমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। ওখানে বিবে কানন্দের সহিত সহকারী বিশপ টমাস এফ. গেলর, রেভারেণ্ড ডক্টর জর্জ প্যাটারসন এবং আরও অনেক ধর্মযাজকের সাক্ষাৎ হয়।

গতকল্য বিকালে র‍্যান‍্ডলফ বিল্ডিং-এ অবস্থিত নাইণ্টিন্থ্‌ সেঞ্চুরী ক্লাবের কার্যালয়ে ঐ ক্লাবের কেতাদুরস্ত সভ্যদের নিকট তিনি একটি বক্তৃতা দেন। আজ রাত্রে শহরের বক্তৃতাগৃহে তাঁহার ভাষণের বিষয়বস্তু হইবে—‘হিন্দুধর্ম’।

=======================

পরমত-সহিষ্ণুতার জন্য অনুনয়

‘মেমফিস্ কমার্শিয়াল’, ১৭ জানুআরী, ১৮৯৪

বেশ কিছু-সংখ্যক শ্রোতা গতরাত্রে প্রসিদ্ধ হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবে কানন্দের হিন্দুধর্ম- বিষয়ক ভাষণ শুনিবার জন্য শহরের বক্তৃতাগৃহে সমবেত হইয়াছিলেন।

বিচারপতি আর. জে. মর্গ্যান বক্তাকে পরিচিত করিয়া দিতে গিয়া একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু তথ্যপূর্ণ ভাষণে মহান্ আর্যজাতির ক্রমপ্রসারের বিবরণ দেন। তিনি বলেন, ইওরোপীয়গণ এবং হিন্দুরা উভয়েই আর্যজাতির শাখা, অতএব যিনি আজ তাঁহাদের কাছে বক্তৃতা দিবেন, তাঁহার আমেরিকাবাসীর সহিত জাতিগত আত্মীয়তা রহিয়াছে।

প্রাচ্যদেশের এই খ্যাতিমান্ পণ্ডিতকে বক্তৃতাকালে ঘন ঘন করতালি দ্বারা অভিনন্দিত করা হয়। সকলেই আগাগোড়া বিশেষ মনোযোগের সহিত তাঁহার কথা শুনেন। বক্তার শারীরিক আকৃতি বড় সুন্দর, গায়ের রঙ ব্রোঞ্জবর্ণ, দেহের অঙ্গসৌষ্ঠবও চমৎকার। তাঁহার পরিধানে ছিল কোমরে কালো কটিবন্ধ-বেষ্টিত পাটলবর্ণের আলখাল্লা, কালো পেণ্টালুন এবং মাথায় কমনীয় ভাবে জড়ান ভারতীয় রেশমের পীতবর্ণ পাগড়ি। বক্তার বলিবার ধরন খুব ভাল এবং তাঁহার ব্যবহৃত ইংরেজী ভাষা শব্দনির্বাচন, ব্যাকরণের শুদ্ধতা এবং বাক্যগঠনের দিক্‌ দিয়া উৎকৃষ্ট। তাঁহার উচ্চারণের ত্রুটি শুধু কখনও কখনও যৌগিক শব্দের যে অংশে জোর দিবার কথা নয়, সেখানে জোর দেওয়া। তবে সম্ভবতঃ মনোযোগী শ্রোতারা সব শব্দই বুঝিতে পারিয়াছিলেন। মৌলিক চিন্তায় ভরা, তথ্যপূর্ণ এবং উদার জ্ঞানে অনুস্যূত বক্তৃতাটি শুনিয়া তাঁহাদের এই প্রখর মনোযোগ নিশ্চিতই সার্থক হইয়াছিল। এই ভাষণটিকে যথার্থই বিশ্বজনীন পরধর্ম-সহিষ্ণুতার সপক্ষে একটি ‘অনুনয়’ বলা যাইতে পারে। এই বিষয়ে বক্তা ভারতীয় ধর্মসংক্রান্ত নানা মন্তব্য উদ্ধৃত করেন। তিনি বলেন, পরমত-সহিষ্ণুতা এবং প্রেমই হইল প্রধান প্রধান ধর্মের মুখ্য উদ্দীপনা। তাঁহার মতে ইহাই যে-কোন ধর্মবিশ্বাসের শেষ লক্ষ্য হওয়া উচিত।

তাঁহার ভাষণে হিন্দুধর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ অবতারণা ছিল না। ঐ ধর্মের কিংবদন্তী বা আচার-অনুষ্ঠানের বিশদ চিত্র উপস্থাপিত না করিয়া তিনি উহার অন্তর্নিহিত ভাবধারার একটি বিশ্লেষণ দিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। অবশ্য হিন্দুধর্মের কয়েকটি বিশেষ মতবাদ ও ক্রিয়াকর্মের তিনি উল্লেখ করিয়াছিলেন, তবে এইগুলির অতি স্পষ্ট সরল ব্যাখ্যা তিনি দিয়াছিলেন। বক্তা হিন্দুধর্মের অতীন্দ্রিয় উপলব্ধির একটি হৃদয়গ্রাহী বিবরণ দেন। জন্মান্তরবাদ—যাহা অনেক সময়ে অপব্যাখ্যাত হয়—এই অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি হইতেই উদ্ভূত। বক্তা ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া দেন, কিভাবে তাঁহার ধর্ম কালের বৈচিত্র্যকে উপেক্ষা করিয়া সর্বকালে বর্তমান মানবাত্মার সত্যকে প্রত্যক্ষ অনুভব করিতে পারেন। সব মানুষই যেমন আত্মার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অস্তিত্বে বিশ্বাসী, ব্রাহ্মণ্যধর্ম তেমনি আত্মার অতীত অবস্থাও স্বীকার করেন। বিবে কানন্দ ইহাও স্পষ্ট ভাবে বলেন যে, খ্রীষ্টধর্মে যাহাকে ‘আদিম পাপ’ বলা হয়, হিন্দুধর্মে উহার কোন স্থান নাই। মানুষ যে পরিপূর্ণতা লাভ করিতে পারে—এই বিশ্বাসের উপর হিন্দুধর্ম মানুষের সকল চেষ্টা ও আকাঙ্ক্ষাকে স্থাপন করে। বক্তার মতে উন্নতি এবং শুদ্ধি আশার উপর স্থাপিত হওয়া বিধেয়। মানুষের উন্নতির অর্থ তাহার স্বাভাবিক পূর্ণতায় ফিরিয়া যাওয়া। সাধুতা এবং প্রেমের অভ্যাস দ্বারাই এই পূর্ণতার উপলব্ধি হয়। ভারতবাসী যুগ যুগ ধরিয়া এই গুণগুলি কিভাবে অভ্যাস করিয়াছে—যুগ যুগ ধরিয়া ভারতবর্ষ কিভাবে নিপীড়িত জনগণের আশ্রয়ভূমি হইয়াছে, বক্তা তাহা নির্ণয় করেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন যে, রোম সম্রাট্ টাইটাস যখন জেরুসালেম আক্রমণ করিয়া য়াহুদীদের মন্দির ধ্বংস করেন, তখন হিন্দুরা য়াহুদীদের সাদরে আশ্রয় দিয়াছিল।

বক্তা খুব প্রাঞ্জল বর্ণনা দ্বারা বুঝাইয়া দেন যে, হিন্দুরা ধর্মের বহিরঙ্গের উপর বেশী ঝোঁক দেন না। কখনও কখনও দেখা যায়, একই পরিবারের ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু প্রত্যেকেই ঈশ্বরের যে প্রধানতম গুণ—প্রেম, উহারই মাধ্যমে উপাসনা করিয়া থাকেন। বক্তা বলেন যে, সকল ধর্মেই ভাল জিনিষ আছে; সাধুতার প্রতি মানুষের যে উদ্দীপনাবোধ, সব ধর্মই হইল তাহার অভিব্যক্তি, অতএব প্রত্যেক ধর্মই শ্রদ্ধার যোগ্য। এই বিষয়টির উদাহরণস্বরূপ তিনি বেদের (?) একটি উক্তি উদ্ধৃত করেন। একটি ঝরনা হইতে জল আনিতে বিভিন্ন লোকে যেমন বিভিন্ন গঠনের পাত্র লইয়া যায়, ধর্মসমূহও সেইরূপ সত্যকে উপলব্ধির বিভিন্ন আধারস্বরূপ। পাত্রের আকার আলাদা হইলেও লোকে যেমন একই জল উহাতে ভরিয়া লয়, সেইরূপ পৃথক্ পৃথক্ ধর্মের মাধ্যমে আমরা একই সত্য গ্রহণ করি। ঈশ্বর প্রত্যেক ধর্মবিশ্বাসের মর্মবোদ্ধা। যে কোন নামে তাঁহাকে ডাকা হউক, যে কোন রীতিতেই তাঁহাকে শ্রদ্ধা করা হউক, তিনি তাহা বুঝিতে পারেন।

বক্তা বলেন, খ্রীষ্টানরা যে-ঈশ্বরের পূজা করেন, হিন্দুদেরও উপাস্য তিনিই। হিন্দুদের ত্রিমূর্তি—ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ও শিব ঈশ্বরের সৃষ্টিস্থিতিলয়-কার্যের নির্ণায়ক মাত্র। ঈশ্বরের এই তিনটি বৈশিষ্ট্য ঐক্যবদ্ধ না করিয়া পৃথক্ পৃথক্ মূর্তির মধ্য দিয়া প্রকাশ করা অবশ্যই কিছু দুর্বলতা, তবে সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মনীতি এইরূপ স্থূলভাবে স্পষ্ট করিয়া বলা প্রয়োজন। এই একই কারণে হিন্দুরা ভগবানের দৈবী গুণসমূহ নানা দেবদেবীর স্থূল প্রতিমার মাধ্যমে প্রকাশ করিতে চায়।

হিন্দুদের অবতারবাদ-প্রসঙ্গে বক্তা কৃষ্ণের কাহিনী বলেন। পুরুষসংসর্গ ব্যতীত তাঁহার জন্ম হইয়াছিল। যীশুখ্রীষ্টের চরিতকথার সহিত তাঁহার জীবন বৃত্তান্তের অনেক সাদৃশ্য আছে। বিবে কানন্দের মতে কৃষ্ণের শিক্ষা হইল, ভালবাসার জন্যই ভালবাসা—এই তত্ত্ব। ঈশ্বরকে ভয় করা যদি ধর্মের আরম্ভ হয়, তাহা হইলে উহার পরিণতি হইল ঈশ্বরকে ভালবাসা।

তাঁহার সমগ্র বক্তৃতাটি এখানে প্রকাশ করা সম্ভব হইল না, কিন্তু উহা মানুষে মানুষে ভ্রাতৃপ্রেম উপলব্ধির জন্য একটি চমৎকার আবেদন এবং একটি রমণীয় ধর্মবিশ্বাসের ওজস্বী সমর্থন। বিবে কানন্দের ভাষণের উপসংহার বিশেষভাবে হৃদয়গ্রাহী হইয়াছিল, যখন তিনি বলিলেন যে, খ্রীষ্টকে স্বীকার করিতে তিনি সর্বদাই প্রস্তুত, তবে সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ এবং বুদ্ধকেও প্রণিপাত করা চাই; আর যখন মানব-সভ্যতার বর্বরতার একটি পরিষ্কার ছবি আঁকিয়া তিনি বলিলেন, সভ্যতার এই-সকল গ্লানির জন্য যীশুখ্রীষ্টকে দায়ী করিতে তিনি রাজী নন।

=================

ভারতীয় আচার-ব্যবহার

ভারতীয় আচার-ব্যবহার

‘অ্যাপীল অ্যাভাল্যাঞ্চ’, ২১ জানুআরী, ১৮৯৪

হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবে কানন্দ গতকল্য বিকালে লা স্যালেট একাডেমীতে (মেমফিস্ শহরে) একটি বক্তৃতা দিয়াছেন। প্রবল বৃষ্টিপাতের দরুন শ্রোতৃসংখ্যা খুব কম ছিল।

বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘ভারতীয় আচার ব্যবহার’। বিবে কানন্দের ধর্মবিষয়ক চিন্তাধারা এই শহরের এবং আমেরিকার অন্যান্য নগরীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের চিত্তে সহজেই সমাদর লাভ করিতেছে।

তাঁহার মতবাদ খ্রীষ্টীয় ধর্মযাজকদের গোঁড়া বিশ্বাসের পক্ষে মারাত্মক। খ্রীষ্টান আমেরিকা এ-যাবৎ পৌত্তলিক ভারতবর্ষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনকে আলোকিত করিবার প্রভূত চেষ্টা করিয়া আসিয়াছে, কিন্তু এখন মনে হইতেছে যে, কানন্দের ধর্মের প্রাচ্য বিভব আমাদের পিতৃপিতামহের উপদিষ্ট প্রাচীন খ্রীষ্টধর্মের সৌন্দর্যকে ছাপাইয়া গিয়াছে এবং উহা আমেরিকার অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত মহলের অনেকের মনে একটি উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র খুঁজিয়া পাইবে।

বর্তমানকাল হইল ‘খেয়ালের’ যুগ। মনে হইতেছে যে, কানন্দ একটি ‘বহুকালের অনুভূত চাহিদা’ মিটাইতে পারিতেছেন। তিনি বোধ করি, তাঁহার দেশের একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত এবং আশ্চর্য পরিমাণে ব্যক্তিগত আকর্ষণ-শক্তিরও অধিকারী। তাঁহার বাগ্মিতায় শ্রোতৃমণ্ডলী মুগ্ধ হইয়া যায়। যদিও তাঁহার মতবাদ খুব উদার, তবুও গোঁড়া খ্রীষ্টধর্মে প্রশংসা করিবার মত বস্তু সামান্যই তিনি দেখিতে পান। এ পর্যন্ত মেমফিস্‌ শহরে যত বক্তা বা ধর্মযাজক আসিয়াছেন, মনে হয় কানন্দ তাঁহাদের প্রত্যেকের অপেক্ষা বেশী সমাদর বিশেষভাবে লাভ করিয়াছেন।

এই হিন্দু সন্ন্যাসী এখানে যেরূপ সহৃদয় অভ্যর্থনা পাইতেছেন, ভারতে খ্রীষ্টান মিশনরীরা যদি সেরূপ পাইতেন, তাহা হইলে অ-খ্রীষ্টান দেশসমূহে খ্রীষ্টবাণী প্রচারের কাজ খুব সুগম হইত। বিবে কানন্দের গতকল্য বিকালের বক্তৃতা ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গীর দিক্ দিয়া চিত্তাকর্ষক হইয়াছিল। তিনি তাঁহার স্বদেশের প্রাচীনকাল হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইতিহাস এবং রীতিনীতির সহিত সম্পূর্ণরূপে পরিচিত। ভারতের বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থান এবং বিষয়সমূহের বর্ণনা খুব সুষ্ঠু ও সহজভাবে দিতে পারেন।

বক্তৃতার সময় মহিলা শ্রোতারা তাঁহাকে ঘন ঘন প্রশ্ন করিতেছিলেন। তিনিও বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করিয়া সব প্রশ্নের উত্তর দিয়াছিলেন। কেবল জনৈক মহিলা যখন তাঁহাকে একটি অবান্তর ধর্মপ্রসঙ্গে টানিয়া আনিতে চাহিয়া একটি প্রশ্ন তুলিলেন, তখন কানন্দ আলোচ্য বিষয় ছাড়িয়া উহার উত্তর দিতে রাজী হন নাই। প্রশ্নকর্ত্রীকে বলিলেন, অন্য কোন সময়ে তিনি ‘আত্মার জন্মান্তর গ্রহণ’ প্রভৃতি বিষয় সম্বন্ধে তাঁহার মত বিবৃত করিবেন।

প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন যে, তাঁহার পিতামহের বিবাহ হইয়াছিল তিন বৎসর বয়সে; আর তাঁহার পিতার আঠার বৎসর বয়সে। বক্তা নিজে বিবাহ করেন নাই। সন্ন্যাসীর বিবাহ করিতে বাধা নাই, কিন্তু বিবাহ করিলে তাঁহার স্ত্রীকেও সন্ন্যাসিনী হইতে হয়। সন্ন্যাসিনী স্ত্রীর ক্ষমতা, সুবিধা এবং সামাজিক সম্মান তাঁহার স্বামীরই মত।৫

একটি প্রশ্নের উত্তরে বক্তা বলেন, ভারতে কোন কারণেই বিবাহ-বন্ধন ছেদের প্রচলন নাই, তবে বিবাহের ১৪ বৎসর পরেও সন্তান না হইলে স্ত্রীর অনুমতি লইয়া স্বামী আর একটি বিবাহ করিতে পারেন। স্ত্রী আপত্তি করিলে ইহা সম্ভব নয়। বক্তা ভারতের প্রাচীন মন্দির এবং সমাধিস্তম্ভসমূহের অতি চমৎকার বর্ণনা দেন। বুঝিতে পারা যাইতেছে যে, প্রাচীনকালের ভাস্কর এবং শিল্পীদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বর্তমানকালের কারিগরদের অপেক্ষা অনেক বেশী উন্নত ছিল।

স্বামী বিবে কানন্দ আজ রাত্রে ওয়াই. এম. এইচ. হলে এই শহরে তাঁহার শেষ বক্তৃতা করিবেন। তিনি চিকাগোর ‘স্লেটন লাইসিআম ব্যুরো’-র সহিত এই দেশে তিন বৎসরের জন্য বক্তৃতাদানের একটি চুক্তি করিয়াছেন। কাল তিনি চিকাগো রওনা হইবেন। ২৫ তারিখ রাত্রিতে ওখানে তাঁহার একটি বক্তৃতা দিবার কথা।

ডেট্রয়েট ট্রিবিউন, ১৫ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪

গত সন্ধ্যায় বেশ কিছু সংখ্যক শ্রোতা ব্রাহ্মসমাজের প্রসিদ্ধ হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবে কানন্দের দর্শন ও তাঁহার বক্তৃতা শ্রবণের সুযোগ পাইয়াছিলেন। ইউনিটি ক্লাবের উদ্যোগে ইউনিটেরিয়ান চার্চ-এ এই বক্তৃতার আয়োজন হইয়াছিল। তিনি তাঁহার দেশীয় পোষাক পরিয়া আসিয়াছিলেন। তাঁহার কমনীয় মুখমণ্ডল এবং বলিষ্ঠ দেহ তাঁহার চেহারায় একটি সম্ভ্রান্ত ভাবের সৃষ্টি করিয়াছিল। বাগ্মিতায় তিনি শ্রোতৃমণ্ডলীর প্রখর মনোযোগ আকর্ষণ করেন। ঘন ঘন করতালি পড়িতেছিল। বক্তার আলোচ্য বিষয় ছিল—‘ভারতের আচার-ব্যবহার’। উহা তিনি উৎকৃষ্ট ইংরেজীতে উপস্থাপিত করেন। তিনি বলেন, তাঁহাদের দেশের ‘ইণ্ডিয়া’ এবং দেশবাসীর ‘হিন্দু’ নাম ঠিক নয়। উহা বিদেশীদের উদ্ভাবিত। তাঁহাদের দেশের প্রকৃত নাম ‘ভারত’ এবং অধিবাসীরা ‘ব্রাহ্মণ’। প্রাচীনকালে তাঁহাদের কথ্য ভাষা ছিল সংস্কৃত। প্রত্যেকটি শব্দের ব্যুৎপত্তিগত পরিষ্কার বোধগম্য অর্থ ছিল, কিন্তু এখন সে-সব চলিয়া গিয়াছে। জুপিটার শব্দের সংস্কৃত অর্থ ‘স্বর্গস্থ পিতা’। বর্তমানকালে উত্তর ভারতের সব ভাষাই মোটামুটি একপ্রকার; কিন্তু উত্তর ভারতের লোক দক্ষিণ ভারতে গেলে তথাকার লোকের সহিত কথাবার্তা বলিতে পারিবে না। ফাদার মাদার, সিষ্টার ব্রাদার প্রভৃতি শব্দের সংস্কৃত প্রতিশব্দগুলি শুনিতে অনেকটা একই রকম। বক্তা বলেন, এই কারণে এবং অন্যান্য তথ্যের প্রমাণ হইতেও তাঁহার মনে হয়, আমরা সকলেই একটি সাধারণ সূত্র—আর্যজাতি হইতে উদ্ভূত। এই আদিম আর্যজাতির প্রায় সব শাখাই নিজেদের স্বাতন্ত্র্য হারাইয়া ফেলিয়াছে।

প্রাচীন ভারতের সমাজে চারটি শ্রেণীবিভাগ ছিল—পুরোহিত, রাজা ও সৈনিক, বণিক ও শিল্পী এবং শ্রমিক ও ভৃত্য। প্রথম তিন শ্রেণীর বালকগণকে যথাক্রমে দশ, এগার এবং ত্রয়োদশ বৎসর বয়সে শিক্ষার জন্য গুরুকুলে অধ্যাপকদের তত্ত্বাবধানে পাঠান হইত এবং তাহাদিগকে ত্রিশ, পঁচিশ ও কুড়ি বৎসর পর্যন্ত সেখানে থাকিতে হইত। প্রাচীনকালে বালক ও বালিকা উভয়ের জন্যই শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। এখন বালকদেরই সুযোগ বেশী। অবশ্য দীর্ঘকালের এই ভুলটি শুধরাইবার চেষ্টা চলিতেছে। বৈদেশিক অধিকারের পূর্বে ভারতবর্ষের দর্শন এবং নীতি-নিয়মাদির অনেক অংশ প্রাচীনকালে নারীদের দ্বারা প্রণীত। হিন্দুসমাজে নারীর স্বকীয় অধিকার আছে। এই অধিকার তাঁহারা বজায় রাখেন। তাঁহাদের স্বপক্ষে আইনও রহিয়াছে।

গুরুকুল হইতে প্রত্যাবর্তনের পর ছাত্রেরা বিবাহ করিয়া সংসারী হইতে পারিত। সংসারের দায়িত্ব স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই এবং উভয়েরই নিজস্ব অধিকার ছিল। ক্ষত্রিয়দের ক্ষেত্রে কন্যা অনেক সময় নিজের পতি নিজেই মনোনয়ন করিত; কিন্তু অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই পিতামাতাই ঐ ব্যবস্থা করিতেন। বর্তমানকালে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের জন্য অনবরত চেষ্টা চলিতেছে। হিন্দুদের বিবাহ-অনুষ্ঠানটি বড় সুন্দর। বর এবং কন্যা পরস্পর পরস্পরের হৃদয় স্পর্শ করিয়া ভগবান্ এবং সমবেত সকলকে সাক্ষী মানিয়া শপথ করে যে, একে অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকিবে। বিবাহ না করা পর্যন্ত কেহ পুরোহিত হইতে পারে না। প্রকাশ্য ধর্মানুষ্ঠানে যোগ দিবার সময় পুরুষের সহিত তাহার পত্নীও যায়। হিন্দুরা এই পাঁচটিকে কেন্দ্র করিয়া মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, যথা—দেবতা পিতৃপুরুষ দরিদ্র, ইতর প্রাণী এবং ঋষি বা শাস্ত্র। হিন্দুগৃহস্থের বাড়ীতে যতক্ষণ সামান্য কিছুও থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত অতিথিকে ফিরিয়া যাইতে হয় না। অতিথির পরিতৃপ্তিপূর্বক ভোজন শেষ হইলে গৃহের শিশুরা খায়, তারপর তাহাদের পিতা এবং সর্বশেষে জননী। হিন্দুরা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা দরিদ্র জাতি; কিন্তু দুর্ভিক্ষের সময় ছাড়া কখনও কেহ ক্ষুধায় মারা যায় না। সভ্যতা এক বিরাট কীর্তি। তুলনাস্বরূপ বলা হয় যে, ইংলণ্ডে যদি প্রতি চারিশত ব্যক্তির মধ্যে একজন মদ্যপায়ী থাকে তো ভারতে ঐ অনুপাতে প্রতি দশ লক্ষে একজন। বক্তা মৃত ব্যক্তির শবদাহ-অনুষ্ঠানের একটি বর্ণনা দেন। কোন কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্র ছাড়া এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে কোন প্রকাশ্য প্রচার করা হয় না। পনর দিন উপবাসের পর মৃতের আত্মীয়েরা পূর্বপুরুষদের নামে দরিদ্রদিগকে অর্থাদি দান করেন অথবা জনহিতকর কোন প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। নৈতিক আদর্শের দিক্‌ দিয়া হিন্দুরা অন্যান্য সকল জাতি অপেক্ষা প্রভূত উন্নততর।

=======

হিন্দু দর্শন

ডেট্রয়েট ফ্রী প্রেস, ১৬ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪

মানরা যখন জেরুজালেম ধ্বংস করে, তখন বহু সহস্র য়াহুদী ভারতবর্ষে আসিয়া বসবাস করে। আরবগণ কর্তৃক স্বদেশ হইতে বিতাড়িত হইয়া বহু সহস্র পারসীকও ভারতে আশ্রয় পায়, কেহই নিপীড়িত হয় নাই। হিন্দুরা বিশ্বাস করে—সকল ধর্মই সত্য। তবে তাহাদের ধর্ম অপর ধর্মসমূহ অপেক্ষা প্রাচীনতর। ইংরেজ মিশনরীদের প্রথম দলটিকে ইংরেজ সরকার যখন জাহাজ হইতে ভারতে নামিতে বাধা দেন, তখন একজন হিন্দুই তাঁহাদের হইয়া দরবার করিয়া তাঁহাদিগকে নামিতে সাহায্য করেন। যাহা সব কিছু মানিয়া লয়, তাহাই তো ধর্মবিশ্বাস। বক্তা অন্ধের হস্তী দর্শনের সহিত ধর্মমতের তুলনা করেন। এক একজন অন্ধ হাতীর দেহের এক একটি অংশ স্পর্শ দ্বারা অনুভব করিয়া হাতী কি রকম, তাহার সিদ্ধান্ত করিয়া বসিয়াছিল। নিজের অভিজ্ঞতার দিক্ দিয়া প্রত্যেকের উক্তিই সত্য হইলেও হাতীর সামগ্রিক বর্ণনা তো কোনটি হইতেই পাওয়া যায় নাই। হিন্দু দার্শনিকরা বলেন, ‘সত্য হইতে সত্যে, নিম্নতর সত্য হইতে উচ্চতর সত্যে।’ সব মানুষ কোন এক সময় একই রীতিতে চিন্তা করিবে, ইহা যাঁহারা আশা করেন তাঁহারা অলস স্বপ্ন দেখিতেছেন মাত্র। এরূপ অবস্থা উপস্থিত হইলে ধর্মের মৃত্যু ঘটিবে। প্রত্যেক ধর্মই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হইয়া পড়ে, আর প্রত্যেকটি দল দাবী করে যে, উহাই সত্য এবং অপরেরা ভ্রান্ত। বৌদ্ধধর্মে অপর মতাবলম্বীদের উপর নিপীড়ন অবিদিত। বৌদ্ধধর্মই প্রথম নানা দেশে প্রচারক পাঠায় এবং বলিতে পারে যে, লক্ষ লক্ষ লোককে এক বিন্দু রক্তপাত না করিয়া স্বমতে আনিয়াছে। নানা দোষ এবং কুসংস্কার সত্ত্বেও হিন্দুরা কখনও অন্যের উপর অত্যাচার করে নাই। বক্তা জানিতে চান, নানা খ্রীষ্টান দেশের সর্বত্র যে-সর্ব অসাম্য রহিয়াছে, খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীরা ঐগুলি অনুমোদন করেন কিভাবে?

============

অলৌকিক ঘটনা

ইভনিং নিউজ, ১৭ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪

‘আমি আমার ধর্মের প্রমাণস্বরূপ কোন অলৌকিক ঘটনা দেখাইব—নিউজ-পত্রিকার এই অনুরোধ আমার পক্ষে রাখা সম্ভব নয়।’—এই কাগজের জনৈক প্রতিনিধি বিবে কানন্দকে ঐ-বিষয়ক সম্পাদকীয় প্রবন্ধটি দেখাইলে তিনি উপরিউক্ত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, প্রথমতঃ আমি অলৌকিক ঘটনা লইয়া কাজ করি না, আর দ্বিতীয়তঃ আমি যে হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত, উহা অলৌকিক ঘটনার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। অলৌকিক ঘটনা বলিয়া কিছু আমরা মানি না। আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের এলাকার বাহিরে আশ্চর্য অনেক কিছু ঘটিয়া থাকে সত্য, কিন্তু ঐগুলি কোন-না-কোন নিয়মের অধীন। আমাদের ধর্মের সহিত ঐগুলির কোন সম্পর্ক নাই। যে-সব আশ্চর্য ক্রিয়াকলাপ ভারতবর্ষে করা হয় বলিয়া বৈদেশিক সংবাদপত্রে ছাপা হয়, ঐগুলির অধিকাংশই হইল হাতের চাল বা সম্মোহন-বিদ্যার প্রভাবজনিত চোখের ভ্রম। যথার্থ জ্ঞানী পুরুষেরা কখনও ঐ-সব করেন না। তাঁহারা কখনও পয়সার জন্য হাটে বাজারে এই-সব তুকতাক দেখাইয়া দেশময় ঘুরিয়া বেড়ান না। যাঁহারা যথার্থ আধ্যাত্মিক তত্ত্বজিজ্ঞাসু এবং শুধু বালসুলভ কৌতূহলাক্রান্ত নয়, তাঁহারা ঐ-সকল জ্ঞানী-পুরুষের দেখা পান এবং তাঁহাদিগকে চিনিতে পারেন।

===========

মানুষের দেবত্ব

ডেট্রয়েট ফ্রী প্রেস, ১৮ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪

হিন্দু দার্শনিক এবং পুরোহিত স্বামী বিবে কানন্দ গত রাত্রে ইউনিটেরিয়ান চার্চ-এ ‘মানুষের দেবত্ব’ সম্বন্ধে বলিয়া তাঁহার বক্তৃতা বা ধর্মব্যাখ্যান-মালার উপসংহার করিয়াছেন। আবহাওয়া খারাপ থাকা সত্ত্বেও প্রাচ্যদেশীয় এই ভ্রাতার (এই নামেই তাঁহাকে অভিহিত করা তিনি পছন্দ করেন) বক্তৃতামঞ্চে আসিবার আধ ঘণ্টা পূর্বেই সমগ্র গীর্জাটি দরজা পর্যন্ত শ্রোতৃমণ্ডলীর ভিড়ে ভরিয়া যায়। তাঁহাদের মধ্যে সকল শ্রেণীর ও বৃত্তির লোকই ছিলেন—আইনজীবী, বিচারক, খ্রীষ্ট্রীয় ধর্মযাজক, ব্যবসায়ী, একজন য়াহুদী ধর্মযাজক এবং মহিলাদের তো কথাই নাই। মহিলারা বার বার উপস্থিত হইয়া এবং প্রখর মনোযোগ সহকারে তাঁহার ভাষণ শুনিয়া এই শ্যামবর্ণ আগন্তুককে তাঁহাদের ভূরি ভূরি প্রশংসাবাদ অর্পণ করিবার সুস্পষ্ট প্রবণতা প্রমাণ করিয়াছেন। বক্তা ভদ্রলোকদিগের বসিবার ঘরে বসিয়া আলাপ আলোচনায় যেমন সকলকে আকর্ষণ করিতে পারেন, সাধারণ বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়াইয়াও সেইরূপ পারেন।

গতরাত্রের বক্তৃতা পূর্বেকারগুলি হইতে কম বর্ণনামূলক ছিল। প্রায় দুই ঘণ্টা যাবৎ বিবে কানন্দ মানবীয় এবং ঐশ্বরিক ব্যাপার লইয়া তত্ত্ববিদ্যার একটি আস্তরণ বুনিয়া চলেন। তাঁহার কথাগুলি এত যুক্তিসঙ্গত যে, বিজ্ঞানকে তিনি সাধারণ বুদ্ধির মত সরল করিয়া তুলেন। ন্যায়গর্ভ ভাষণটি যেন প্রাচ্য গন্ধদ্রব্য দ্বারা সুবাসিত তাঁহার স্বদেশে হাতে-বোনা এবং অতি চমৎকার নানা রঙের একটি বস্ত্রের মতই সুন্দর, উজ্জ্বল, চিত্তাকর্ষক এবং আনন্দদায়ী। শিল্পী যেমন তাঁহার চিত্রে নিপুণভাবে নানা রঙ ব্যবহার করেন, এই শ্যামবর্ণ ভদ্রলোকও তাঁহার ভাষণে সেইরূপ কাব্যময় উপমা প্রয়োগ করেন। যেখানে যেটি মানায় ঠিক সেখানে সেইটি তিনি বসাইয়া যান। উহার প্রতিক্রিয়া কিছু অদ্ভুত ঠেকিলেও উহার একটি আশ্চর্য আকর্ষণ আছে। চলচ্চিত্রের মত পর পর দ্রুত তাঁহার যুক্তিপ্রতিষ্ঠ সিদ্ধান্তগুলি উপস্থিত হইতেছিল, আর এই কুশলী বক্তার শ্রমও মাঝে মাঝে শ্রোতৃবৃন্দের উৎসাহপূর্ণ করতালি দ্বারা সার্থকতা লাভ করিতেছিল।

বক্তৃতার পূর্বে ঘোষণা হয় যে, বক্তার নিকট অনেকগুলি প্রশ্ন আনা হইয়াছে। ইহাদের কতকগুলির উত্তর তিনি ব্যক্তিগতভাবে আলাদা দেওয়াই ভাল মনে করেন। তবে তিনটি প্রশ্ন তিনি বাছিয়া রাখিয়াছেন, ঐগুলির প্রত্যুত্তর বক্তৃতামঞ্চ হইতেই দিবেন। প্রশ্নগুলি এইঃ

(১) ভারতের লোকেরা কি তাহাদের শিশু-সন্তানদের কুমীরের মুখে নিক্ষেপ করে?

(২) জগন্নাথের রথের চাকার নীচে পড়িয়া কি তাহারা মৃত্যুবরণ করে?

(৩) মৃত স্বামীর সহিত কি তাহারা জীবিত বিধবাকেও জোর করিয়া দাহ করে?

বিদেশে একজন আমেরিকানকে নিউ ইয়র্ক শহরের রাস্তায় রেড-ইণ্ডিয়ানরা দৌড়াদৌড়ি করে কিনা—এই বিষয়ে, অথবা আমেরিকা সম্বন্ধে ইওরোপে এখনও পর্যন্ত প্রচলিত এই ধরনের আজগুবি খবর সম্বন্ধে যদি প্রশ্ন করা হয়, তাহা হইলে তিনি যেভাবে ঐ-সব প্রশ্নের উত্তর দিবেন, বক্তা বিবে কানন্দ প্রথম প্রশ্নটির জবাব সেই ভাবেই দিলেন। অর্থাৎ প্রশ্নটি এতই আজগুবী যে, উহার কোন গুরুত্বপূর্ণ উত্তর নিষ্প্রয়োজন। কোন কোন সরল কিন্তু অজ্ঞ লোক তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, হিন্দুরা শুধু স্ত্রী-শিশুই কেন কুমীরদের মুখে দেয়?—ইহার উত্তরে বিবে কানন্দ ব্যঙ্গ করিয়া বলেন, উহার কারণ বোধ করি এই যে, স্ত্রী-শিশুদের মাংস বেশী নরম আর ঐ আজব দেশের নদীতে যে-সব হিংস্র জলজন্তু থাকে, তাহারা ঐরূপ মাংস সহজে হজম করিতে পারে। জগন্নাথ-সংক্রান্ত প্রশ্নটি সম্বন্ধে বক্তা ঐ তীর্থস্থানের দীর্ঘকাল প্রচলিত রথযাত্রা ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া দেন এবং বলেন যে, খুব সম্ভবতঃ কখনও কোন কোন অত্যুৎসাহী ভক্ত রথসংলগ্ন দড়িটি ধরিতে এবং টানিতে গিয়া পা পিছলাইয়া চাকার নীচে পড়িয়া মারা গিয়া থাকিবে। এইরূপ কোন আকস্মিক দুর্ঘটনার অতিরঞ্জিত বর্ণনা হইতে পরে নানা বিকৃত ধারণার সৃষ্টি হইয়াছে এবং ঐ-সব শুনিয়া অন্য দেশের সহৃদয় লোক আতঙ্কে শিহরিয়া উঠেন।

হিন্দুরা জীবিত বিধবাদের অগ্নিসাৎ করে—বিবে কানন্দ ইহা অস্বীকার করেন। তবে ইহা সত্য যে, কখনও কখনও কোন বিধবা নিজে স্বেচ্ছায় অগ্নিতে আত্মাহুতি দিয়াছেন। এরূপ যখন ঘটিয়াছে, তখন পুরোহিত এবং সাধুসন্তেরা তাঁহাদিগকে ঐ কার্য হইতে বিরত থাকিতে পীড়াপীড়ি করিয়াছেন; কেননা ইঁহারা সকলেই আত্মহত্যার বিরোধী।

সকলের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও যদি পতিব্রতা বিধবা স্বামীর সহিত সহমৃতা হইবার জন্য জিদ করিতেন, তাহা হইলে তাঁহাকে একটি ‘অগ্নিপরীক্ষা’ দিতে হইত। তিনি অগ্নিশিখায় প্রথমে হাত ঢুকাইয়া দিতেন। যদি হাত পুড়িয়া যাইত, তাহা হইলে তাঁহার স্বামীর সহিত সহমরণের ইচ্ছায় আর বাধা দেওয়া হইত না। কিন্তু ভারতই তো একমাত্র দেশ নয়, যেখানে প্রেমিকা নারী প্রেমাস্পদের মৃত্যুর পর স্বেচ্ছায় তাঁহার সহিত অমৃতলোকে অনুগমন করিয়াছেন। এই ধরনের মৃত্যুবরণ প্রত্যেক দেশেই হইয়াছে। যে-কোন দেশে ইহা এক প্রকার অস্বাভাবিক ধর্মোন্মত্ততা। অন্যত্র যেরূপ, ভারতেও উহা ঐরূপই অস্বাভাবিক। বক্তা পুনরায় বলেন, ‘না, ভারতবাসী নারীদের পুড়াইয়া মারে না। পাশ্চাত্যদেশের মত তাহারা কখনও ডাইনীদেরও দগ্ধ করে নাই।’

অতঃপর বক্তৃতার প্রকৃত বিষয়ে আসিয়া বিবে কানন্দ প্রথমে মানব-জীবনের শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করেন। শরীর বাহিরের খোসা মাত্র; মনও একটি ক্রিয়াশীল বস্তুবিশেষ, ইহার কাজ খুব ত্বরিত এবং রহস্যময়; একমাত্র আত্মাই সুস্পষ্ট ব্যক্তি-সত্তা। আত্মার অন্তরস্বরূপের জ্ঞান হইলে মুক্তিলাভ হয়। আমরা যাহাকে ‘পরিত্রাণ’ বলি হিন্দুরা উহাকে বলেন ‘মুক্তি’। বেশ বলবান্ যুক্তিসহায়ে বক্তা প্রমাণ করেন যে, প্রত্যেক আত্মাই প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন। আত্মা যদি কোন কিছুর অধীন হইত, তাহা হইলে উহা কখনও অমরত্ব লাভ করিতে পারিত না। কোন ব্যক্তি কিভাবে আত্মার স্বাধীনতা ও অমরত্বের প্রত্যাক্ষানুভূতি লাভ করিতে পারে, তাহার উদাহরণস্বরূপ বক্তা তাঁহার দেশের একটি উপকথা বর্ণনা করেন।

আসন্নপ্রসবা এক সিংহী একটি মেষের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িবার সময় বাচ্চা প্রসব করিয়া ফেলে এবং পরে মারা যায়। সিংহশাবকটিকে তখন এক মেষী স্তন্য পান করাইয়া বাঁচায়। শাবকটি মেষের দলে বাড়িতে থাকে। নিজেকে সে মেষ বলিয়া মনে করিত এবং আচরণও ঠিক মেষের ন্যায়ই করিত। একদিন আর একটি সিংহ আসিয়া তাহাকে দেখিতে পায় এবং তাহাকে একটি জলাশয়ের নিকট লইয়া যায়। জলে সে নিজের প্রতিবিম্ব অপর সিংহের মত দেখিয়া বুঝিল—সে মেষ নয়, সিংহ। তখন সে সিংহের ন্যায় গর্জন করিয়া উঠিল। আমাদের অনেকেরই দশা ঐ ভ্রান্ত সিংহ-মেষের ন্যায়।

নিজদিগকে ‘পাপী’ মনে করিয়া আমরা কোণে লুকাইয়া থাকি এবং যত প্রকারে সম্ভব হীন আচরণ করিয়া চলি। নিজেদের আত্মার পূর্ণতা ও দেবত্ব আমরা দেখিতে পাই না। নরনারীর যে ‘আমি’, উহাই আত্মা। আত্মা যদি প্রকৃতপক্ষে মুক্ত, তাহা হইলে অনন্ত পূর্ণ স্বরূপ হইতে ব্যষ্টিগত বিচ্ছিন্নতা আসিল কিরূপে?—হ্রদের জলে সূর্যের যেমন আলাদা আলাদা অসংখ্য প্রতিবিম্ব পড়ে, ঠিক সেই ভাবে। সূর্য এক, কিন্তু প্রতিবিম্ব-সূর্য বহু। মানবাত্মার প্রকৃত স্বরূপ এক, কিন্তু নানা দেহে প্রতিবিম্ব-আত্মা বহু। বিম্ব-স্বরূপ পরমাত্মার অব্যাহত স্বাধীনতাকে উপলব্ধি করা যায়। আত্মার কোন লিঙ্গ নাই। স্ত্রী-পুরুষ-ভেদ দেহেই। এই প্রসঙ্গে বক্তা সুইডনবর্গের দর্শন ও ধর্মের মধ্যে গভীরভাবে প্রবেশ করেন। হিন্দু বিশ্বাসসমূহের সহিত এই আধুনিক সাধু মহাপুরুষের আধ্যাত্মিক ভাবধারার সম্বন্ধ খুবই স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। মনে হইতেছিল সুইডনবর্গ যেন প্রাচীন এক হিন্দু ঋষির ইওরোপীয় উত্তরাধিকারী—যিনি এক সনাতন সত্যকে বর্তমান কালের পোষাক পরাইয়া উপস্থাপিত করিয়াছেন। শ্রেষ্ঠ ফরাসী দার্শনিক ও ঔপন্যাসিক (বালজাক?) তাঁহার ‘পূর্ণ আত্মা’র উদ্দীপনাময় প্রসঙ্গের মধ্যে এই ধরনের চিন্তাধারাকে অন্তর্ভুক্ত করা সমীচীন মনে করিয়াছেন। প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যেই পরিপূর্ণতা বিদ্যমান। তাহার শারীরিক সত্তার অন্ধকার গুহাগুলির ভিতর উহা যেন শুইয়া আছে। যদি বল, ভগবান্‌ তাঁহার পূর্ণতার কিছু অংশ মানুষকে দেন বলিয়াই মানুষ সৎ হয়, তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয়, পরম দেবতা ভগবানের পূর্ণতা হইতে পৃথিবীর মানুষকে প্রদত্ত ততটা অংশ বাদ গেল। বিজ্ঞানের অব্যর্থ নিয়ম হইতে প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক ব্যষ্টি আত্মার মধ্যে পূর্ণতা নিহিত, আর এই পূর্ণতাকে লাভ করার নামই মুক্তি—ব্যক্তিগত অনন্ততার উপলব্ধি। প্রকৃতি, ঈশ্বর, ধর্ম—তিনই তখন এক।

সব ধর্মই ভাল। এক গ্লাস জলের মধ্যে যে বাতাসের বুদ্বুদটি আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছে, উহা চেষ্টা করে বাহিরের অনন্ত বায়ুর সহিত যুক্ত হইতে। বাতাসের বুদ্বুদটি যদি তেল, ভিনিগার বা এইরূপ অন্যান্য বিভিন্ন ঘনত্ব বিশিষ্ট তরল পদার্থে আটক পড়ে, তাহা হইলে উহার মুক্তির চেষ্টা তরল পদার্থটির ঘনত্ব অনুযায়ী কম বেশী ব্যাহত হয়। জীবাত্মাও সেইরূপ বিভিন্ন দেহের মধ্য দিয়া উহার স্বকীয় অনন্ততা লাভের জন্য প্রয়াস করিয়া চলিয়াছে। আচার-ব্যবহার, পারিপার্শ্বিক ও বংশগত বৈশিষ্ট্য এবং জলবায়ুর প্রভাব—এই-সব দিক্ বিচার করিয়া কোন এক মানবগোষ্ঠীর পক্ষে একটি নির্দিষ্ট ধর্ম হয়তো সর্বাপেক্ষা উপযোগী। অনুরূপ কারণে আর একটি ধর্ম অপর এক মানবগোষ্ঠীর পক্ষে প্রশস্ত। বক্তার সিদ্ধান্তগুলির চুম্বক বোধ করি এই যে, যাহা কিছু আছে, সবই উত্তম। কোন একটি জাতির ধর্মকে হঠাৎ পরিবর্তন করিতে যাওয়া যেন—আল্পস্ পর্বত হইতে প্রবহমানা একটি নদীকে দেখিয়া কেন উহা তাহার বর্তমান পথটি লইয়াছে, সেই বিষয়ে সমালোচনা করা। আর এক ব্যক্তি হয়তো অভিমত প্রকাশ করিলেন যে, হিমালয় হইতে নিঃসৃতা একটি খরস্রোতা নদী হাজার হাজার বৎসর যে-পথে বহিয়া চলিয়াছে, ঐ পথ উহার পক্ষে স্বল্পতম এবং সুষ্ঠুতম পথ নয়।

খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী ঈশ্বরকে আমাদের পৃথিবীর ঊর্ধ্বে কোথাও উপবিষ্ট একজন ব্যক্তি বলিয়া কল্পনা করেন। কাজেই যে-স্বর্গে সোনার রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া মাঝে মাঝে নীচের মর্ত্যলোকের দিকে তাকাইয়া স্বর্গ-মর্ত্যের পার্থক্য বুঝা যায় না, এমন স্বর্গে তিনি স্বস্তিবোধ করিতে পারেন না। যাহাকে খ্রীষ্টানরা আচরণের ‘স্বর্ণোজ্জ্বল নীতি’৬ বলিয়া থাকেন, উহার পরিবর্তে হিন্দুরা এই নীতিতে বিশ্বাস করেন যে, যাহা কিছু ‘অহং’শূন্য তাহাই ভাল; এবং ‘আমিত্ব’-মাত্রই খারাপ, আর এই বিশ্বাস দ্বারা যথাকালে মানুষ তাহার আত্মার অনন্ত স্বরূপ ও মুক্তি লাভ করিতে পারিবে। বিবে কানন্দ বলেন, তথাকথিত ‘সোনার নীতি’টি কী ভয়ানক অমার্জিত! সর্বদাই ‘আমি, আমি’।

অন্যের নিকট হইতে তুমি নিজে যেরূপ আচরণ চাও, তুমিও তাহার প্রতি সেইরূপ আচরণ কর! ইহা এক ভীষণ বর্বরোচিত ক্রূর নীতি, কিন্তু বক্তা খ্রীষ্টধর্মের এই মতবাদের নিন্দা করিতে চান না, কেননা যাহারা ইহাতে সন্তুষ্ট, তাহারা ইহার সহিত নিজদিগকে বেশ মানাইয়া লইয়াছে, বুঝিতে হইবে। যে বিপুল জলধারাটি বহিয়া চলিয়াছে, উহাকে বহিতে দেওয়াই কর্তব্য। যিনি উহার গতিকে পরিবর্তিত করিতে চাইবেন, তিনি নির্বোধ। প্রকৃতিই প্রয়োজনমত সকল সমস্যার সমাধান করিয়া দিবেন। বিবে কানন্দ বেশ জোর দিয়াই বলেন যে, প্রেততত্ত্ববাদী বা অদৃষ্টবাদী—ইঁহারা সকলেই ভাল এবং খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীগণকে ধর্মান্তরিত করিবার তাঁহার কোন ইচ্ছা নাই। যাঁহারা খ্রীষ্টধর্ম অনুসরণ করিয়া চলিতেছেন, তাঁহারা বেশ ভালই করিতেছেন। তিনি যে হিন্দু, ইহাও উত্তম। তাঁহার দেশে বিভিন্ন স্তরের মেধাবিশিষ্ট লোকের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের ধর্মমত প্রচলিত আছে। সবটা মিলিয়া একটি ধারাবাহিক আধ্যাত্মিক ক্রমোন্নতি লক্ষিত হয়। হিন্দুধর্ম আমিত্বকে বড় করে না। ইহার আকাঙ্ক্ষাসমূহ কখনও মানুষের অহমিকাকে জড়াইয়া নয়, ইহা কখনও পুরস্কারের আশা বা শাস্তির ভয় তুলিয়া ধরে না। হিন্দুধর্ম বলে, ব্যক্তি-মানব তাহার ‘অহং’কে বর্জন করিয়া অনন্তত্ব লাভ করিতে পারে।

মানুষকে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণের জন্য প্রলোভিত করিবার রীতি—ভগবান্ স্বয়ং পৃথিবীর একটি মানবগোষ্ঠীর নিকট প্রকট হইয়া ইহা প্রবর্তন করিয়াছেন বলা হইয়া থাকে—বস্তুতঃ অতি নিষ্ঠুর এবং ভয়াবহরূপে দুর্নীতিজনক। ধর্মান্ধগণ খ্রীষ্টীয় মতবাদ যদি আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করে, তাহা হইলে উহা তাহাদের নৈতিক স্বভাবের উপর একটি লজ্জাকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে আত্মার অনন্ততা উপলব্ধির সময় পিছাইয়া যায়।

ডেট্রয়েট ট্রিবিউন, ১৮ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪

গতরাত্রে ইউনিটেরিয়ান চার্চে বক্তৃতা-প্রসঙ্গে স্বামী বিবে কানন্দ বলেন যে, ভারতে ধর্ম বা সামাজিক নিয়মের বশে বিধবাদের কখনও জোর করিয়া জীবন্ত দাহ করা হয় নাই। এই ঘটনাগুলির সব ক্ষেত্রেই তাঁহারা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করিয়াছেন। পূর্বে ভারতের একজন সম্রাট্ সতীদাহ প্রথা বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু ক্রমশঃ পরে উহা আবার প্রচলিত হয়। অবশেষে ইংরেজ সরকার উহা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেন। সকল ধর্মেই একশ্রেণীর লোক আছে, যাহারা ধর্মোন্মাদ। ইহা খ্রীষ্টধর্মে যেমন, হিন্দুধর্মেও তেমনি। ভারতে এমন সব ধর্মোন্মাদ দেখা যায়, যাহারা তপশ্চরণের নামে দিনের পর দিন সর্বক্ষণ মাথার উপরে হাত তুলিয়া রাখে। দীর্ঘকাল ঐরূপ করিবার ফলে হাতটি ক্রমে অসাড় হইয়া যায় এবং আজীবন ঐ অবস্থায় থাকে। কেহ কেহ ব্রত গ্রহণ করে—একভাবে নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিবার। ক্রমে ইহাদের শরীরের নীচের দিকে সম্পূর্ণ অবশ হইয়া যায় এবং উহারা আর হাঁটিতে পারে না।

সব ধর্মই সত্য। মানুষ নৈতিকতা অনুশীলন করে, কোন দৈবাদেশের জন্য নয়, উহা ভাল বলিয়াই করে। হিন্দুরা ধর্মান্তরিত-করণে বিশ্বাস করে না। বক্তা বলেন, উহা অপচেষ্টা। অধিকাংশ ধর্মের পিছনে কত ঐতিহ্য, শিক্ষাদীক্ষা এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা রহিয়াছে। অতএব কোন এক ধর্মপ্রচারকের পক্ষে অন্য ধর্মাবলম্বী কাহারও ধর্মবিশ্বাসসমূহকে ভুল বলিয়া ঘোষণা করা কী নির্বুদ্ধিতা! ইহা যেন কোন এশিয়াবাসীর আমেরিকায় আসিয়া মিসিসিপি নদীর গতিপথ দেখিবার পর ঐ নদীকে ডাকিয়া বলা, ‘তুমি সম্পূর্ণ ভুল পথে প্রবাহিত হইতেছ। তোমাকে উৎপত্তি-স্থানে ফিরিয়া নূতন করিয়া যাত্রা শুরু করিতে হইবে।’ আবার আমেরিকাবাসী কেহ যদি আল্পস্ পর্বতে গিয়া জার্মান সাগরে পড়িতেছে এমন কোন নদীকে বলে যে, তাহার গতিপথ অত্যন্ত আঁকাবাঁকা এবং ইহার একমাত্র প্রতিকার হইল নূতন নির্দেশ অনুসারে প্রবাহিত হওয়া—তাহা হইলে উহাও একই প্রকার নির্বুদ্ধিতা হইবে। বক্তা বলেন যে, খ্রীষ্টানরা যাহাকে ‘সোনার নিয়ম’ বলেন, উহা মাতা বসুন্ধরার মতই পুরাতন। নৈতিকতার যাবতীয় বিধানেরই উৎপত্তি এই নিয়মটির মধ্যেই খুঁজিয়া পাওয়া যায়। মানুষ তো স্বার্থপরতার একটি পুঁটলি বিশেষ।

বক্তা বলেন যে, পাপীরা নরকাগ্নিতে অনন্তকাল শাস্তি ভোগ করিবে—এই মতবাদ সম্পূর্ণ অর্থহীন। দুঃখ রহিয়াছে, ইহা যখন জানা কথা, তখন পূর্ণ সুখ কি করিয়া সম্ভব? বক্তা কোন কোন তথাকথিত ধার্মিক ব্যক্তির প্রার্থনা করিবার রীতিকে বিদ্রূপ করেন। তিনি বলেন যে, হিন্দু চোখ বুজিয়া অন্তরাত্মার উপাসনা করে, কিন্তু কোন কোন খ্রীষ্টানকে প্রার্থনার সময় তিনি কোন একটি দিকে তাকাইয়া থাকিতে দেখিয়াছেন, যেন স্বর্গের সিংহাসনে উপবিষ্ট ভগবানকে তাঁহারা দেখিতে পাইতেছেন! ধর্মের ব্যাপারে দুটি চরম হইল—ধর্মান্ধ এবং নাস্তিক। যে নাস্তিক, তাহার কিছু ভাল দিক্‌ আছে, কিন্তু ধর্মান্ধের বাঁচিয়া থাকা শুধু তাহার ক্ষুদ্র ‘আমি’টার জন্যই। জনৈক অজ্ঞাত ব্যক্তি বক্তাকে যীশুর হৃদয়ের একটি ছবি পাঠাইয়াছেন। এইজন্য তাঁহাকে তিনি ধন্যবাদ দিতেছেন, তবে তাঁহার মতে, ইহা গোঁড়ামির অভিব্যক্তি। ধর্মান্ধকে কোন ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করা চলে না। তাহারা একটি অভিনব বস্তুবিশেষ।

=========

ভগবৎপ্রেম

ভগবৎপ্রেম

ডেট্রয়েট ট্রিবিউন, ২১ ফেব্র্রুয়ারী, ১৮৯৪

গত রাত্রে বিবে কানন্দের বক্তৃতা শুনিবার জন্য প্রথম ইউনিটেরিয়ান চার্চে খুব ভিড় হইয়াছিল। শ্রোতৃমণ্ডলী আসিয়াছিলেন জেফারসন এভিনিউ এবং উডওয়ার্ড এভিনিউ-এর উত্তরাংশ হইতে। তাঁহাদের অধিকাংশই মহিলা। ইঁহারা বক্তৃতাটিতে খুব আকৃষ্ট হইয়াছিলেন, মনে হইল। ব্রাহ্মণ বক্তার অনেকগুলি মন্তব্য সোৎসাহে হর্ষধ্বনি দ্বারা এই মহিলারা সমর্থন করিতেছিলেন।

বক্তা যে-প্রেমের বিষয় আলোচনা করিলেন, উহা যৌন আকর্ষণের সহিত সংশ্লিষ্ট ভাবাবেগ নয়। ভারতে ভগবদ্ভক্ত ঈশ্বরের জন্য যে নিষ্কলুষ পবিত্র অনুরাগ বোধ করেন, উহা সেই ভালবাসা। বিবে কানন্দ তাঁহার ভাষণের প্রারম্ভে আলোচ্য বিষয়টি এই বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিলেনঃ ‘ভারতীয় তাহার ভগবানের জন্য যে প্রীতি অনুভব করে।’ কিন্তু বলিবার সময় তিনি এই ঘোষিত বিষয়ের সীমার মধ্যে থাকেন নাই। বরং বক্তৃতার বেশীর ভাগ ছিল খ্রীষ্টধর্মের প্রতি আক্রমণ। ভারতীয়ের ধর্ম এবং ভগবৎপ্রেম সম্বন্ধে আলোচনা ছিল উহার গৌণ অংশ। বক্তৃতার অনেক বিষয় ভারতেতিহাসের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের কতকগুলি প্রাসঙ্গিক কাহিনীর সাহায্যে বিশদীকৃত হয়। এই কাহিনীগুলির পাত্র ভারতবর্ষের বিখ্যাত মোগল সম্রাটগণ, হিন্দুরাজগণ নয়।

বক্তা ধর্মাচার্যগণকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করেন—জ্ঞানমার্গের পথিক ও ভক্তিপথের অনুগামী। প্রথম শ্রেণীর জীবনের লক্ষ্য হইল প্রত্যক্ষ অনুভূতি, দ্বিতীয়ের ভগবৎপ্রেম। বক্তা বলেন, প্রেম হইল আত্মত্যাগ। প্রেম কিছু গ্রহণ করে না সর্বদাই দিয়া যায়। হিন্দু ভক্ত ভগবানের কাছে কোন কিছু চায় না, মুক্তি বা পারলৌকিক সুখের জন্য কখনও প্রার্থনা করে না। সে তাহার সকল চেতনা অনুরাগের গাঢ় উল্লাসে প্রেমাস্পদ ভগবানের প্রতি নিযুক্ত করে। ঐ সুন্দর অবস্থা লাভ করা সম্ভবপর তখনই, যখন মানুষ ভগবানের জন্য গভীর অভাব বোধ করিতে থাকে। তখন ভগবান্ তাঁহার পরিপূর্ণ সত্তায় ভক্তের নিকট আবির্ভূত হন।

ঈশ্বরকে আমরা তিনভাবে ধারণা করিতে পারি। একটি হইল—তাঁহাকে এক বিরাট ক্ষমতাবান্ পুরুষ বলিয়া মনে করা এবং মাটিতে পড়িয়া তাঁহার মহিমার স্তুতি করা। দ্বিতীয়ঃ তাঁহাকে পিতৃদৃষ্টিতে ভক্তি করা। ভারতে পিতাই সব সময় সন্তানদের শাসন করেন। সেই জন্য পিতার উপর ভক্তিশ্রদ্ধায় খানিকটা ভয়ও মিশিয়া থাকে। আরও একটি ভাব হইল ভগবানকে ‘মা’ বলিয়া চিন্তা করা। ভারতে জননী সর্বদাই যথার্থ ভালবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্রী। তাই ঈশ্বরের প্রতি মাতৃভাব ভারতে খুব স্বাভাবিক।

কানন্দ বলেন যে, যথার্থ ভক্ত ভগবদনুরাগে এত বিভোর থাকেন যে অপর ধর্মাবলম্বীদের নিকট গিয়া তাহারা ভুল পথে ঈশ্বর সাধনা করিতেছে, ইহা বলিবার এবং তাহাদিগকে স্বমতে আনিবার জন্য চেষ্টা করিবার সময় তাঁহার নাই।

ডেট্রয়েট জার্নাল, ২১ ফেব্র্রুয়ারী, ১৮৯৪

‘একটি শখ মাত্র।’—

আধুনিক কালের ধর্ম সম্বন্ধে ইহাই বিবে কানন্দের অভিমত! ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী বিবে কানন্দ, যিনি এই ডেট্রয়েট শহরে কতকগুলি ধারাবাহিক বক্তৃতা দিতেছেন, যদি আরও এক সপ্তাহ এখানে থাকিতে রাজী হন, তাহা হইলে শহরের বৃহত্তম হলঘরটিতেও তাঁহার আগ্রহশীল শ্রোতৃমণ্ডলীর স্থান কুলাইবে না। তিনি এখানে দস্তুরমত একটি আকর্ষণ হইয়া পড়িয়াছেন। গতকল্য সন্ধ্যায় ইউনিটেরিয়ান চার্চের প্রত্যেকটি আসন ভরিয়া যায়; বহু লোককে বাধ্য হইয়া বক্তৃতার সারা সময় দাঁড়াইয়া থাকিতে হইয়াছিল।

বক্তার আলোচ্য বিষয় ছিল ‘ভগবৎপ্রেম’। প্রেমের সংজ্ঞা তিনি দিলেন—‘যাহা সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ, যাহাকে ভালবাসি তাহার স্তুতি ও ভজনা ব্যতীত যাহার অপর কোন উদ্দেশ্য নাই।’ বক্তা বলেন, প্রেম এমন একটি গুণ, যাহা বিনীতভাবে পূজা করিয়া যায় এবং প্রতিদানে কিছুই চায় না। ভগবৎপ্রেম জাগতিক ভালবাসা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্‌। সাধারণতঃ স্বার্থসিদ্ধির জন্য ছাড়া ভগবানকে আমরা চাই না। বক্তা নানা গল্প ও উদাহরণ দ্বারা দেখান, আমাদের ভগবদর্চনার পিছনে স্বার্থবুদ্ধি কিভাবে নিহিত থাকে। বক্তা বলেন, খ্রীষ্টীয় বাইবেলের সর্বাপেক্ষা চমৎকার অংশ হইল ‘সলোমনের গীতি’; তবে তিনি শুনিয়া অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছেন যে, এই অংশকে বাইবেল হইতে বাদ দিবার সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে। বক্তা শেষের দিকে যেন এক প্রকার চূড়ান্ত যুক্তিস্বরূপ বলিলেন, ‘ইহা হইতে কতটা লাভ আদায় করিতে পারি’—এই নীতির উপরই আমাদের ঈশ্বর-প্রেম স্থাপিত দেখা যাইতেছে। ভগবানকে ভালবাসিবার সহিত খ্রীষ্টানদের এত স্বার্থবুদ্ধি জড়িত থাকে যে, তাহারা সর্বদাই তাঁহার নিকট কিছু না কিছু চাহিয়া থাকে। নানাপ্রকারের ভোগ-সামগ্রীও তাহার অন্তর্ভুক্ত। অতএব বর্তমানকালের ধর্ম একটা শখ ও ফ্যাশন মাত্র, আর মানুষ ভেড়ার পালের মত গীর্জায় ভিড় করে।

===========

ভারতীয় নারী

ডেট্রয়েট ফ্রী প্রেস, ২৫ মার্চ, ১৮৯৪

কানন্দ গতরাত্রে ইউনিটেরিয়ান চার্চে-এ ‘ভারতীয় নারী’ সম্বন্ধে বক্তৃতা দেন। তিনি প্রাচীন ভারতের নারীগণের প্রসঙ্গে বলেন যে, শাস্ত্রগ্রন্থসমূহে তাঁহাদিগকে গভীর শ্রদ্ধা দেখান হইয়াছে। অনেক নারী ঋষিত্ব লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহাদের আধ্যাত্মিকতা তখন ছিল খুবই প্রশংসনীয়। প্রাচ্যের নারীগণকে প্রতীচ্যের আদর্শে বিচার করা ঠিক নয়। পাশ্চাত্যে নারী হইলেন পত্নী, প্রাচ্যে তিনি জননী। হিন্দুরা মাতৃভাবের পূজারী। সন্ন্যাসীদের পর্যন্ত গর্ভধারিণী জননীর সম্মুখে ভূমিতে কপাল ঠেকাইয়া সম্মান দেখাইতে হয়। ভারতে পবিত্রতার স্থান খুব উঁচুতে। কানন্দ এখানে যে-সব ভাষণ দিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে একটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। সকলে উহা খুব পছন্দ করিয়াছেন।

ডেট্রয়েট ইভনিং নিউজ, ২৫ মার্চ, ১৮৯৪

গতরাত্রে ইউনিটেরিয়ান চার্চে-এ স্বামী বিবে কানন্দের বক্তৃতার বিষয় ছিল—‘প্রাচীন, মধ্য ও বর্তমান যুগে ভারতীয় নারী’। তিনি বলেন, ভারতবর্ষে নারীকে ভগবানের সাক্ষাৎ প্রকাশ বলিয়া মনে করা হয়। নারীর সমগ্র জীবনে এই একটি চিন্তা তাঁহাকে তৎপর রাখে যে, তিনি মাতা; আদর্শ মাতা হইতে গেলে তাহাকে খুব পবিত্র থাকিতে হইবে। ভারতে কোন জননী কখনও তাহার সন্তানকে ত্যাগ করে নাই। বক্তা বলেন, ইহার বিপরীত প্রমাণ করিবার জন্য তিনি সকলকে আহ্বান করিতেছেন। ভারতের মায়েরা যদি আমেরিকান তরুণীদের মত শরীরের অর্ধেক ভাগ যুবকদের কুদৃষ্টির সামনে খুলিয়া রাখিতে বাধ্য হইত, তাহা হইলে তাহারা মরিয়া যাইত। বক্তা ইচ্ছা করেন যে, ভারতকে তাহার নিজস্ব আদর্শে বিচার করা উচিত, এই দেশের আদর্শে নয়।

ট্রিবিউন, ১ এপ্রিল, ১৮৯৪

স্বামী বিবে কানন্দের ডেট্রয়েটে অবস্থান কালে নানা কথোপকথনে তিনি ভারতীয় নারীগণ সম্পর্কে কতকগুলি প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি যে-সব তথ্য উপস্থাপিত করেন, তাহাতে শ্রোতাদের কৌতূহল উদ্দীপিত হয় এবং ঐ বিষয়ে সর্বসাধারণের জন্য একটি বক্তৃতা দিবার অনুরোধ আসে। কিন্তু তিনি বক্তৃতার সময় কোন স্মারকলিপি না রাখায় ভারতীয় নারী সম্বন্ধে পূর্বে ব্যক্তিগত কথোপকথনের সময় যে-সব বিষয় বলিয়াছিলেন, তাহা ঐ বক্তৃতায় বাদ পড়িয়া গিয়াছিল। ইহাতে তাঁহার বন্ধুবর্গ কিছুটা নিরাশ হন, কিন্তু তাঁহার মহিলা শ্রোতাদের মধ্যে জনৈক তাঁহার অপরাহ্নের কথোপকথনের কিছু প্রসঙ্গ সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন। উহা এখন হইতে সর্বপ্রথম সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য দেওয়া হইতেছেঃ

আকাশচুম্বী হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে বিস্তীর্ণ সমতলভূমিতে আর্যগণ আসিয়া বসবাস করেন। এখনও পর্যন্ত ভারতে তাঁহাদের বংশধর খাঁটি ব্রাহ্মণ-জাতি বিদ্যমান। পাশ্চাত্য লোকের পক্ষে স্বপ্নেও এই উন্নত মানবগোষ্ঠীর ধারণা করা অসম্ভব। চিন্তায় কাজে এবং আচরণে ইঁহারা অতিশয় শুচি। ইঁহারা এত সাধুপ্রকৃতির যে, একথলি সোনা যদি প্রকাশ্যে পড়িয়া থাকে তো তাঁহাদের কেহ উহা লইবেন না। কুড়ি বৎসর পরেও ঐ থলিটি একই জায়গায় পাওয়া যাইবে। এই ব্রাহ্মণদের শারীরিক গঠনও অতি চমৎকার। কানন্দের নিজের ভাষায়ঃ ‘ক্ষেতে কর্মনিরতা ইঁহাদের একটি কন্যাকে দেখিলে মন বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়, আশ্চর্য হইয়া ভাবিতে হয়—ভগবান্ এমন অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতিমা কি করিয়া গড়িলেন!’ এই ব্রাহ্মণদের অবয়ব-সংস্থান সুসম্বদ্ধ, চোখ ও চুল কৃষ্ণবর্ণ এবং গায়ের রঙ—আঙুল ছুঁচবিদ্ধ করিলে উহা হইতে একটি রক্তবিন্দু যদি এক গ্লাস দুধে পড়ে, তাহা হইলে যে রঙ সৃষ্ট হয়, সেই রঙের। অবিমিশ্র বিশুদ্ধ হিন্দু ব্রাহ্মণদের ইহাই বর্ণনা।

হিন্দু নারীর উত্তরাধিকারের আইন-কানুন সম্বন্ধে বক্তা বলেন, বিবাহের সময় স্ত্রী যে যৌতুক পান, উহা সম্পূর্ণ তাঁহার ব্যক্তিগত সম্পত্তি; উহাতে স্বামীর কখনও মালিকানা থাকে না। স্বামীর সম্মতি বিনা আইনতঃ তিনি উহা বিক্রয় বা দান করিতে পারেন। সেইরূপ অন্য সূত্রে, তথা স্বামীর নিকট হইতেও তিনি যে-সকল অর্থাদি পান, উহা তাঁহার নিজস্ব সম্পত্তি, তাঁহার ইচ্ছামত ব্যয় করিতে পারেন।

স্ত্রীলোক বাহিরে নির্ভয়ে বেড়াইয়া থাকেন। চারি পাশের লোকদের উপর তাঁহার পূর্ণ বিশ্বাস আছে বলিয়াই ইহা সম্ভব হয়। হিমালয়ে পর্দাপ্রথা নাই। ওখানে এমন অঞ্চল আছে যেখানে মিশনরীরা কখনও পৌঁছিতে পারেন না। এইসব গ্রাম খুবই দুর্গম। অনেক চড়াই করিয়া এবং পরিশ্রমে ঐ-সকল জায়গায় পৌঁছান যায়। এখানকার অধিবাসীরা কখনও মুসলমান-প্রভাবে আসে নাই। খ্রীষ্টধর্মও ইহাদের নিকট অজানা।
====================

ভারতের প্রথম অধিবাসীরা

ভারতের অরণ্যে এখনও কিছু কিছু বনবাসী অসভ্য লোক দেখা যায়। তাহারা অত্যন্ত বর্বর, এমন কি নরমাংসভোজী। ইহারাই দেশের আদিম অধিবাসী এবং কখনও আর্য বা হিন্দু হয় নাই। আর্যগণ ভারতে স্থায়ী বসবাস আরম্ভ করিলে এবং দেশের ভূভাগে ছড়াইয়া পড়িলে তাঁহাদের মধ্যে ক্রমশঃ নানাপ্রকার বিকৃতি প্রবেশ করে। সূর্যতাপও ছিল প্রচণ্ড। খর রৌদ্রে অনেকের গায়ের রঙ ক্রমশঃ কালো হইয়া যায়। হিমালয়পর্বতবাসী শ্বেতকায় লোকের উজ্জ্বল বর্ণ সমতলভূমির হিন্দুদের তাম্রবর্ণে পরিবর্তিত হওয়া তো কেবলমাত্র পাঁচ পুরুষের ব্যাপার। কানন্দের একটি ভাই আছেন, তিনি খুব ফর্সা, আবার দ্বিতীয় আর একটি ভাই-এর রঙ কানন্দের চেয়ে ময়লা। তাঁহার পিতামাতা গৌরবর্ণ। মুসলমানদের অত্যাচার হইতে নারীদের রক্ষা করার জন্যই নিষ্ঠুর পর্দাপ্রথার উদ্ভব হইয়াছিল। গৃহে আবদ্ধ থাকিবার দরুন হিন্দু রমণীদের গায়ের রঙ পুরুষদের অপেক্ষা পরিষ্কার। কানন্দের বয়স একত্রিশ বৎসর।

=========================

আমেরিকান পুরুষদের প্রতি কটাক্ষ

কানন্দ চোখের কোণে ঈষৎ কৌতুক মিশাইয়া বলেন যে, আমেরিকান পুরুষদের দেখিয়া তিনি আমোদ অনুভব করেন। তাঁহারা প্রচার করিয়া বেড়ান যে, স্ত্রীজাতি তাঁহাদের পূজার পাত্র, কিন্তু তাঁহার মতে আমেরিকানরা পূজা করেন রূপ ও যৌবনকে। তাঁহাদিগকে কখনও তো বলিরেখা বা পক্ক কেশের সহিত প্রেমে পড়িতে দেখা যায় না! বক্তা বলেন, প্রকৃতপক্ষে তাঁহার দৃঢ় ধারণা এই যে, এক সময়ে বৃদ্ধা নারীদের পোড়াইয়া মারিবার জন্য মার্কিন পুরুষদের পুরুষানুক্রমে পাওয়া একটি কৌশল ছিল। বর্তমান ইতিহাস ইহার নাম দিয়াছে—ডাইনী-দহন। পুরুষরাই ডাইনীদের অভিযুক্ত করিত, আর সাধারণতঃ অভিযুক্তার জরাই ছিল তাহার প্রাণদণ্ডের কারণ। অতএব দেখা যাইতেছে, জীবন্ত নারীকে দগ্ধ করা শুধু যে একটি হিন্দুরীতি, তাহা নয়। বক্তার মতে খ্রীষ্টীয় গীর্জার তরফ হইতে এক সময়ে বৃদ্ধা স্ত্রীলোকদের অগ্নিদগ্ধ করা হইত, ইহা স্মরণ রাখিলে হিন্দু বিধবাদের সহমরণ-প্রথার কথা শুনিয়া পাশ্চাত্য সমালোচকদের আতঙ্ক কম হইবে।

==============

উভয় দাহের তুলনা

উভয় দাহের তুলনা

হিন্দু বিধবা যখন মৃত পতির সহিত স্বেচ্ছায় অগ্নিতে প্রবেশ করিয়া মৃত্যু বরণ করিতেন, তখন ভুরিভোজন এবং সঙ্গীতাদিসহ একটি উৎসবের পরিবেশ সৃষ্ট হইত। মহিলা নিজে তাঁহার সর্বাপেক্ষা দামী বস্ত্র পরিতেন। তিনি বিশ্বাস করিতেন, স্বামীর সহিত সহমরণে তাঁহার নিজের এবং পরিবারবর্গের স্বর্গলোকে গতি হইবে। আত্মবলিদাত্রীরূপে তাঁহাকে সকলে পূজা করিত এবং তাঁহার নাম পরিবারের বিবরণীতে গৌরবান্বিত হইয়া থাকিত।

সহমরণ-প্রথা আমাদের নিকট যত নৃশংসই মনে হউক, খ্রীষ্টীয় সমাজের ডাইনী-দহনের তুলনায় ইহার একটা উজ্জ্বল দিক্‌ রহিয়াছে। যে-স্ত্রীলোককে ডাইনী বলিয়া ঘোষণা করা হইত, গোড়া হইতেই তাহাকে পাপী সাব্যস্ত করা হইত। তারপর একটি বদ্ধ কারাকক্ষে তাহাকে আবদ্ধ করিয়া পাপ স্বীকারের জন্য চলিত নিষ্ঠুর নির্যাতন এবং ঘৃণিত বিচার-প্রহসন। অবশেষে শাস্তিদাতাদের হর্ষধ্বনির মধ্যে বেচারীকে টানিয়া বধ্যস্থানে লইয়া যাওয়া হইত। বলপূর্বক অগ্নিদাহের যন্ত্রণার মধ্যে তাহার সান্ত্বনা থাকিত শুধু দর্শকবৃন্দের আশ্বাস যে, মৃত্যুর পর অনন্ত নরকাগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হইয়া তাহার আত্মার ভাগ্যে ভবিষ্যতের যে ভীষণতর কষ্ট লেখা আছে, বর্তমান কষ্ট শুধু তাহার সামান্য একটি নিদর্শন।

==============

জননীগণ আরাধ্যা

কানন্দ বলেন যে, হিন্দুরা মাতৃ-ভাবটির পূজা করিতে শিক্ষা পায়। মায়ের স্থান পত্নীর ঊর্ধ্বে। মা হলেন আরাধনার পাত্রী। হিন্দুদের মনে ঈশ্বরের পিতৃভাব অপেক্ষা মাতৃভাবটিই বেশী স্থান পায়।

ভারতে কোন জাতির স্ত্রীলোককেই অপরাধের জন্য কঠিন শারীরিক শাস্তি দেওয়ার বিধান নাই। হত্যা-অপরাধ করিলেও নারী প্রাণদণ্ড হইতে অব্যাহতি পায়। বরং অপরাধিনীকে গাধার পিঠে লেজের দিকে মুখ করিয়া বসাইয়া রাস্তায় ঘুরান হয়। একজন ঢোল পিটাইয়া তাহার অপরাধ উচ্চৈঃস্বরে জানাইয়া যায়; পরে তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়া হয়। তাহার এই অবমাননাকেই যথেষ্ট শাস্তি এবং ভবিষ্যতে অপরাধের পুনরাবৃত্তির প্রতিষেধক বলিয়া মনে করা হয়। অপরাধিনী প্রায়শ্চিত্ত করিতে চাহিলে নানা ধর্মপ্রতিষ্ঠানে গিয়া অনুষ্ঠান করিবার সুযোগ পায় এবং এইভাবে সে পুনরায় শুচি হইতে পারে। অথবা সে স্বেচ্ছায় সংসার ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাস-আশ্রমে প্রবেশপূর্বক যথার্থ নিষ্পাপ জীবন লাভ করিতে পারে।

মিঃ কানন্দকে প্রশ্ন করা হয় যে, এইভাবে অপরাধিনী নারী সন্ন্যাসী-আশ্রমে প্রবেশ করিবার অনুমতি পাইলে এবং সমাজ-শাসন এড়াইয়া গেলে পবিত্র ঋষিদের প্রতিষ্ঠিত আশ্রমে ভণ্ডামির স্থান দেওয়া হয় কিনা। কানন্দ উহা স্বীকার করিলেন, তবে ব্যাখ্যা করিয়া ইহাও বুঝাইয়া দিলেন যে, জনসাধারণ ও সন্ন্যাসীর মধ্যে অপর কেহ অন্তর্বর্তী নাই। সন্ন্যাসী সকল জাতির গণ্ডী ভাঙিয়া দিয়াছেন। একজন ব্রাহ্মণ নিম্নবর্ণের কোন হিন্দুকে হয়তো স্পর্শ করিবেন না, কিন্তু ঐ ব্যক্তি যদি সন্ন্যাস গ্রহণ করে, তাহা হইলে অত্যন্ত অভিজাত ব্রাহ্মণও তাহার পায়ে লুটাইয়া পড়িতে সঙ্কুচিত হইবেন না।

গৃহস্থেরা সন্ন্যাসীর ভরণ-পোষণের ভার গ্রহণ করে, তবে যতক্ষণ পর্যন্ত তাহার সাধুতা সম্বন্ধে তাহাদের বিশ্বাস আছে। সন্ন্যাসীর ভণ্ডামি ধরা পড়িলে তাহাকে সকলে মিথ্যাচারী বলিয়া মনে করে। তাহার জীবন তখন অধম ভিক্ষুকের জীবন মাত্র। কেহ তাহাকে আর শ্রদ্ধা করে না।
=============

অন্যান্য চিন্তাধারা

নারী রাজা অপেক্ষাও অধিক সম্মান ও সুবিধা ভোগ করেন। যখন গ্রীক পণ্ডিতেরা হিন্দুজাতির সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করিতে হিন্দুস্থানে আসিয়াছিলেন, তখন সকল গৃহের দ্বারই তাঁহাদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু মুসলমানরা যখন তাহাদের তরবারি এবং ইংরেজগণ তাহাদের গুলিগোলা লইয়া দেখা দিল, তখন সব দরজাই বন্ধ করা হইল। এই ধরনের অতিথিকে কেহ স্বাগত জানায় নাই। কানন্দ যেমন মিষ্ট করিয়া বলেন, ‘যখন বাঘ আসে, তখন আমরা আমাদের দরজা জানালা বন্ধ রাখি, যতক্ষণ না বাঘ চলিয়া যায়।’

কানন্দ বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকা তাঁহাকে বহুতর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার জন্য উদ্দীপনা দিয়াছে, তবে আমাদের তথা জগতের নিয়তি আজিকার আইন-প্রণেতার উপর অপেক্ষা করিতেছে না, উহা অপেক্ষা করিতেছে নারীজাতির উপর। কানন্দের উক্তিঃ ‘তোমাদের দেশের মুক্তি দেশের নারীগণের উপরই নির্ভর করে।’
==============

ধর্মে দোকানদারি

[মিনিয়াপলিস্ শহরে ১৮৯৩ খ্রীঃ, ২৬ নভেম্বর প্রদত্ত বক্তৃতার ‘মিনিয়াপলিস্ জার্নাল’ পত্রিকায় প্রকাশিত বিবরণ।]

চিকাগো ধর্ম-মহাসভার খ্যাতিমান্ ব্রাহ্মণ পুরোহিত স্বামী বিবেকানন্দের প্রাচ্যদেশীয় ধর্ম-ব্যাখ্যান হইতে কিছু শিখিতে উদ‍্গ্রীব শ্রোতৃমণ্ডলী গতকল্য সকালে ইউনিটেরিয়ান চার্চ-এ ভিড় করিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণ্যধর্মের এই বিশিষ্ট প্রতিনিধিকে এই শহরে আমন্ত্রণ করিয়া আনিয়াছেন ‘পেরিপ্যাটেটিক ক্লাব’। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ঐ প্রতিষ্ঠানে তাঁহার বক্তৃতা হয়। গতকল্যকার বক্তৃতার জন্য তাঁহাকে এই সপ্তাহ পর্যন্ত এখানে থাকিতে অনুরোধ করা হইয়াছিল।

প্রারম্ভিক প্রার্থনার পর ধর্মযাজক ডক্টর এইচ. এম. সিমন‍্স‍্—‘বিশ্বাস, আশা এবং দান’ সম্বন্ধে সেণ্ট পলের উক্তি পাঠ করেন। সেণ্ট পল যে বলিয়াছেন, ‘ইহাদের ভিতর দানই হইল সর্বোত্তম’—ইহার সমর্থনে ডক্টর সিমন‍্স‍্ ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্রের একটি শিক্ষা, মোসলেম ধর্মমতের একটি বচন এবং হিন্দু সাহিত্য হইতে কয়েকটি কবিতা পাঠ করেন। এই উক্তির সহিত সেণ্ট পলের কথার সামঞ্জস্য রহিয়াছে।

দ্বিতীয় প্রার্থনা সঙ্গীতের পর স্বামী বিবেকান্দিকে শ্রোতৃমণ্ডলীর নিকট পরিচিত করিয়া দেওয়া হয়। তিনি বক্তৃতামঞ্চের ধারে আসিয়া দাঁড়ান এবং গোড়াতেই একটি হিন্দু উপাখ্যান বলিয়া সকলের চিত্ত আকৃষ্ট করেন। উৎকৃষ্ট ইংরেজীতে তিনি বলেনঃ

তোমাদিগকে আমি পাঁচটি অন্ধের একটি গল্প বলিব। ভারতের কোন গ্রামে একটি শোভাযাত্রা চলিতেছে। উহা দেখিবার জন্য অনেক লোকের ভিড় হইয়াছে। বহু আড়ম্বরে সুসজ্জিত একটি হাতী ছিল সকলের বিশেষ আকর্ষণ। সকলেই খুব খুশী। পাঁচজন অন্ধও দর্শকের সারির মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। তাহারা তো চোখে দেখিতে পায় না, তাই ঠিক করিল হাতীকে স্পর্শ করিয়া বুঝিয়া লইবে জানোয়ারটি কেমন। ঐ সুযোগ তাহাদিগকে দেওয়া হইল। শোভাযাত্রা চলিয়া গেলে সকলের সহিত তাহারা বাড়ী ফিরিয়া আসিয়াছে। তখন হাতীর সম্বন্ধে কথাবার্তা শুরু হইল।

একজন বলিল, ‘হাতী হইতেছে ঠিক দেওয়ালের মত।’ দ্বিতীয় বলিল, ‘না, তা তো নয়, উহা হইল দড়ির মত।’ তৃতীয় অন্ধ কহিল, ‘দূর, তোমার ভুল হইয়াছে, আমি যে নিজে হাত দিয়া দেখিয়াছি, উহা ঠিক সাপের মত।’ আলোচনায় উত্তেজনা বাড়িয়া চলিল, তখন চতুর্থ অন্ধ বলিল যে, হাতী হইল ঠিক যেন একটি বালিশ। ক্রুদ্ধ বাদপ্রতিবাদে অবশেষে পঞ্চম অন্ধ মারামারি শুরু করিল। তখন একজন চক্ষুষ্মান্ ব্যক্তি ঘটনাস্থলে আসিয়া উপস্থিত। সে জিজ্ঞাসা করিল, ‘বন্ধুগণ ব্যাপার কি?’ ঝগড়ার কারণ বলা হইলে আগন্তুক কহিল, ‘মহাশয়রা, আপনাদের সকলের কথাই ঠিক। মুশকিল এই যে, আপনারা হাতীর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় স্পর্শ করিয়াছেন। হাতীর পাশ হইল দেওয়ালের মত। লেজকে তো দড়ি মনে হইবেই। উহার শুঁড় সাপের মত বলা চলে, আর যিনি পায়ের পাতা ছুঁইয়া দেখিয়াছেন, তিনি ঠিকই বলিয়াছেন যে, হাতী বালিশের মত। এখন আপনারা ঝগড়া থামান। বিভিন্ন দিক্‌ দিয়া হাতীর সম্বন্ধে আপনারা সকলেই সত্য কথা বলিয়াছেন।’

বক্তা বলেনঃ ধর্মেও এই ধরনের মতদ্বৈধ দেখা দিয়াছে। পাশ্চাত্যের লোক মনে করে, তাহারাই একমাত্র ঈশ্বরের খাঁটি ধর্মের অধিকারী; আবার প্রাচ্যদেশের লোকেরও নিজেদের ধর্ম সম্বন্ধে অনুরূপ গোঁড়ামি বিদ্যমান। উভয়েরই ধারণা ভুল। বস্তুতঃ ঈশ্বর প্রত্যেক ধর্মেই রহিয়াছেন।

প্রতীচীর চিন্তাধারা সম্বন্ধে বক্তা অনেক স্পষ্ট সমালোচনা করেন। তাঁহার মতে খ্রীষ্টানদের মধ্যে ‘দোকানদারী’ ধর্মের লক্ষণ দেখা যাইতেছে। তাঁহাদের প্রার্থনাঃ হে ঈশ্বর আমাকে ইহা দাও, উহা দাও; হে প্রভু তুমি আমার জন্য ইহা কর, উহা করা। হিন্দু ইহা বুঝিতে পারে না। তাহার বিবেচনায় ঈশ্বরের কাছে কিছু চাওয়া ভুল। কিছু না চাহিয়া ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির বরং উচিত দেওয়া। ঈশ্বরের নিকট কোন কিছুর জন্য প্রার্থনা না করিয়া তাঁহাকে এবং মানুষকে যথাসাধ্য দান করা—ইহাতেই হিন্দুর অধিকতর বিশ্বাস। বক্তা বলেন, তিনি লক্ষ্য করিয়াছেন যে, পাশ্চাত্যে অনেকেই যখন সময় ভাল চলিতেছে, তখন ঈশ্বর সম্বন্ধে বেশ সচেতন, কিন্তু দুর্দিন আসিলে তাঁহাকে আর মনে থাকে না। পক্ষান্তরে হিন্দু ঈশ্বরকে দেখেন ভালবাসার পাত্ররূপে। হিন্দুধর্মে ভগবানের পিতৃভাবের ন্যায় মাতৃত্বের স্বীকৃতি আছে, কারণ ভালবাসার সুষ্ঠুতর পরিণতি ঘটে মাতাপুত্রের সম্বন্ধের মাধ্যমে। পাশ্চাত্যের খ্রীষ্টান সারা সপ্তাহ টাকা রোজগারের জন্য খাটিয়া চলে, ইহাতে সফল হইলে সে ভগবানকে স্মরণ করিয়া বলে, ‘হে প্রভু, তুমি যে এই টাকা দিয়াছ, সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ।’ তারপর যাহা কিছু সে রোজগার করিয়াছে, সবটাই নিজের পকেটে ফেলে। হিন্দু কি করে? সে টাকা উপার্জন করিলে দরিদ্র এবং দুর্দশাগ্রস্তদের সাহায্য করিয়া ঈশ্বরের সেবা করে।

বক্তা এইভাবে প্রাচী এবং প্রতীচীর ভাবধারার তুলনামূলক আলোচনা করেন। ঈশ্বরের প্রসঙ্গে বিবেকানন্দীর উক্তির নিষ্কর্ষঃ তোমরা পাশ্চাত্যের অধিবাসীরা মনে কর ঈশ্বরকে কবলিত করিয়াছ। ইহার অর্থ কি? ভগবানকে যদি তোমরা পাইয়াই থাকিবে, তাহা হইলে তোমাদের মধ্যে এত অপরাধ-প্রবণতা কেন? দশজনের মধ্যে নয়জন এত কপট কেন? ভগবান্ যেখানে, সেখানে কপটাচার থাকিতে পারে না। ভগবানের উপাসনার জন্য তোমাদের প্রাসাদোপম অট্টালিকাসমূহ রহিয়াছে, সপ্তাহে একদিন ওখানে কিছু সময় তোমরা কাটাইয়াও আস, কিন্তু কয়জন তোমরা বাস্তবিকই ভগবানকে পূজা করিতে যাও? পাশ্চাত্যে গীর্জায় যাওয়া একটা ফ্যাশন-বিশেষ এবং তোমাদের অনেকেরই গীর্জায় যাওয়ার পিছনে অপর কোন উদ্দেশ্য নাই। এক্ষেত্রে পাশ্চাত্যবাসী তোমাদের ভগবানের উপর বিশেষ অধিকারের কোন দাবী থাকিতে পারে কি?

এই সময় বক্তাকে স্বতঃস্ফূর্ত সাধুবাদ দ্বারা অভিনন্দিত করা হয়। বক্তা বলিতে থাকেনঃ আমরা হিন্দুধর্মাবলম্বীরা প্রেমের জন্য ভগবানকে ডাকায় বিশ্বাস করি। তিনি আমাদিগকে কি দিলেন সেজন্য নয়, তিনি প্রেমস্বরূপ বলিয়াই তাঁহাকে ভালবাসি। কোন জাতি বা সমাজ বা ধর্ম যতক্ষণ প্রেমের জন্য ভগবানকে আরাধনা করিতে ব্যগ্র না হইতেছে, ততক্ষণ উহারা ঈশ্বরকে পাইবে না। প্রতীচ্যে তোমরা ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং বড় বড় আবিষ্ক্রিয়ায় খুব করিতকর্মা, প্রাচ্যে আমরা ক্রিয়াপটু ধর্মে। তোমাদের দক্ষতা বাণিজ্যে, আমাদের ধর্মে। তোমরা যদি ভারতে গিয়া ক্ষেতে মজুরদের সহিত আলাপ কর, দেখিবে রাজনীতিতে তাহাদের কোন মতামত নাই। ঐ সম্বন্ধে তাহারা একেবারেই অজ্ঞ। কিন্তু ধর্ম সম্বন্ধে কথা কও, দেখিবে উহাদের মধ্যে যে দীনতম, সেও একেশ্বরবাদ দ্বৈতবাদ প্রভৃতি ধর্মের সব মতের বিষয় জানে। যদি তাহাকে জিজ্ঞাসা কর, ‘তোমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা কি রকম?’ সে বলিবে, ‘অতশত বুঝি না, আমি খাজনা দিই এই পর্যন্ত, আর কিছু জানি না।’ আমি তোমাদের শ্রমিক এবং কৃষকদের সহিত কথা কহিয়া দেখিয়াছি, তাহারা রাজনীতিতে বেশ দুরস্ত। তাহারা হয় ডেমোক্রাট, নয় রিপাবলিকান এবং রৌপ্যমান বা স্বর্ণমান কোন‍্‍টি তাহারা পছন্দ করে, তাহাও বলিতে পারে। কিন্তু ধর্ম সম্বন্ধে যদি জিজ্ঞাসা কর, তাহারা ভারতীয় কৃষকদের মতই বলিবে—‘জানি না’। একটি নির্দিষ্ট গীর্জায় তাহারা যায়, কিন্তু ঐ গীর্জার মতবাদ কি, তাহা তাহাদের মাথায় ঢুকে না। গীর্জায় নিজেদের সংরক্ষিত আসনের জন্য তাহারা ভাড়া দেয়—এই পর্যন্তই তাহারা জানে।

ভারতবর্ষে যে নানা প্রকারের কুসংস্কার আছে, বক্তা তাহা স্বীকার করেন। কিন্তু তিনি পাল্টা প্রশ্ন তুলেন, ‘কোন্ জাতি কুসংস্কার হইতে মুক্ত?’ উপসংহারে বক্তা বলেনঃ প্রত্যেক জাতি ভগবানকে তাহাদের একচেটিয়া সম্পত্তি বলিয়া মনে করে। বস্তুতঃ প্রত্যেক জাতিরই ঈশ্বরের উপর দাবী আাছে। সৎপ্রবৃত্তি মাত্রই ঈশ্বরের প্রকাশ। কি প্রাচ্যে কি প্রতীচ্যে মানুষকে শিখিতে হইবে ‘ভগবানকে চাওয়া’। এই চাওয়াকে বক্তা, জলমগ্ন ব্যক্তি যে প্রাণপণ চেষ্টায় বাতাস চায়, তাহার সহিত তুলনা করেন। বাতাস তাহার চাই-ই, কারণ বাতাস ছাড়া সে বাঁচিতে পারিবে না। পাশ্চাত্যবাসী যখন এইভাবে ভগবানকে চাহিতে পারিবে, তখনই তাহারা ভারতে স্বাগত হইবে, কেননা প্রচারকেরা তখন আসিবেন যথার্থ ভগবদ্ভাব লইয়া, ভারত ঈশ্বরবিমুখ—এই ধারণা লইয়া নয়। তাঁহারা আসিবেন যথার্থ প্রেমের ভাব বহন করিয়া, কতকগুলি মতবাদের বোঝা লইয়া নয়।
============

Post a Comment

0 Comments